সংসদ রিপোর্টার ॥ কারও উস্কানিতে নয়, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় দেশের প্রয়োজনে শপথ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে সশস্ত্র বাহিনী। সোমবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তিন বাহিনী প্রধানরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী কাজ করবে। এদিকে সংসদীয় কমিটি সশস্ত্র বাহিনীকে কারও উস্কানিতে সাড়া না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বৈঠকে কমিটির সদস্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী কোন ইসলামী দল নয়। দলটির সঙ্গে কোন মুসলিম গোষ্ঠী বা সংগঠনের সম্পর্ক নেই।
জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি এম ইদ্রিস আলী। বৈঠকে কমিটির সদস্য এইচএম এরশাদ, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, মঞ্জুর কাদের কোরাইশী এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি এমএ মান্নান অংশ নেন। এছাড়া সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, নৌবাহিনীপ্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল মুহাম্মদ ফরিদ হাবিব, বিমানবাহিনীপ্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচীর পক্ষে কথা বললে তার বিরোধিতা করেন অধিকাংশ সদস্য। তাঁরা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির কড়া সমালোচনা করেন। সে সময় এরশাদ বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের কারণেই হেফাজতে ইসলামের সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী সব মানুষ তাদের সমর্থন করে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে বিরোধীদলীয় নেতার আহ্বান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা হয় বৈঠকে। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য উস্কানিমূলক এবং দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেন কমিটির সদস্যরা। সে সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী-প্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কমিটির সদস্যরা বলেন, আপনারা কারও উস্কানিতে কান দেবেন না।
জবাবে তিন বাহিনীর প্রধান দৃঢ়ভাবে জানান, তাঁরা কারও আহ্বানে নয়, সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ী কাজ করবেন। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় তাঁরা যে শপথ নিয়েছেন সে অনুযায়ী দেশের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন করবেন।
উল্লেখ্য, দেশের রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার বন্ধ করতে সারাদেশে তা-ব চালানো শুরু করে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। এর মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং বগুড়ায় তাদের ধ্বংসযজ্ঞ ও সহিংসতা সব নারকীয়তাকেই ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে দলটির পক্ষ নেয়া বিএনপি এ ধরনের তা-বে জামায়াতের বিরোধিতা করেননি কখনও। এরই মধ্যে বগুড়ায় জামায়াত-শিবিরের তা-বের পর গত ২৪ মার্চ বগুড়ায় এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে অংশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের শান্তি রক্ষায় কাজ করে। আজ দেশে কোন বিশৃঙ্খলা হলে তারা বসে থাকবে না। তারা সময়মতো দায়িত্ব পালন করবে। এর আগে ওয়াশিংটন টাইমসে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করে একটি নিবন্ধ লেখাকে কেন্দ্র করে সমালোচনার শিকার হন বেগম জিয়া।
১/১১ তে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর রাজনৈতিক অঙ্গনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যক্তির এ ধরনের বক্তব্য দেয়া একেবারেই উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে ওই সময়ে তিনিসহ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ওই সরকার গ্রেফতার করার পর এ ধরনের বক্তব্য কী ভাবে দিলেন এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিশ্লেষকরা। এদিকে সেনা হস্তক্ষেপ চেয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর পরই সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে কারও উস্কানিতে সাড়া না দেয়ার আহ্বান জানান।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি এম ইদ্রিস আলী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বগুড়ায় খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা বিরোধীদলীয় নেতার ওই ধরনের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। কারণ তিনি সংবিধান পরিপন্থী কাজ করেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তাঁর এ ধরনের উস্কানি গ্রহণযোগ্য নয়। ইদ্রিস আলী বলেন, কমিটি সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের আহ্বান জানান। সে সময় তিন বাহিনীর প্রধানরাই জানিয়েছেন, সংবিধানে তাঁদের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সে প্রক্রিয়ায় শপথ অনুযায়ী তাঁরা দেশের জন্য কাজ করবেন।
এদিকে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার গণজাগরণ মঞ্চের তুমুল বিরোধিতা করেন। তিনি হেফাজতে ইসলামের প্রতি তাঁর শতভাগ সমর্থন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এরশাদ বলেন, সরকারের উচিত ছিল গণজাগরণ মঞ্চ গঠন হওয়ার দুই/তিন দিনের মধ্যে তা বন্ধ করে দেয়া। তাহলে এত সমস্যা তৈরি হতো না। গণজাগরণ মঞ্চের কারণে হেফাজতে ইসলামের সৃষ্টি হয়েছে। তারা ইসলামের চেতনায় আঘাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তারা ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষায় কাজ করছে। আমি তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী সব মানুষই তাদের সমর্থন দিয়েছে।
ঢাকায় হেফাজতে ইসলাম শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে উল্লেখ করে এরশাদ তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, সরকার তাদের সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে ঢাকায় সমাবেশের দু'দিন আগে অঘোষিত অবরোধ দিয়েছে। ফলে অনেক লোক ঢাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। এরপরও সমাবেশে ২০/২৫ লাখ লোক হয়েছে। তারা হেঁটে ঢাকায় প্রবেশ করেছে। বাধা না দিলে এক কোটি লোক সমাবেশে অংশ নিত। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, সংগঠনটি কোন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাবে না।
জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে এরশাদ বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোন ইসলামী দল নয়। দলটির সঙ্গে কোন মুসলিম গোষ্ঠী বা সংগঠনের সম্পর্ক নেই। এ সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়। তাই এ সভার আলোচনা সম্পর্কে তিনি কোন বক্তব্য দিতে রাজি নন।
তবে হেফাজতে ইসলাম নিয়ে এরশাদের এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেন কমিটির সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা। তারা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিকে মধ্যযুগীয় বলেও আখ্যায়িত করেন।
বিষয়টি স্বীকার করে কমিটির সভাপতি এম ইদ্রিস আলী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হেফাজতে ইসলামের পক্ষে কথা বললে অন্যরা তাতে দ্বিমত পোষণ করেন। ইদ্রিস আলী বলেন, ইসলামের হেফাজত করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর। কোন মানুষ এ কাজ করতে পারে না। হেফাজতকে কে দায়িত্ব দিয়েছে? কেউ যদি ইসলাম নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে তবে বুঝতে হবে তার ঈমানের শক্তি দুর্বল। সভাপতি জানান, এরশাদ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী কোন ইসলামী দল নয়। তারা ইসলামবিরোধী কর্মকা- করে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। সে সময় এরশাদ আগামী নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সকল আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন। যে কোন মূল্যে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা সমুন্নত রাখতে দেশের নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলকে চলমান সঙ্কট উত্তরণে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। এরশাদ বলেন, সংলাপের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচন আয়োজনে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের ঐকমত্য প্রয়োজন।
বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। এছাড়া সরকার উৎখাতের অপচেষ্টায় জড়িত পলাতক ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার কাজ দ্রুত শেষ করার ওপরও জোর দিয়েছেন সদস্যরা।