ঢাকা: পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের ছবি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, এরাই একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর আমাদের বাসায় এসেছিলেন। এরাই ১৫ ডিসেম্বর বাবাকে অপহরণ করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির মেয়ে ডা. নুসরাত রাব্বি। তিনি ওই দুইজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেছেন ডা. নুসরাত। সাক্ষ্যগ্রহণ অসমাপ্ত অবস্থায় আগামী বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ট্রাইব্যুনাল।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বি ছিলেন এদেশের একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর বিকেল আনুমানিক তিনটার দিকে তাকে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর ৭৫ জলপাইগুড়ি হাউজের বাসা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যান আলবদররা। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বর্তমানে ৫০ বছর বয়সী সাক্ষী ডা. নুসরাত রাব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তার বর্তমান ঠিকানা ১৮০০, মার্কেট স্ট্রিট সানফ্রন্সিসকো। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে স্ট্যাটিসটিক্স ও ক্যান্সার জেনেটিক্সের অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত। একই সঙ্গে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও বার্কলিতে অধ্যাপনা করেন। তার পৈত্রিক নিবাস পাবনার হেমায়েতপুরে।
গত ৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় আসেন ডা. নুসরাত।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার বাবাকে অপহরণের সময় নুসরাতের বয়স ছিল ৮ বছর। তিনি ও তার মা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষ্যে ডা. নুসরাত সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ১৫ ডিসেম্বর বিকেল আনুমানিক তিনটার দিকে আলবদররা আমাদের বাসা ঘিরে ফেলে। তখন বাসার সামনে কাদা মাখানো একটি মাইক্রোবাস এসে থামে। ওই মাইক্রোবাসে করে আমার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে যান আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।
১৮ ডিসেম্বর এক সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারি, আমার বাবাকে অপহরণকারীরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তিনি বলেন, একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাসায় এসেছিলেন খোঁজ-খবর করতে। পরে বুঝতে পারি ওরা এসেছিলেন আমাদের বাসার লোকেশন জানতে।
১৩ ডিসেম্বর আমি এবং আমার আম্মা আগন্তুকদের দেখেছিলাম। তাদের মুখে চাপ দাড়ি ছিল। তখন আমরা তাদের চিনতে পারিনি।
স্বাধীনতার পরে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের ছবি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, এরাই একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর আমাদের বাসায় এসেছিলেন। এরাই ১৫ ডিসেম্বর বাবাকে অপহরণ করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
গত ১৫ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরও ৯ সাক্ষী। তারা হচ্ছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের ভাগ্নি মাসুদা বানু রত্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের ছেলে ড. এনামুল হক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের ছোট ছেলে তৌহিদ রেজা নূর, শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল, শহীদ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার ভাই আ ন ম গোলাম রহমান দুলু এবং শহীদ ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. ফারজানা চৌধুরী নিপা।
তাদেরকে জেরা শেষ করেছেন আসামিপক্ষের রাষ্ট্র নিযুক্ত দুই আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।
১৫ জুলাইই প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিচার কাজ শুরু হয়। পলাতক এ দুই অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতেই সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর শাহিদুর রহমান।
গত ২৪ জুন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ও আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গত ১৬ জুন তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৪ জুন বিদেশে পলাতক এ দুই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ২ মে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সম্ভাব্য ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশন জানানোর পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারকে দু'টি জাতীয় দৈনিকে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১০ দিনের মধ্যে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৫ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৩
এমএইচপি/ এমএমএস/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর eic@banglanews24.com