একাত্তরে জেনোসাইড
২৫ মার্চ কালরাত
ইমতিয়াজ আহমেদ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে গণহত্যার সূচনা করে পাক হানাদার বাহিনী
অনেক সময় আমরা মাসকিলিং বা গণহত্যা বোঝাতেও জেনোসাইড ব্যবহার করে থাকি। কত সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। জাতিসংঘ যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা অনুযায়ী অল্পসংখ্যক লোকের মৃত্যুকেও আমরা জেনোসাইড বলতে পারি। বিংশ শতাব্দীতে বড় গণহত্যা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী পাইকারিভাবে ইহুদিদের নিধন করেছিল। এরও অনেক আগে অটোমান সাম্রাজ্যের আমলে আর্মেনিয়ায় জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল। ষাটের দশকে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী জেনারেল সুহার্তোর নেতৃত্বে এ ধরনের নিষ্ঠুর হত্যা অভিযান পরিচালনা করেছিল। তাদের টার্গেট ছিল নিজ দেশের চীনা সম্প্রদায় এবং একই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী-সমর্থকরা।
আফ্রিকার রুয়ান্ডায় তুৎসি ও হুতু সম্প্রদায় পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, সেটাও জেনোসাইডের পর্যায়ে পড়ে। কম্বোডিয়ার পলপটের নেৃতত্বেও একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। আমাদের এই উপমহাদেশে চলি্লশের দশকে দেশ বিভাগের আগেও ও পরে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পরকে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, সেটাও এ সংজ্ঞায় পড়ে। এ উগ্রপন্থার পেছনে কোনো আদর্শ কাজ করেনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী আলবদর-রাজাকাররা যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, সেটাও ছিল জেনোসাইড। ধর্মীয় কারণে এ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করা হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। কারণ যারা হত্যা করেছে এবং যারা এর শিকার হয়েছে তাদের বেশিরভাগ ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং আরও যোগ করা যায় যে, উভয়ে সুনি্ন সেক্টরভুক্ত। বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও প্রধান কারণ ছিল না। কারণ, বাংলা তখন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত। জাতিগত বিদ্বেষও কারণ হতে পারে না। তাহলে কেন এ নিষ্ঠুরতা? এর উত্তরে বলা যায়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতায় থাকা প্রভাবশালী চক্র গণতন্ত্র চায়নি বলেই নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিরা আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী করে। পাকিস্তানের ৩১৩ আসনের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল এককভাবেই ১৬৭ আসন লাভ করে। কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে না_ এটাই ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত। গণতন্ত্রের কারণে জেনোসাইড বাংলাদেশেই প্রথম। পাকিস্তানের সুযোগ ছিল প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সরকার গঠন করার। কিন্তু সামরিক ও এলিটচক্র তা হতে দিল না।
কেন ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডকে জেনোসাইড বলব? আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটেই বলছি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাদের হত্যা করেছে? তারা নির্বিচারে মেরেছে ছাত্রদের। নিহতদের অনেকে ছাত্ররাজনীতি করেছে, আবার কেউ কেউ একেবারেই আন্দোলনে শামিল ছিল না। তারা শিক্ষকদের হত্যা করেছে। বাগানের মালী এবং ছাত্রাবাসের দারোয়ানকে মেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্যান্টিন মালিক মধুসূদন দে'কে হত্যা করেছে। ধর্ম, ভাষা, পেশা কিংবা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী, ঠিক কী কারণে নিহতরা প্রতিপক্ষ_ সেটা পাকিস্তানি সৈন্যদের আচরণ থেকে নির্দিষ্ট করা যাবে না। তারা মূলত বাঙালিদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তাদের আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করতে সংকল্পবদ্ধ ছিল। সে সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, 'করষষ ঃযৎবব সরষষরড়হ, ঃযবু রিষষ বধঃ ড়ঁঃ ড়ভ ড়ঁৎ যধহফং.'
