জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রথমে মৃত্যু গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লোটার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ এনে রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর দিন শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত নেতাকর্মীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন জুনায়েদ বাবুনগরী। গত ২১ মে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বাবুনগরী বলেছেন, গত ৫ মে রাতে অভিযানকালে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে লালবাগ নিয়ে যান। তিনি মূলত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনিজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে পড়ে গিয়ে পাওয়া আঘাতের ক্ষত ওষুধে আরোগ্য লাভের বদলে বেড়ে যায়। অসুস্থ বাবুনগরীকে দ্রুতগতিতে জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর মতো মানবিক ঘটনা নিয়েও রাজনীতি করা হচ্ছে। যেই মহলটি তার মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যর্থ হয়েছেন তারাই এখন আবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানোর নামে মাঠ গরম করার রাজনীতিতে মেতে ওঠেছে। ডাক্তার, পুলিশ, কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
জুনায়েদ বাবুনগরী সঙ্গে যারা আত্মীয়স্বজন আছেন তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাবুনগরীর পায়ে ফোঁড়া আছে। তার ওপর তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনিজনিত রোগসহ নানা জটিল রোগে বহুদিন ধরেই আক্রান্ত। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে রোগীর শারীরিক অবস্থা ওাঠানামা করাটাই স্বাভাবিক। পায়ের ফোঁড়া থেকে পুঁজ বের হলে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তারওপর আবার কিডনির জন্য ডায়ালিসি করাতে হচ্ছে। বহু রোগাক্রান্ত বাবুনগরীর চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস সমিতির তালিকাভুক্ত সদস্য হিসেবে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নিতেন। হজ মৌসুমে সৌদি আরবে গিয়ে তিনি একইসঙ্গে মাদ্রাসার জন্য আর্থিক সহায়তার আনেন আবার একই সঙ্গে নিজেও মেডিক্যাল চেকআপ করিয়ে নেন। ঢাকার বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট ডা. শামীম ইকবালের তত্ত্বাবধানে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডায়াবেটিস থাকায় তার পায়ের ঘা বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোগমুক্তির জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন বাবুনগরী। নিয়মিত খাবার খাচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলছেন।
বারডেম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবুনগরীর উন্নত চিকিৎসার জন্য গঠন করা হয়েছে ৭ সদস্য মেডিক্যাল টিম। নিবিড় পরিচর্যায় রেখে চিকিৎসা করানো হচ্ছে তাঁকে। তিনি আশঙ্কামুক্ত। তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। পায়ের ফোঁড়া, ফোঁড়ার পুঁজ বের হওয়া, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ও বয়সের কারনে আরোগ্য লাভ করতে একটু দেরি হচ্ছে। বাবুনগরীর জামাতা মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, ভাগ্নে মাওলানা সালাউদ্দিনসহ স্বজনরা তার পাশেই আছেন। তারা বারডেম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাবুনগরীকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নেয়া হবে না। বাবুনগরীর স্বজনরা সাংবাদিকদের কাছে তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে এমন ধরনের অভিযোগও করেননি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার প্রশ্নই ওঠে না। ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাকে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়ার জন্য ৩ ঘণ্টা সময় দেন। তিনি ম্যাজিস্ট্র্রেটের কাছেও রিমান্ডে নির্যাতন করার অভিযোগ করেননি। এমনকি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার সময় বলা হয়ে থাকে, আমি পুলিশ নই। আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি ম্যাজিস্ট্র্রেট। আপনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে জবানবন্দী দিতে পারেন। গত ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে পরের দিন ৬ মে লালবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় বাবুনগরীকে। পরের দিন ৭ মে পুলিশ সদস্য মিজান হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর-এ ৩টি মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২২ দিনের রিমান্ড নেয়ার আদেশ দেয় আদালত। রিমান্ডে মেয়াদ শেষ না হতেই গত ২১ মে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন বাবুনগরী। জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আদালতে নেয়া ও কারাগারে পাঠানোর অবস্থানের দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার