মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ৬ ফাল্গুন ১৪২০
এক রাজাকারের আত্মজীবনী
মুনতাসীর মামুন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
॥ ৮ ॥
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কিছু নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। আরেকটি গ্রুপও একই ধরনের কাজ করতে থাকে। আর দু'টি গ্রুপকে সহায়তা করছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারত। কারণ, ভারত পাকিস্তানকে ভাঙতে চাচ্ছিল। মহিউদ্দিনের মতে, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ইসলামী রেনেসাঁয় ভীত হয়ে পাকিস্তানের শত্রুকে সহায়তা করছিল।
মহিউদ্দিন এরপর মুসলমান চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, ভারতীয় মুসলমানরা ছিল 'পারভারটেড' তাদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানে ভোট দেওয়ার জন্য। কিন্তু "আমাদের চরিত্র তো ইসলামিক নয়।" খেদ জানিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা মিথ্যাচার করেননি, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সত্যিকারের মুসলমান নয়, তারা হিন্দুদের ছেলেপিলে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষালয়ে হিন্দু শিক্ষকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় হিন্দু দর্শন। হিন্দু গবেষক শিক্ষকরাই বই লেখেন। বাংলা [পূর্ব পাকিস্তান] হচ্ছে একটি জাদুর দেশ..., প্রত্যেক মুসলমান মেয়ে গায়িকা এবং নর্তকী, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ভারস্বরূপ। দেশটি হচ্ছে, সাইক্লোন আর বন্যার দেশ। একটি অভিশপ্ত প্রদেশ। আল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে খুশি নয়। খুশি হলে ঐ এলাকায় এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন হবে?
এ প্রসঙ্গে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। সাধারণ নির্বাচনের [১৯৭০] নোয়াখালীর মাইজদী কোর্টে টাউন হলে তিনি বজ্র কঠিন গলায় বলেছিলেন- "করাচি হয়ে গেছে একটি সোনালী শহর; মরুভূমি রূপান্তরিত হয়েছে সোনালী মরূদ্যানে; ইসলামাবাদ নির্মিত হচ্ছে সোনা দিয়ে। এ সবই করা সম্ভব হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের কারণে। তারা মংলাবাঁধ নির্মাণ করেছে, নির্মাণ করেছে তারবেলা বাঁধ, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছুই না; আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দাবি তুললাম, তখন তারা মানুষকে ইসলামের নামে ভোলাবার জন্য মওদুদীকে পাঠালো।
এরপর মহিউদ্দিন যা লিখেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে তার বক্তব্যটি সঠিক কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানী, তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, কলোনির শোষণ চাপা পড়ে যায়।
তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর এ্যাকশনের কারণে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সাল থেকেই এর শুরু। শহীদ-ই-মিল্লাতকে [লিয়াকত আলী খান] খুন, মওদুদীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ, বাংলাভাষা আন্দোলন, নারায়ণগঞ্জ পাট কারখানা আন্দোলন, কর্ণফুলী কাগজকল আন্দোলন, শিল্পাঞ্চলে সংঘর্ষ, সংবিধান পরিত্যাগ, সামরিক শাসন জারি, মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন, এবডো এবং সর্বশেষে আর্মি এ্যাকশন। এ সব বিষয় বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। বরং তারা একটি শেকলের মতো। এই শেকলটি কালো হাতে কেউ ধরেছিল কিন্তু আমরা সামনে দেখেছি জেড এ ভুট্টো এবং শেখ মুজিবকে। আমরা দেখেছি ডাল রুটি, ডাল ভাতের জন্য তাদের দাবি, তাদের জীর্ণ শালওয়ার, শার্ট, লুঙ্গি বিশ্বাস করেছি তাদের, তাদের শিকার হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে খ-িত করেছি। (পৃ-৮১]