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডে কত লোকের প্রাণ গেছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক করছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশ সরকারিভাবে বলেছে ৩০ লাখ। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নও এমন একটি সংখ্যাকেই মেনে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো গবেষণায় তিন লাখ মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। আর পাকিস্তান বলেছে, 'মাত্র ২৬ হাজারের মতো মৃত্যু হয়েছে' ১৯৭১ সালে।
আমরা জানি যে, একাত্তরে কেবল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার-আলবদরদের হাতে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যু হয়নি। এদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে যে এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকের রোগব্যাধিতে মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে অনেক নারীর গর্ভপাত হয়েছে। মুক্ত দেশে ফিরে এসেও মৃত্যু ঘটেছে অনেকের। তবে আবারও বলছি, একাত্তরে যে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে সেটা প্রমাণের জন্য সংখ্যা নিয়ে আটকে থাকার দরকার নেই। জেনোসাইডের জন্য কতজনের প্রাণ গেছে, সেটা বড় কথা নয়। সে সময়ে টার্গেটেড হত্যাকাণ্ড ছিল এবং এটাই যথেষ্ট।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ন্যায়বিচারের। আর্মেনীয়দের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি এখনও উঠছে। এ জন্য অভিযুক্ত হচ্ছে তুরস্ক। দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু বলেছেন, জেনোসাইডের বিচার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নয়। এ ধরনের অপরাধ, নৃশংসতা যেন আর সংঘটিত না হয় সেটা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশে একাত্তরে যতজনকেই মারা হোক না কেন, সেটা করা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে। যাদের মারা হয়েছে তাদের কারও হাতে অস্ত্র ছিল না। বেশিরভাগ সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ছিল না। যেভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে সেটা কোনোভাবেই যুদ্ধের আইনে পড়ে না। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছে যে, যাদের কারণে এ হত্যাকাণ্ড বা জেনোসাইড, তাদের কেন চিহ্নিত করা ও শাস্তি দেওয়া হবে না। এ ধরনের অপরাধ ভবিষ্যতে যেন না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করার উপায়ও এটাই। দুই ধরনের লোক অপরাধে যুক্ত ছিল। এক. পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য; দুই. তাদের বাঙালি সহযোগী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি অর্জন, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনা এবং এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কারণে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের সম্পর্কে এ কথা বলা চলে না। পাকিস্তানিদেরও বুঝতে হবে যে ওই হত্যাকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বেআইনি। কীভাবে দিনের পর দিন সাধারণ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে সেটা তাদের জানা প্রয়োজন। তাদের দেশেও এমন অপরাধ আর যেন সংঘটিত না হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধকর্মে জড়িতদের সম্পর্কে সেখানের জনগণকে যথাযথভাবে অবহিত করার সময় এসেছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তাদের এ সুযোগ এনে দিয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল তিনটি মামলায় রায় দিয়েছেন। আরও কয়েকটি রায় হবে। আপিলের নিষ্পত্তি করা হবে। শাহবাগের সমাবেশে নানা মত ও পথের লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে। এ অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে, ১৯৭২ এবং ২০১৩ সাল এক নয়। এ প্রজন্মের তরুণরা চাইছে যে একাত্তরের অপরাধের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ দেশীয় সহযোগীদের বিচার হোক। তবে বিষয়টি যেন দলীয় রাজনীতির পর্যায়ে না পড়ে, সেটা তাদের প্রত্যাশা। এটাও মনে রাখা দরকার যে, ন্যায়বিচারের পাশাপাশি মানবাধিকারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ এবং দলীয় রাজনীতি যেন এর মধ্যে না আসে। ৫ ফেব্রুয়ারির পরবর্তী প্রথম সপ্তাহে তরুণ প্রজন্ম এ বার্তাই দিয়েছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ ছিল জেনোসাইডের সূচনা দিন। এদিনে আশা থাকবে যে, ন্যায়বিচারের ইস্যুটি যেন রাজনীতির ঊধর্ে্ব থাকে।
এটাও সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, একাত্তরের ২৫ মার্চ না হলে কিন্তু ২৬ মার্চ হয় না। ২৫ মার্চ জেনোসাইড ঘটিয়েই কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়। আমরা বিচ্ছিন্ন হইনি, বরং ওরাই দেশকে ভেঙে দিয়েছে। স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে কখন কীভাবে ঘোষণা হলো, সে বিতর্ক অর্থহীন। আমাদের সরকার ও মুক্তিবাহিনীর কাজ ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করা এবং এতে পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছি।
শেষ কথা বলব, গণতন্ত্রের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এখন চাই গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা এবং সমাজের সর্বস্তরে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ :রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
__._,_.___