জাতির পতাকা ॥ খামছে ধরেছে...
মহিউদ্দিন আহমেদ ॥ বাঙালীর ব্যথার সমাধি রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে পতাকার মর্যাদা ধরে রাখার শপথ নিলেন পতাকা হাতে লাখো জনতা। একইসঙ্গে যুদ্ধারাধীদের ফাঁসি ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে ঘরে ফেরার শপথ নিলেন তারা। গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার শনিবার এ শপথ পাঠ করান। পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, জেলা, উপজেলা, সকলস্তরে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করার পাশাপাশি রবিবারের হরতাল প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানান তিনি। মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারা ও নির্যাতনের শিকার মিরপুরের সখিনা সমাবেশে হাজির হয়ে ফাঁসি চাইলেন খুনী কাদের মোল্লার।
ইমরান এইচ সরকার বলেন, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের এক ইঞ্চি জায়গা দেয়া হবে না। তাদের ঠিকানা বাংলাদেশে নয়। তিনি বলেন, এ আন্দোলন কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচার ও তাদের রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধের দাবিতে। ডা. ইমরান জনসাধারণের উদ্দেশে বলেন, আপনারা জানেন, কোন পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আজ আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। ১৯৭১ সালে জামায়াত-শিবির ধর্মের নামে যেভাবে হত্যাকা- মেতেছিল, তারা একইভাবে আজও সেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই, গণজাগরণ মঞ্চের সবাইকে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আগামীকাল রবিবার জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সম্মিলিতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের ডাকা হরতাল প্রতিহত করতে হবে।
ডা. ইমরান বলেন, জামায়াত-শিবিরের কিছু হায়েনা জাতীয় পতাকাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তিনি বলেন, আজ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র কথায় কথা মিলিয়ে বলতে হয়- 'জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে, সেই পুরনো শকুন'। এ পুরনো শকুনদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করার দৃপ্ত আহ্বান জানান তিনি।
ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার আরও বলেন, আপনারা দেশের প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে হরতাল প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন। আমরা গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর থেকে আন্দোলন করে আসছি। ৪২ বছর ধরে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এখন এই দেশব্যাপী গণজাগরণের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। সারাদেশের লোকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ইস্পাতসম আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সংসদে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনী হয়েছে। আমরা চাই সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও ঘটনা মানুষের সামনে তুলে ধরায় জামায়াত-শিবির সাংবাদিকদের টার্গেট করেছে। শুক্রবার জামায়াত-শিবির কর্তৃক সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, গণজাগরণ যদি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হয় তাহলে সাংবাদিকরা হচ্ছেন এ যুদ্ধে সারথী। সাংবাদিকদের সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আশা প্রকাশ করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার ও সিরাজ হোসেনের উত্তরসূরি আপনারা। পুলিশ বাহিনীর ওপর জামায়াত-শিবির যে হামলা করেছে তারও নিন্দা জানিয়ে তিনি পুলিশ বাহিনীকে '৭১ সালের মতো সাহসী ভূমিকার পালন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে দেশের ১৬ কোটি মানুষ আছে। আছি আমরা গণজাগরণের মঞ্চের সদস্যরাও।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, জামায়াত-শিবির শুক্রবার যে কর্মকা- করেছে তা কোন ইসলামী কর্মকা- হতে পারে না। তারা ইসলামকে অবমাননা করেছে। ইসলামকে অবমাননা করার কারণে জামায়াত-শিবিরিকে শরিয়া আইনে বিচার করতে হবে। আর এই বিচার জনগণকে করার আহ্বান জানান তিনি।
মওদুদ আহমেদ সম্পর্কে তিনি বলেন, মওদুদ আহমেদ আপনি কেন বলছেন না গ্রেনেড হামলার বিচার হবে। কেন বলছেন না তাহের হত্যাকা-ের বিচার হবে। কেন বলছেন না জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার হবে না। এই গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কোন ধরনের বিভ্রান্ত ছড়াবেন না। সোহাগ বলেন, স্বাধীনতার পর হত্যা হয়েছে সকল হত্যার অপরাধীর বিচারের দাবি করছি আমরা। বিএনপিকে গণজাগরণ মঞ্চে একাত্মতা ঘোষণা আহ্বান জানান তিনি। একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, আমাদের লড়াই, কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। এ লড়াই মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে। একাত্তরের রাজাকার, আল বদরের বিরুদ্ধে। যারা একাত্তরে লাখো মানুষকে হত্যায় প্ররোচনা জুগিয়েছে, লাখো মা-বোনের অসম্মান করেছে। আলেম ওলেমাসহ সারা বাংলার মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণজারণ মঞ্চে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা আমাদের মঞ্চে আসুন, দেখুন সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কী বলি। কাদের বিরুদ্ধে আমাদের এ আন্দোলন।
বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে নাজমুল আলম বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ বিষয়ে আপনার বক্তব্য ও জামায়াতের পক্ষে অবস্থানের কারণে আপনি মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিলেও এখন আর আপনাকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারছি না। নাজমুল বলেন, দেশের মানুষ দেখেছে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমামকে লাঞ্ছিত করেছে, আগুন ধরিয়েছে। আমরা জামায়াত-শিবিরের কাছে প্রশ্ন করতে চাই পবিত্র কোরানের কোন্ জায়গায় ইমামকে লাঞ্ছিত করার কথা আছে। জামায়াতে ইসলামের ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নিন্দা জানান। তিনি আরও বলেন, জামায়াত ইসলাম আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার ভেঙ্গে ও জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়ে ১৬ কোটি মানুষের হৃদয় ভেঙ্গেছে। জামায়াত-শিবির ও তাদের মিত্রদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নাজমুল বলেন, আমরা অহিংস আন্দোলন করছি। কিন্তু যখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে তখন আপনাদের যেখানে পাব সেখানে গণধোলাই দেয়া হবে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এসএম শুভ বলেন, শুক্রবারের ঘটনা এটাই প্রমাণ করে জামায়াত-শিবিরের ইসলাম ধর্মপ্রতিষ্ঠা করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ জামায়াত-শিবিরের উদ্দেশ্য বুঝে গেছে। সুতরাং বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষরাই এই জামায়াত-শিবিরিকে প্রতিহত করবে।
জামায়াত-শিবিরকে উদ্দেশ করে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল রায় বলেছেন, একটা পতাকা ছিঁড়েছেন। ১৬ কোটির বাঙালীর হৃদয়ে আজ ১৬ কোটি পতাকা উড়ছে। সেগুলো কীভাবে পোড়াবেন? সামনে আসেন আমরা দেখতে চাই। আমরা এই পবিত্র বধ্যভূমিতে ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। যেসব সংগঠন মানবতাবিরোধী অপরাধ কার্যক্রম করেছে তাদের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ধর্মকে কেন্দ্র করে যারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে সেসব মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে। জানিয়ে দিতে চাই এদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি সামিয়া রহমান, বাংলাদেশ ছাত্র সংহতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম রাশেদ, ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর রহমান মিঠু, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল রায়, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তমাল, জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুল ইসলাম সুমন, ছাত্র ঐক্যের আহ্বায়ক সোহাগ সোহান প্রমুখ।
জনতার ঢল রায়েরবাজারে ॥ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী শনিবার রাজধানীর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে জাতীয় পতাকা হাতে ঢল নামে সর্বস্তরের জনতার। পায়ে পায়ে মানুষের স্রোত যেন এখানে এসে মিলেছে। সমাবেশের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনতার স্রোত, সব স্রোত মিশতে থাকে বাঙালীর এ ব্যথার সমাধিতে।
জনতার উচ্ছ্বাস আর মুহুর্মুহু সেøাগানে প্রকম্পিত হয় পুরো এলাকা। বেলা ২টা থেকেই সমাবেশে যোগ দিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন আসতে শুরু করে বধ্যভূমিতে। রাজাকারের ফাঁসি চাই সেøাগান সংবলিত হেড ব্যান্ড পরে আসতে থাকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন আকৃতির জাতীয় পতাকা হাতে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশস্থল বধ্যভূমির বেদিতে এসে সমবেত হতে থাকেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা দেশাত্মবোধক ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ সময় উপস্থিত অসংখ্য জনতা গলা মেলান শিল্পীদের সঙ্গে।
সখিনার আর্তনাদ ॥ মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার হাতে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারান মিরপুরের সখিনা। তিনি নিজেও চরম নির্যাতনের শিকার হন জামায়াতের এ নেতার হাতে। শনিবার বধ্যভূমির পতাকা সমাবেশে উপস্থিত হয়ে তিনি কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে না পারলে তাঁর হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি করেন। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ফাঁসি দিতে না পারলে কাদের মোল্লাকে আমাকে দেন। আমি তাঁকে কোবাই কোবাই মারবো। আমার বোন হত্যার প্রতিশোধ নেব। তাকে মেরে জয়বাংলা বলব। তাঁর কান্নায় সমাবেশে আগত শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। ভারি হয়ে ওঠে আশপাশের আকাশ। তিনি বর্তমানে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। তাঁকে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়।
সংহতি প্রকাশ ॥ সংহতি প্রকাশ করেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, নারী নেত্রী শিরিন, প্রজন্ম ৭১, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সংহতি প্রকাশ করেন।
রায়েরবাজারেও স্কুল শিক্ষার্থী ॥ শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের মতো রায়েরবাজারে বধ্যভূমিতেও স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। ওয়েস্ট ধানমণ্ডি গ্রীন ইউসুফ হাইস্কুল, লালমাটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কিশালয় বালিকা বিদ্যালয় কলেজ, গ্রীন ভিউ বিদ্যা নিকেতন, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুল, জাফরাবাদ গর্বমেন্ট প্রাইমারী স্কুলসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে জমায়েত হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবির গালিচা ॥ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। যুদ্ধাপরাধীর গলায় ফাঁসির রশি লাগানো একটি সাদা কাপড়ের গালিচা বিছানো হয় সমাবেশস্থলে ওঠার প্রবেশ পথে। ঘৃণার সহিত ওই গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে সমাবেশস্থলে যান জনতা।