প্রথমেই বলে নেয়া হচ্ছে ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দায়ী নয়, শেষেও একই কথা বলা হচ্ছে। লিয়াকত আলী ও মওদুদীর বিষয়কে একইভাবে দেখা হয়েছে। যদিও দু'টি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। নারায়ণগঞ্জ এবং কাপ্তাইয়ে কারখানায় কোন আন্দোলন হয়নি। হয়েছিল বাঙালী বিহারি দাঙ্গা এবং তা উসকে দিয়েছিল অবাঙালী কর্মকর্তারাই। এখানে পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ আমলাদের চক্রান্ত, কলোনি শাসন, সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য ও নিপীড়ন, জামায়াত-মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। অদৃশ্য কালো হাত যে পাঞ্জাবীদের সেটি বাদ দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইয়াহিয়ার কথা একবারও উল্লেখ নেই। ১৯৭১ জামায়াত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হয়ে কাজ করেছিল।
জামায়াতের মজলিসে শূরার অধিবেশন হলো ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে নোয়াখালী জেলায় সাংগঠনিক সফর করলেন মহিউদ্দিন। কী হবে কী হবে সবাই এ চিন্তায় ব্যস্ত।
ঢাকা জ্বলছে, পূর্ব পাকিস্তান জ্বলছে লিখেছেন মহিউদ্দিন, সবাই উত্তেজিত, কিন্তু মহিউদ্দিনের কোন উত্তেজনা নেই। স্বাভাবিকভাবেই দিন যাপন করছেন যেন কিছুই হয়নি। কর্মীদের শুধু বললেন, রাজনীতির যা-ই হোক না তারা যেন জামায়াতের সঙ্গে বন্ধন শক্তিশালী করে। কী ঘটবে মহিউদ্দিন জানতেন কীনা জানি না। এ সম্পর্কে তিনি কিছু জানাননি। না জানলে ধরে নিতে হবে, রাজাকারের রক্ত অতি ঠা-া। যে কারণে ১৯৭১ সালে তারা ঠা-া মাথায় গণহত্যা করতে পেরেছিল।
॥ ৯ ॥
নোয়াখালী শহরে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে জামায়াত অফিসে মহিউদ্দিন বসেছিলেন। হঠাৎ দেখেন দু'জন অফিসে ঢুকলেন। তাদের দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। এদের একজন হলেন চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব আমির শফিউল্লাহ, তখন জামায়াতের শ্রম সম্পাদক। মহিউদ্দিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন;
'আপনি এখনও এখানে?'
'কেন, কী হয়েছে?'
'কিছু একটা ঘটবে। উঠুন, চলুন লক্ষ্মীপুরে যাই।'
তারপর তিনি ঠিক করলেন কী ভাবে যাবেন। সোজাপথে না গিয়ে তিনি ঠিক করলেন, গ্রামের রাস্তায় রিক্সা করে যাবেন। বিদায় নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন। অর্থাৎ শফিউল্লাহ জানতেন কী হতে যাচ্ছে। মহিউদ্দিন বিকেলে লক্ষ্মীপুর পৌঁছলেন। ২৫ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি লক্ষ্মীপুরে নিজ বাড়িতে ছিলেন। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর 'নির্যাতন' 'নিষ্ঠুরতা'-বিডিআর ও পুলিশদের দমন। বিভিন্ন সেনানিবাসেব বাঙালী পাক সেনাদের আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের কথা শুনেছেন। এখানে লক্ষণীয়, হানাদার বাহিনীর 'নির্যাতন' ও নিষ্ঠুরতা' তিনি বিশ্বাস করেন না।
এবার রাজাকারের দিকের বয়ান শুনুন। তিনি লিখেছেন, "আমি এক শ' ভাগ নিশ্চিত যে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে আর্মি এ্যাকশন হয়েছে। যদি তা না হয় তাহলে যাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছে, তাদের কেন শত্রু বানানো হবে? শত্রু বানানোর কারণ, তাহলে বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হবে, পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেবে এবং এক সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যেখান থেকে ফেরা যাবে না।'
মহিউদ্দিন মনে করেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে গ্রাম, বিভিন্ন শহর ও ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা আশ্রয়ের নামে ভারত চলে যায়। ইকবাল হল ও অন্যান্য হল যা ছিল নেতাদের দুর্গ তা ২৫ মার্চ বিকেলেই খালি হয়ে যায়। শহরে তো লোক বেশি ছিল না। সেগুলোও খালি হয়ে যায়।