কোন অভিযোগ ওঠেনি। আগের বহু রোগে আক্রান্ত বাবুনগরীর অবস্থার অবনতি ঘটে। মানবিক কারণে অসুস্থ বাবুনগরীকে দ্রুততার সঙ্গে জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য যেখানে সরকারের প্রশংসা পাওয়া উচিত সেখানে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার মতো পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা জানান। জবানবন্দীতে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দেন। এরমধ্যে ঘটনার রাতে সম্মিলিত অভিযানে ব্যাপক আওয়াজের কারণে ভয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা পালাইয়া যায় বলে তিনি বলেন। তিনিও পড়ে গিয়ে ছিলেন বলেও জানান। তবে পড়ে গিয়ে তিনি আহত বা ব্যথা পেয়ে ছিলেন কি না সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেননি। জবানবন্দীতে রিমান্ডে তাঁর ওপর নির্যাতন করার বিষয়ে তিনি কোন তথ্য দেননি। পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেছেন, বাবুনগরীর জামিনের আবেদনে যেই আইনজীবী আদালতে তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সেই আইনজীবী বিএনপিপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতা।
বাবুনগরীর জামিনের আবেদনের সময়ে আইনজীবী সানাউল্লাহ আদালতকে বলেছেন, ইসলাম ও মহানবী (স)
কটূক্তি করার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের সময়ে পুলিশ পাখীর মতো গুলি করে মানুষ খুন করেছে। এ সময় শত শত মানুষ আহত হয়েছেন। রিমান্ডে নিয়ে বাবুনগরীকে নির্যাতন করা হয়। নির্মম নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
বাবুনগরীর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতে বলেছেন, সেদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন ও পুলিশ পাখির মতো গুলি করে মানুষ খুন করার ঘটনা কি সত্যি? সেদিন যা ঘটেছিল তা টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আঁতকে উঠেছেন দেশবাসী। গত ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী পালন করে। সকাল থেকেই রাজধানীর ৬টি প্রবেশ পথে অবস্থান নেয় তারা। সকাল ১০টার পর থেকেই পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হেফাজতের কাছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ঢাকার মতিঝিলের দিকে রওনা হন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল, শাপলা চত্বর, ইত্তেফাক মোড়, স্টেডিয়াম এলাকা, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ আশপাশের এলাকা পুরোপুরি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলাম শান্তিপূর্ণ দোয়ার মধ্যদিয়ে সমাবেশ করার শর্তে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি পায়। অনুমতি পেয়েই বেপরোয়া তা-ব শুরু করে। তারা ৬ শতাধিক পবিত্র কোরান শরীফ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, হাজারখানেক দোকানপাট, স্বর্ণের দোকান, ২ শতাধিক যানবাহন, শতাধিক ভবন ভাংচুর ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশ, পথচারীসহ অন্তত ২ শতাধিক আহত হন। পুলিশসহ ৭ জন নিহত হন। ঘটনার দিন রাতেই বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব সম্মিলিত অভিযান চালিয়ে হেফাজতকে মতিঝিল থেকে সরিয়ে দেয়।
বাবুনগরীর চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন এমন এক চিকিৎসক বলেছেন, সম্ভবত গত ৫ মের হেফাজতের তা-বের পর থেকেই বাবুনগরী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। এরপর থেকেই তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বাবুনগরী দীর্ঘ দিন ধরেই ডায়াবেটিসের রোগী। ঘটনার রাতে বাবুনগরী পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ইটের খোয়ার আঘাতে তিনি আহত হয়ে থাকতে পারেন। সেখানে তিনি পায়ে ব্যথা পেতে পারেন। ক্ষত থেকেই ঘা হয়েছে। ডায়বেটিস থাকায় ঘা বেড়েছে। ঘা শুকিয়ে আনতে তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। এজন্য তাঁকে বারডেমে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া তিনি কিডনিজনিত রোগসহ নানা জটিল রোগে বহুদিন ধরেই আক্রান্ত। তিনি চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস সমিতির তালিকাভুক্ত সদস্য। তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই ডায়াবেটিসের সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলছেন। গ্রেফতার হওয়ার পর নানা দুশ্চিন্তায় তার ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। তিনি হজ মৌসুমে সৌদি আরবে যান। সেখানে তিনি একইসঙ্গে মাদ্রাসার জন্য আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি দেশে ফেরার আগে তিনি মেডিক্যাল চেকআপ করিয়ে নেন। ঢাকার বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট ডা. শামীম ইকবালের তত্ত্বাবধানে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাবুনগরী নিজেই খাওয়া দাওয়া করতে পারছেন। আরও সুস্থ হওয়ার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।