দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গীর ফাঁসি হবে রাতেই- মঙ্গলবার এ খবর জানার পর স্বামীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ারা জাহান। সাক্ষাতের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় 'ভি' চিহ্ন দেখান তিনি। কিন্তু সানোয়ারা জাহান যে কায়দায় চিহ্নটি দেখালেন তার মানে কী?
সাধারণত 'ভি' চিহ্নকে 'বিজয় চিহ্ন' বলে ধরে নেওয়া হয়। অবশ্য বিজয়ের এ চিহ্ন দেখানোর সময় হাতের তালু থাকে সামনের দিকে। শান্তি এবং বন্ধুত্বের (সৌহার্দ্যের) প্রতীক হিসেবেও এ চিহ্ন দেখানো হয়। কিন্তু কাদের মোল্লার স্ত্রী হাতের তালু ভেতরের দিকে অর্থাৎ নিজের দিকে রেখে 'ভি' চিহ্ন দেখিয়েছেন, বিভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতিতে যা 'অবজ্ঞা'র প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এভাবে 'ভি' চিহ্ন দেখানো 'শাস্তিযোগ্য অপরাধ' ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে। এভাবে উল্টো 'ভি' চিহ্ন দেখানো ক্যামব্রিজ ডিকশনারি অনুযায়ী, কারো প্রতি রাগ প্রকাশ। আর গুগল অনলাইন ডিকশনারিতে এ চিহ্নকে 'আদালতের প্রতি অবজ্ঞাজনক আচরণ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাদের মোল্লার পরিবারের দাবি, আদালতের রায়ের প্রতি অবজ্ঞা দেখাতে সানোয়ারা উল্টো 'ভি' চিহ্ন দেখাননি। বিজয়ের প্রতীক হিসেবেই দেখিয়েছেন। জানার ভুলের কারণে তিনি উল্টোভাবে ভি চিহ্ন দেখিয়েছেন।
কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল কালের কণ্ঠকে বলেন, "ফাঁসিকে আমরা ইসলামী আন্দোলনের পথে আত্মত্যাগ হিসেবে দেখেছি। তাই বাবার ফাঁসি হবে জেনেও মা এ চিহ্ন দেখিয়েছেন। উল্টো 'ভি' অবজ্ঞা বা অসম্মানের অর্থ বহন করে সত্য। কিন্তু আমার মা বিজয়ের প্রতীক হিসেবেই এ চিহ্ন দেখিয়েছেন। মহিলা মানুষ তো, না বুঝে উল্টো করে দেখিয়েছেন।"
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ শোনার পর কাদের মোল্লাও ভি-চিহ্ন দেখিয়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর স্ত্রীর মতো উল্টোভাবে দেখাননি। তিনি যেভাবে ভি-চিহ্ন দেখান, তা বিজয়ের প্রতীক হিসেবেই ধরা হয়। তাঁর ওই ভি-চিহ্ন দেখানোকে ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ বলে মন্তব্য করেন ওই দিন থেকে শাহবাগে শুরু হওয়া গণজাগরণ মঞ্চে জমায়েত নেতা-কর্মী-সমর্থকরা।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, হাতের তালু ভেতরের দিকে বা নিজের দিকে রেখে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে অনামিকা ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল চেপে ধরে তর্জনি ও মধ্যমা উঁচিয়ে ধরে ভি-চিহ্ন দেখানো হলে তা 'অপমান' বলে মনে করা হয়। যুক্তরাজ্যসহ সমমনা সংস্কৃতিতে তা 'অপমান করার মতো' শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় তালু ভেতরের দিকে রেখে ভি-চিহ্ন দেখানো নিষিদ্ধ। অনেকে দুই নম্বর (ভুয়া) বোঝাতেও ভি-চিহ্ন ব্যবহার করে। কাদের মোল্লার স্ত্রী যেভাবে ভি-চিহ্ন দেখিয়েছেন গুগল অনলাইন ডিকশনারি অনুযায়ী তা আদালতের আদেশের প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত ১২টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে কারাগারের বাইরে এসেই উল্টো ভি-চিহ্ন দেখান সানোয়ারা জাহান। তাঁর ওই চিহ্ন দেখানোর মাজেজা বুঝতে গতকাল বুধবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় তাঁর সঙ্গে। কল রিসিভ করে তাঁর ছেলে হাসান জামিল জানান, তাঁর মা অসুস্থ। তবে মায়ের ভি-চিহ্ন দেখানোর একটা ব্যাখ্যা দেন তিনি।
জামিল বলেন, 'আমার মা কারাগারে বাবার সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাৎ করে বাইরে বের হয়ে ভি-চিহ্ন দেখিয়েছেন। নিজেদের বিজয় হয়েছে, এমনটি ভেবেই মা এটি করেছেন, আদালত বা রায়কে অবজ্ঞা করতে নয়। আমাদের আন্দোলনের আদর্শই হলো আত্মত্যাগ, ইসলামের পথে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া, রক্ত দেওয়া। ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারলে, তাঁকে আমরা বিজয় হিসেবে দেখি। বাবার ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল রাত ১২টা ১ মিনিটে। আল্লাহ তাঁর ফাঁসি কবুল করলে, ইসলামী আন্দোলন আরো ত্বরান্বিত হতো। তাঁর তো এমনিতেও মৃত্যু হতে পারত। সেক্ষেত্রে ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ করার শান্তি পাওয়া যেত না। এটাকেই আমরা বড় বিজয় হিসেবে ভেবেছি। সে কারণেই আমার মা ভি-চিহ্ন দেখিয়েছেন।'
ইসলামের জন্য আত্মত্যাগকে যদি বিজয় মনে করেন, তাহলে ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির আদেশ না হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের কথা শুনে কাদের মোল্লা ভি-চিহ্ন দেখিয়েছিলেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে হাসান জামিল বলেন, 'ফাঁসির আদেশ না হওয়ার কারণে ওই দিন তিনি ভি-চিহ্ন দেখাননি। ওনার মতো বৃদ্ধ মানুষের এখন আরাম-আয়েশে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকার কথা। ইসলামী আন্দোলনের কারণেই সরকার তাঁকে কারাগারে রেখেছে। অর্থাৎ, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য কারাগারে গিয়ে তাঁকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তাই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ শুনে তিনি বিজয় চিহ্ন দেখিয়েছিলেন।'
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ভি-চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয় ১৪১৫ সালে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে শতবর্ষী যুদ্ধে। ওই সময় ফ্রান্সের সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের ধরে তাদের মধ্যমা ও তর্জনি কেটে দিতে শুরু করে। পরে ইংরেজরা নিজেদের শক্তিমত্তা দেখাতে ওই দুটি আঙ্গুল উপরে তুলে ধরে ভি-চিহ্ন দেখাতে শুরু করে। তাঁরা ভি-চিহ্ন দেখানোর মধ্য দিয়ে ফ্রান্সকে বোঝানোর চেষ্টা করত যে, এখনো তাদের আঙ্গুল রয়েছে, যা দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হবেন তাঁরা। তবে সময়ভেদে সমাজভেদে ভি-চিহ্নের অর্থ ভিন্নরূপ নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী বিজয়ের প্রতীক হিসেবে এ চিহ্নটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। ষাটের দশকে প্রতি-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে (কাউন্টার কালচার মুভমেন্ট) ভি-চিহ্নকে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখানো হতো। আর চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে ভি-চিহ্ন দেখানো হয় খুবই জনপ্রিয় ভাব নিয়ে ছবি তোলার ক্ষেত্রে।
'বিজয়চিহ্ন' দেখালেন কাদের মোল্লার স্ত্রীও
__._,_.___