বিনা কারণে রাজাকার মহিউদ্দিন বর্ণনা দেননি। এর পরে শুনলে বোঝা যাবে কোন মিথ্যা অনুচ্ছেদটি লেখা হয়েছে। তার ভাষায়, সেনারা খালি হলগুলোতে অভিযান চালায়। ঢাকায় তারা এক বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে যার ফলে আলোর ফুলঝুরি উঠত। এই অস্ত্র ছিল নিরস্ত্রদের ভয় দেখানোর জন্য। মানুষজন হেঁটে গ্রামের দিকে রওনা দিল। হ্যাঁ, কিছু মানুষ মারা গেছে কিন্তু তা পরিকল্পনার বোকামির কারণে। কিন্তু সেই বোকামি নিরস্ত্র মানুষের না সশস্ত্র পাকিদের তা লিখতে ভুলে গেছেন মহিউদ্দিন। তিনি লিখছেন, না বোকামি বলব না বরং বলব চতুর। রেল লাইনের পাশে যদি গরিব শ্রমিকদের কয়েকজন মারা যায় বা গ্রেফতার করা হয়। তা হলে নিশ্চিতভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। যদি হিন্দু এক দার্শনিক অধ্যাপক মারা যায়, তা হলে পুরো হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবে, যার অজুহাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটেছিল। এতক্ষণে বোঝা গেল, মহিউদ্দিন প্রথমে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের রেফারেন্স দিচ্ছেন। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীরা চতুরতার সঙ্গে এই কাজ করেছিল যাতে বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হয় ভারত ক্ষুব্ধ হয়। বলিহারি রাজাকারের কল্পনা শক্তি।
২৫ মার্চ ও তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিবরণ যেভাবে মহিউদ্দিন দিয়েছেন তাতে মনে হতে পারে মার্চ-এপ্রিলে যা ঘটেছে বলে প্রকাশিত হয়েছে আসলে তা গুজব। লিখেছেন তিনি, 'একদিন সকালে একলা গ্রামের রাস্তা ধরে ভবানিগঞ্জ যাচ্ছিলাম। এক লোকের সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। তিনি বললেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে আসছি। হাজার হাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ একইভাবে খাওয়া-পানি ছাড়া হেঁটে আসছে। চাঁটগায় পাঞ্জাবীরা লাখ লাখ হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।'
'এ সময় দেখলাম জাতিসংঘের একটি গাড়ি আসছে। হাত তুলে থামালাম। চালক বিদেশী। আমি তাকে অনুরোধ জানালাম, ঐ লোককে গাড়িতে একটা লিফট দিতে যার মতে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, চাঁটগায়ে লাখ লাখ লোক মারা গেছে, পাঞ্জাবী সৈন্যরা হেরে গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জিতছে এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছে।' (পৃ. ৮৫]
২৫ মার্চ গণহত্যা নিয়ে বেশ একটা ব্যঙ্গ করা হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও লক্ষ্য করুন। দু'টি অনুচ্ছেদে নিজে নিজেই শব্দের মানে বদলে ফেলেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পাঞ্জাবীরা হত্যা করছে, পরাজিত হয়েছে এমন কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কথা নেই, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তার উল্লেখ নেই।
১৫ এপ্রিল তিনি খবর পেলেন তার দূর সম্পর্কের এক শ্যালক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। মহিউদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তারপরও মহিউদ্দিন যেচে গেলেন সেখানে। তাকে দেখা মাত্র বোঝা গেল শ্যালক ক্ষুব্ধ হলেন, যদিও মুখে কিছু বললেন না। তাকে স্বাগতও জানালেন না। মহিউদ্দিন বসা মাত্র শ্যালক পাকিস্তানী সৈন্যরা যে হত্যা লুট অগ্নিসংযোগ করছে তার কয়েকটি ঘটনা বললেন। মহিউদ্দিন খান বলেছেন, এসব গুজব, প্রোপাগা-া।'
এটি শোনা মাত্র মহিউদ্দিনের ভাষায় শ্যালক তাকে আমার্জিত ভাষায় গালাগাল করে বললেন, 'আমার বাড়ি থেকে বের হও রাস্কেল, পাঞ্জাবী এজেন্ট, বের হও ইত্যাদি।'
মহিউদ্দিন পরে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, এরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ কী? সেই একই কৌশল। তার জামাই ঢাকায় কোন এক জায়গায় কেরানির কাজ করে। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি রওনা হয়েছিল। তিনদিন হেঁটে বাড়ি পৌঁছে সে জানিয়েছে, ঢাকা ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। সব হিন্দু এবং প্রায় সব আওয়ামী লীগারকে মেরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গায়। রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামেও একই ঘটনা ঘটেছে। হাজার হাজার লোক ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে এ ধরনের প্রচার করছে। তারা এমনভাবে বলছে যেন সব ঘটনা তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে।
