বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল—১৭
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নজরুলকে ব্যবহার
বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঠেকাতে পাকিস্তানি সরকার ও মুসলিম লিগের রটনাবিদেরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলিম কবি বিবেচনায় নজরুল ইসলামকে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের সূচনাকে তারা সুনজরে দেখেনি। এই মানসিকতা থেকেই ঢাকায় নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
১৯৬৭ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন মার্কিন কনসাল ডরিস ভার্জিনিয়া মেটকাফ ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় ওই মন্তব্য করেছিলেন।
তিনি উল্লেখ করেন যে বাঙালিদের বিরুদ্ধে মুসলিম লিগের ওই মিশন ছিল উচ্চাভিলাষী। কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে শেক্সপিয়ার-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-ইয়েটস-গ্যেটের দলভুক্ত মনে করেন। অন্য দিকে নজরুলকে তাঁরা মনে করেন জর্জ এম কোহেন এবং আরভিং বার্লিনদের (এই দুজনই মার্কিন লেখক ও গীতিকার) দলভুক্ত। যদিও নজরুল মুসলমান হয়েও পাকিস্তান সমর্থন করেননি। তিনি তাঁর হিন্দু স্ত্রীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন।
মার্কিন কনসালের বর্ণনায়, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ব্যাপক উদ্দীপনায় নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা। ২৪ সেপ্টেম্বরে মুসলিম লিগের নেতা খান এ সবুরকে একাডেমির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। অথচ তিনি কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নন এবং সাহিত্যে তাঁর অনুরাগও নেই।
মেটকাফ তাঁর ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন যে খান এ সবুর বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। ১৬ আগস্ট খুলনায় তিনি বলেছেন, দীর্ঘ ২০ বছর পরে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে একদল বুদ্ধিজীবী নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে, যারা কতিপয় কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি বিদেশি সংস্কৃতির বিজয় দেখতে চাইছে। এই মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী পাকিস্তান সৃষ্টির আদর্শগত যৌক্তিকতাকে নাকচ করার চেষ্টা করছেন।
মার্কিন কনসাল উল্লেখ করেন যে '১৯৪৮ সালের ৯ মে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে জনমত গঠন শুরু হয়, তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার। তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উদ্যাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশের সূচনা ঘটে। এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে মুসলিম লিগের অবাঙালি নেতারা মৌখিকভাবে আক্রমণ করেছিলেন। আর এই ঘটনা নিয়ে মুসলিম লিগ নেতাদের মধ্যে প্রথম চিড় ধরেছিল। ১৯৪৮ সালের ৯ মের পর থেকে ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের নানা জায়গায় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হয়ে আসছে।'
ডরিস মেটকাফের ভাষায়, '১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যখন বামপন্থীদের নেতৃত্বে ছাত্ররা ঢাকায় দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল, তখন সরকারকে তারা একটি প্রতিশ্রুতি প্রদানে বাধ্য করে যে বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। সেই থেকে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো বাংলা ভাষাকে জাতীয়করণ করা এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে।'
এ প্রসঙ্গে মার্কিন কনসাল আরও মন্তব্য করেন যে '১৯৫৫ সালে তরুণ রাজনীতিক নুরুল হুদা বুলবুল ললিত কলা একাডেমি (বাফা) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। হুদাকে এ কাজে যাঁরা আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার তাঁদের অন্যতম। ১৯৪৮ সালে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন বাংলা ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছিল।'
১৯৬৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে আরেকটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন কনাসল স্কয়ার্স। পূর্ব পাকিস্তান সফররত ২৪ সেপ্টেম্বর আইয়ুব খান হোটেল ইন্টারকনে নজরুল একাডেমি আয়োজিত সংগীত ও নৃত্যসন্ধ্যা উপভোগ করেন। তিনি ৫০ হাজার রুপি অনুদান দেন।
মার্কিন কনসাল মন্তব্য করেছিলেন যে 'এক বছর আগে আইয়ুব সরকার বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও নজরুল হিন্দু বিয়ে করেছেন। তিনি বাঙালি কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বসূরি সংগঠনকে সহায়তা দিয়েছেন। দেশভাগের বিরোধিতা করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ভারতে থেকে গেছেন। এখন কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় কলকাতার কাছে বসবাস করছেন। কবি নজরুল আসলে স্থানীয় মুসলিম লিগের কাছে বিড়ম্বনার উৎস। কারণ, তিনি সর্বদাই মুসলিম লিগের বিরোধিতা করেছেন।
__._,_.___