এরই সূত্র ধরে মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, এ ধরনের শত শত গল্পগাছা তখন পল্লবিত হয়েছে। মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। পাকিস্তানের শত্রুরা এতে সফল হয়েছে। এই ধরনের একটি কাহিনীর তিনি উল্লেখ করেছেন।
"টিক্কা খান নয়ফুট লম্বা এবং তিন ফুট পাশে। দিনে তিনি তিন কিলো মানুষের রক্ত পান করেন, সকালের নাস্তায় তিনি মানুষের মগজ খান। তিনি বলেছেন, আমি সব বাঙালীকে হত্যা করব। আমি মাটি চাই মানুষ চাই না।"
ঐ সময়ে এ ধরনের কাহিনী আমি শুনিনি। শেষ বাক্যটি সত্য। ঐ বাক্যটি ইচ্ছে করে দেয়া হয়েছে যাতে মানুষের মনে হয় এ ধরনের গুজব রটেছিল। মহিউদ্দিন আবার তার যুক্তি তুলে ধরেছেন এভাবেÑ
যুগ যুগ ধরে মানুষ শুনে আসছে শিরির মুখে এক আজলা পানি তুলে দেয়ার জন্য ফরহাদ বিশাল এক পাথুরে পাহাড় কেটে পানির নহর এনেছেন। হযরত আলীর তরবারির ওজন তিন মণ, তার পুত্র হযরত হানিফা সকালে এক মণ চিড়া খেতেন। সোনাভান যে আলখাল্লা পরে যুদ্ধে নেমেছিলেন তার ওজন ছিল ছয় মণ। শেখ সাদী বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। বায়েজিদ বোস্তামী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন কা'বাতে গিয়ে। অশিক্ষিত মানুষ এসব কল্পকথা বিশ্বাস করে। কেউ তার প্রতিবাদ জানালে তাকে কাফের ঘোষণা করা হয়। মহিউদ্দিন বলতে চাচ্ছেন, এসব যেমন সত্য নয়; পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞও সত্য নয়। তবে, কথা হচ্ছে মহিউদ্দিন যেসব কাহিনীর উল্লেখ করেছেন সেগুলোর পুঁথির কল্পকথা। মানুষ এভাবেই তা নেয়। হয়ত কিছু বিশ্বাস করে। কিন্তু সেগুলো চ্যালেঞ্জ করলে কেউ কাফের ভূষিত হয়েছে শুনি নাই। একবিংশ শতকেও তো কিছু মানুষ বিশ্বাস করেছে, সাঈদী চাঁদে; ১৬ কোটির সবাই তা বিশ্বাস করলে তো সেদিন আর সরকার থাকে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কী করেছে তা রাজাকার আর আল বদর ছাড়া সবাই জানে, বিশ্বাসও করে। মহিউদ্দিন বলছেন, নিজের মা-বোন বা স্ত্রীর ধর্ষিত হওয়ার বা দু'একটি বাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটায় সবার বিশ্বাস হলো যে, ঢাকা শেষ তার মানুষজনও শেষ। ঘটনা আরও বিশ্বাসযোগ্য হলো এ কারণে যে, কিছু কিছু ছাত্র গ্রামে এসে যখন বলল, ইতিহাসে মুসলমান কর্তৃক মুসলমান হত্যার ঘটনা আছে। দিল্লীতে তৈমুর লঙ ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, মুঘলরা পাঠানদের হত্যা করেছে। এবং সবাই মুসলমান। তা' হলে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ৩০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করলে অবিশ্বাসের কী আছে? (সমাপ্ত)
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কিছু নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। আরেকটি গ্রুপও একই ধরনের কাজ করতে থাকে। আর দু'টি গ্রুপকে সহায়তা করছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারত। কারণ, ভারত পাকিস্তানকে ভাঙতে চাচ্ছিল। মহিউদ্দিনের মতে, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ইসলামী রেনেসাঁয় ভীত হয়ে পাকিস্তানের শত্রুকে সহায়তা করছিল।
মহিউদ্দিন এরপর মুসলমান চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, ভারতীয় মুসলমানরা ছিল 'পারভারটেড' তাদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানে ভোট দেওয়ার জন্য। কিন্তু "আমাদের চরিত্র তো ইসলামিক নয়।" খেদ জানিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা মিথ্যাচার করেননি, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সত্যিকারের মুসলমান নয়, তারা হিন্দুদের ছেলেপিলে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষালয়ে হিন্দু শিক্ষকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় হিন্দু দর্শন। হিন্দু গবেষক শিক্ষকরাই বই লেখেন। বাংলা [পূর্ব পাকিস্তান] হচ্ছে একটি জাদুর দেশ..., প্রত্যেক মুসলমান মেয়ে গায়িকা এবং নর্তকী, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ভারস্বরূপ। দেশটি হচ্ছে, সাইক্লোন আর বন্যার দেশ। একটি অভিশপ্ত প্রদেশ। আল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে খুশি নয়। খুশি হলে ঐ এলাকায় এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন হবে?
এ প্রসঙ্গে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। সাধারণ নির্বাচনের [১৯৭০] নোয়াখালীর মাইজদী কোর্টে টাউন হলে তিনি বজ্র কঠিন গলায় বলেছিলেন- "করাচি হয়ে গেছে একটি সোনালী শহর; মরুভূমি রূপান্তরিত হয়েছে সোনালী মরূদ্যানে; ইসলামাবাদ নির্মিত হচ্ছে সোনা দিয়ে। এ সবই করা সম্ভব হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের কারণে। তারা মংলাবাঁধ নির্মাণ করেছে, নির্মাণ করেছে তারবেলা বাঁধ, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছুই না; আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দাবি তুললাম, তখন তারা মানুষকে ইসলামের নামে ভোলাবার জন্য মওদুদীকে পাঠালো।
এরপর মহিউদ্দিন যা লিখেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে তার বক্তব্যটি সঠিক কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানী, তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, কলোনির শোষণ চাপা পড়ে যায়।
তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর এ্যাকশনের কারণে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সাল থেকেই এর শুরু। শহীদ-ই-মিল্লাতকে [লিয়াকত আলী খান] খুন, মওদুদীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ, বাংলাভাষা আন্দোলন, নারায়ণগঞ্জ পাট কারখানা আন্দোলন, কর্ণফুলী কাগজকল আন্দোলন, শিল্পাঞ্চলে সংঘর্ষ, সংবিধান পরিত্যাগ, সামরিক শাসন জারি, মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন, এবডো এবং সর্বশেষে আর্মি এ্যাকশন। এ সব বিষয় বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। বরং তারা একটি শেকলের মতো। এই শেকলটি কালো হাতে কেউ ধরেছিল কিন্তু আমরা সামনে দেখেছি জেড এ ভুট্টো এবং শেখ মুজিবকে। আমরা দেখেছি ডাল রুটি, ডাল ভাতের জন্য তাদের দাবি, তাদের জীর্ণ শালওয়ার, শার্ট, লুঙ্গি বিশ্বাস করেছি তাদের, তাদের শিকার হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে খ-িত করেছি। (পৃ-৮১]
প্রথমেই বলে নেয়া হচ্ছে ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দায়ী নয়, শেষেও একই কথা বলা হচ্ছে। লিয়াকত আলী ও মওদুদীর বিষয়কে একইভাবে দেখা হয়েছে। যদিও দু'টি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। নারায়ণগঞ্জ এবং কাপ্তাইয়ে কারখানায় কোন আন্দোলন হয়নি। হয়েছিল বাঙালী বিহারি দাঙ্গা এবং তা উসকে দিয়েছিল অবাঙালী কর্মকর্তারাই। এখানে পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ আমলাদের চক্রান্ত, কলোনি শাসন, সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য ও নিপীড়ন, জামায়াত-মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। অদৃশ্য কালো হাত যে পাঞ্জাবীদের সেটি বাদ দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইয়াহিয়ার কথা একবারও উল্লেখ নেই। ১৯৭১ জামায়াত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হয়ে কাজ করেছিল।
জামায়াতের মজলিসে শূরার অধিবেশন হলো ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে নোয়াখালী জেলায় সাংগঠনিক সফর করলেন মহিউদ্দিন। কী হবে কী হবে সবাই এ চিন্তায় ব্যস্ত।
ঢাকা জ্বলছে, পূর্ব পাকিস্তান জ্বলছে লিখেছেন মহিউদ্দিন, সবাই উত্তেজিত, কিন্তু মহিউদ্দিনের কোন উত্তেজনা নেই। স্বাভাবিকভাবেই দিন যাপন করছেন যেন কিছুই হয়নি। কর্মীদের শুধু বললেন, রাজনীতির যা-ই হোক না তারা যেন জামায়াতের সঙ্গে বন্ধন শক্তিশালী করে। কী ঘটবে মহিউদ্দিন জানতেন কীনা জানি না। এ সম্পর্কে তিনি কিছু জানাননি। না জানলে ধরে নিতে হবে, রাজাকারের রক্ত অতি ঠা-া। যে কারণে ১৯৭১ সালে তারা ঠা-া মাথায় গণহত্যা করতে পেরেছিল।
॥ ৯ ॥
নোয়াখালী শহরে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে জামায়াত অফিসে মহিউদ্দিন বসেছিলেন। হঠাৎ দেখেন দু'জন অফিসে ঢুকলেন। তাদের দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। এদের একজন হলেন চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব আমির শফিউল্লাহ, তখন জামায়াতের শ্রম সম্পাদক। মহিউদ্দিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন;
'আপনি এখনও এখানে?'
'কেন, কী হয়েছে?'
'কিছু একটা ঘটবে। উঠুন, চলুন লক্ষ্মীপুরে যাই।'
তারপর তিনি ঠিক করলেন কী ভাবে যাবেন। সোজাপথে না গিয়ে তিনি ঠিক করলেন, গ্রামের রাস্তায় রিক্সা করে যাবেন। বিদায় নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন। অর্থাৎ শফিউল্লাহ জানতেন কী হতে যাচ্ছে। মহিউদ্দিন বিকেলে লক্ষ্মীপুর পৌঁছলেন। ২৫ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি লক্ষ্মীপুরে নিজ বাড়িতে ছিলেন। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর 'নির্যাতন' 'নিষ্ঠুরতা'-বিডিআর ও পুলিশদের দমন। বিভিন্ন সেনানিবাসেব বাঙালী পাক সেনাদের আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের কথা শুনেছেন। এখানে লক্ষণীয়, হানাদার বাহিনীর 'নির্যাতন' ও নিষ্ঠুরতা' তিনি বিশ্বাস করেন না।
এবার রাজাকারের দিকের বয়ান শুনুন। তিনি লিখেছেন, "আমি এক শ' ভাগ নিশ্চিত যে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে আর্মি এ্যাকশন হয়েছে। যদি তা না হয় তাহলে যাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছে, তাদের কেন শত্রু বানানো হবে? শত্রু বানানোর কারণ, তাহলে বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হবে, পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেবে এবং এক সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যেখান থেকে ফেরা যাবে না।'
মহিউদ্দিন মনে করেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে গ্রাম, বিভিন্ন শহর ও ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা আশ্রয়ের নামে ভারত চলে যায়। ইকবাল হল ও অন্যান্য হল যা ছিল নেতাদের দুর্গ তা ২৫ মার্চ বিকেলেই খালি হয়ে যায়। শহরে তো লোক বেশি ছিল না। সেগুলোও খালি হয়ে যায়।
বিনা কারণে রাজাকার মহিউদ্দিন বর্ণনা দেননি। এর পরে শুনলে বোঝা যাবে কোন মিথ্যা অনুচ্ছেদটি লেখা হয়েছে। তার ভাষায়, সেনারা খালি হলগুলোতে অভিযান চালায়। ঢাকায় তারা এক বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে যার ফলে আলোর ফুলঝুরি উঠত। এই অস্ত্র ছিল নিরস্ত্রদের ভয় দেখানোর জন্য। মানুষজন হেঁটে গ্রামের দিকে রওনা দিল। হ্যাঁ, কিছু মানুষ মারা গেছে কিন্তু তা পরিকল্পনার বোকামির কারণে। কিন্তু সেই বোকামি নিরস্ত্র মানুষের না সশস্ত্র পাকিদের তা লিখতে ভুলে গেছেন মহিউদ্দিন। তিনি লিখছেন, না বোকামি বলব না বরং বলব চতুর। রেল লাইনের পাশে যদি গরিব শ্রমিকদের কয়েকজন মারা যায় বা গ্রেফতার করা হয়। তা হলে নিশ্চিতভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। যদি হিন্দু এক দার্শনিক অধ্যাপক মারা যায়, তা হলে পুরো হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবে, যার অজুহাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটেছিল। এতক্ষণে বোঝা গেল, মহিউদ্দিন প্রথমে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের রেফারেন্স দিচ্ছেন। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীরা চতুরতার সঙ্গে এই কাজ করেছিল যাতে বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হয় ভারত ক্ষুব্ধ হয়। বলিহারি রাজাকারের কল্পনা শক্তি।
২৫ মার্চ ও তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিবরণ যেভাবে মহিউদ্দিন দিয়েছেন তাতে মনে হতে পারে মার্চ-এপ্রিলে যা ঘটেছে বলে প্রকাশিত হয়েছে আসলে তা গুজব। লিখেছেন তিনি, 'একদিন সকালে একলা গ্রামের রাস্তা ধরে ভবানিগঞ্জ যাচ্ছিলাম। এক লোকের সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। তিনি বললেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে আসছি। হাজার হাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ একইভাবে খাওয়া-পানি ছাড়া হেঁটে আসছে। চাঁটগায় পাঞ্জাবীরা লাখ লাখ হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।'
'এ সময় দেখলাম জাতিসংঘের একটি গাড়ি আসছে। হাত তুলে থামালাম। চালক বিদেশী। আমি তাকে অনুরোধ জানালাম, ঐ লোককে গাড়িতে একটা লিফট দিতে যার মতে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, চাঁটগায়ে লাখ লাখ লোক মারা গেছে, পাঞ্জাবী সৈন্যরা হেরে গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জিতছে এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছে।' (পৃ. ৮৫]
২৫ মার্চ গণহত্যা নিয়ে বেশ একটা ব্যঙ্গ করা হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও লক্ষ্য করুন। দু'টি অনুচ্ছেদে নিজে নিজেই শব্দের মানে বদলে ফেলেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পাঞ্জাবীরা হত্যা করছে, পরাজিত হয়েছে এমন কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কথা নেই, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তার উল্লেখ নেই।
১৫ এপ্রিল তিনি খবর পেলেন তার দূর সম্পর্কের এক শ্যালক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। মহিউদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তারপরও মহিউদ্দিন যেচে গেলেন সেখানে। তাকে দেখা মাত্র বোঝা গেল শ্যালক ক্ষুব্ধ হলেন, যদিও মুখে কিছু বললেন না। তাকে স্বাগতও জানালেন না। মহিউদ্দিন বসা মাত্র শ্যালক পাকিস্তানী সৈন্যরা যে হত্যা লুট অগ্নিসংযোগ করছে তার কয়েকটি ঘটনা বললেন। মহিউদ্দিন খান বলেছেন, এসব গুজব, প্রোপাগা-া।'
এটি শোনা মাত্র মহিউদ্দিনের ভাষায় শ্যালক তাকে আমার্জিত ভাষায় গালাগাল করে বললেন, 'আমার বাড়ি থেকে বের হও রাস্কেল, পাঞ্জাবী এজেন্ট, বের হও ইত্যাদি।'
মহিউদ্দিন পরে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, এরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ কী? সেই একই কৌশল। তার জামাই ঢাকায় কোন এক জায়গায় কেরানির কাজ করে। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি রওনা হয়েছিল। তিনদিন হেঁটে বাড়ি পৌঁছে সে জানিয়েছে, ঢাকা ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। সব হিন্দু এবং প্রায় সব আওয়ামী লীগারকে মেরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গায়। রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামেও একই ঘটনা ঘটেছে। হাজার হাজার লোক ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে এ ধরনের প্রচার করছে। তারা এমনভাবে বলছে যেন সব ঘটনা তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে।
এরই সূত্র ধরে মহিউদ্দিন জানাচ্ছেন, এ ধরনের শত শত গল্পগাছা তখন পল্লবিত হয়েছে। মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। পাকিস্তানের শত্রুরা এতে সফল হয়েছে। এই ধরনের একটি কাহিনীর তিনি উল্লেখ করেছেন।
"টিক্কা খান নয়ফুট লম্বা এবং তিন ফুট পাশে। দিনে তিনি তিন কিলো মানুষের রক্ত পান করেন, সকালের নাস্তায় তিনি মানুষের মগজ খান। তিনি বলেছেন, আমি সব বাঙালীকে হত্যা করব। আমি মাটি চাই মানুষ চাই না।"
ঐ সময়ে এ ধরনের কাহিনী আমি শুনিনি। শেষ বাক্যটি সত্য। ঐ বাক্যটি ইচ্ছে করে দেয়া হয়েছে যাতে মানুষের মনে হয় এ ধরনের গুজব রটেছিল। মহিউদ্দিন আবার তার যুক্তি তুলে ধরেছেন এভাবেÑ
যুগ যুগ ধরে মানুষ শুনে আসছে শিরির মুখে এক আজলা পানি তুলে দেয়ার জন্য ফরহাদ বিশাল এক পাথুরে পাহাড় কেটে পানির নহর এনেছেন। হযরত আলীর তরবারির ওজন তিন মণ, তার পুত্র হযরত হানিফা সকালে এক মণ চিড়া খেতেন। সোনাভান যে আলখাল্লা পরে যুদ্ধে নেমেছিলেন তার ওজন ছিল ছয় মণ। শেখ সাদী বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। বায়েজিদ বোস্তামী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন কা'বাতে গিয়ে। অশিক্ষিত মানুষ এসব কল্পকথা বিশ্বাস করে। কেউ তার প্রতিবাদ জানালে তাকে কাফের ঘোষণা করা হয়। মহিউদ্দিন বলতে চাচ্ছেন, এসব যেমন সত্য নয়; পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞও সত্য নয়। তবে, কথা হচ্ছে মহিউদ্দিন যেসব কাহিনীর উল্লেখ করেছেন সেগুলোর পুঁথির কল্পকথা। মানুষ এভাবেই তা নেয়। হয়ত কিছু বিশ্বাস করে। কিন্তু সেগুলো চ্যালেঞ্জ করলে কেউ কাফের ভূষিত হয়েছে শুনি নাই। একবিংশ শতকেও তো কিছু মানুষ বিশ্বাস করেছে, সাঈদী চাঁদে; ১৬ কোটির সবাই তা বিশ্বাস করলে তো সেদিন আর সরকার থাকে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কী করেছে তা রাজাকার আর আল বদর ছাড়া সবাই জানে, বিশ্বাসও করে। মহিউদ্দিন বলছেন, নিজের মা-বোন বা স্ত্রীর ধর্ষিত হওয়ার বা দু'একটি বাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটায় সবার বিশ্বাস হলো যে, ঢাকা শেষ তার মানুষজনও শেষ। ঘটনা আরও বিশ্বাসযোগ্য হলো এ কারণে যে, কিছু কিছু ছাত্র গ্রামে এসে যখন বলল, ইতিহাসে মুসলমান কর্তৃক মুসলমান হত্যার ঘটনা আছে। দিল্লীতে তৈমুর লঙ ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, মুঘলরা পাঠানদের হত্যা করেছে। এবং সবাই মুসলমান। তা' হলে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ৩০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করলে অবিশ্বাসের কী আছে? (সমাপ্ত)
প্রকাশ :মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ৬ ফাল্গুন ১৪২০
এক রাজাকারের আত্মজীবনী (১-২)
মুনতাসীর মামুন
প্রকাশ : বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ৩০ মাঘ ১৪২০
এক রাজাকারের আত্মজীবনী (৩ - ৪ )
মুনতাসীর মামুন
প্রকাশ : বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১ ফাল্গুন ১৪২০
এক রাজাকারের আত্মজীবনী (৫ - ৭)
মুনতাসীর মামুন
প্রকাশ : শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ২ ফাল্গুন ১৪২০
এক রাজাকারের আত্মজীবনী (৭ - ৮)
মুনতাসীর মামুন
প্রকাশ : শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ৩ ফাল্গুন ১৪২০
__._,_.___