সন্দেহের তীর উগ্রপন্থী দুই সংগঠনের দিকে
সাজ্জাদ মাহমুদ খান
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকান্ডে ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক বিরোধ খুঁজে পাননি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মতাদর্শগত বিরোধকে সামনে রেখে তদন্ত চলছে। যারা ফারুকীর মতাদর্শ নিয়ে অনলাইনে সরব ছিল তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এই তালিকায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসারুস সুন্নাহ নামে দুটি উগ্রপন্থী দলের নাম উঠে এসেছে। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত হত্যাকা-ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
২৭ আগস্ট রাত সোয়া ৯টার দিকে রাজধানীর ১৭৪, পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় স্বজনদের আটকে রেখে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ফারুকী হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে এমন সব বিষয়ই খতিয়ে দেখছে পুলিশ। হত্যাকান্ডের মোটিভ ও হত্যাকারী সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ফারুকীর মতাদর্শের বিরুদ্ধে অনলাইনে সরব ছিল দুই উগ্রপন্থী দল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসারুস সুন্নাহ। এই দুটি দল তাদের নিজেদের ওয়েবসাইটে ফারুকীকে বেদাতপন্থী ও কুফুরি আকিদাপন্থী বলে আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে। ফারুকী হত্যাকান্ডের সঙ্গে এই দুটি দলের যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য যারা অনলাইন ব্লগ, ইউটিউব ও ফেসবুকে মাজারের পূজারি, দজ্জাল, খাজাবাবাসহ বিভিন্ন নামে অপপ্রচার চালিয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
উগ্রপন্থী দলের একাধিক ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা গেছে, তারা ফারুকীকে বেদাতপন্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। আনসারুস সুন্নাহর একটি ফেসবুক পেজে লেখা রয়েছে- 'নুরুল ইসলাম ফারুকী ভ্রান্ত বেরেলবি মতবাদের প্রচারক ছিলেন, তিনি কবর-মাজার ওয়ালাদের শিরকি কাজকর্মকে অলি-আউলিয়াদের ভালোবাসার নাম দিয়ে সাফাই গাইতেন। তিনি কট্টর মাজারপন্থী ছিলেন। এছাড়া তিনি সহিহ আকিদার আলেমদের ওহাবি, লা মাজহাবি ইত্যাদি বলে গালাগাল করতেন। আমরা তাকে বেদাতপন্থী হিসেবেই জানি।' এছাড়া এই সংগঠনটি ফারুকীকে মানসুর হাল্লাজের অনুসারী বলে আখ্যায়িত করে। তাদের মতে, মানসুর হাল্লাজ একজন মুরতাদ। আনসারুস সুন্নাহর মতে, ফারুকী 'ফানাফিল্লাহ' মতবাদেরও প্রচার করতেন, যা আনসারুস সুন্নাহর মতে শিরকি ও কুফুরি কাজ। আনসারুস সুন্নাহ এই মতবাদের কট্টর প্রতিবাদ করে প্রচার চালায়। তাদের ভাষ্য, ফারুকীর মতো সেলিব্রিটি মাওলানারা ইসলামের অনেক ক্ষতি করছে। এজন্য তাদের 'বাতিল' হিসেবে ঘোষণাও করেছে তারা।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অনুসারীরা কিয়ামত পর্যন্ত অসি অর্থাৎ তরবারি দিয়ে জিহাদ করতে হবে বলে মনে করে। এ কারণেই তারা কখনও আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও তা ব্যবহার করে না। তারা চাপাতিকে তরবারি হিসেবে ব্যবহার করে। হামলাকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, কিন্তু তারা তা ব্যবহার করেনি। গত বছর আগস্ট মাসে খুলনায় নতুন মতাদর্শ প্রচারকারী মুসলিম উম্মাহর প্রধান ও তার ছেলে এবং গোপীবাগের সিক্স মার্ডারের ঘটনায়ও ঘাতকদের হাতে অস্ত্র ছিল কিন্তু তারা ব্যবহার করেনি। গলা কাটার সময় ঘাতকরা ফারুকীকে বলেছিল- তুই অনেক 'বেদাতি' ও 'শিরকি' কাজ করেছিস। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, আনসারুল্লাহর প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানীসহ অল্প কিছু লোককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হলেও তাদের বিরাট অংশ এখনও সক্রিয়। তাদের কেউ এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। প্রয়োজনে জসিম উদ্দিন রাহমানী ও তার সহযোগীদের নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
'পীর-আউলিয়াদের পক্ষে কথা বলায় ফারুকী হত্যা'
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নেতারা বলেছেন, পীর-আউলিয়া এবং তাদের প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলোর পক্ষে কথা বলার কারণেই ফারুকীকে হত্যা করা হয়েছে। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো বারবার হুমকি দিয়ে তাকে আদর্শিক জিহাদ থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে নির্মমভাবে জবাই করে সফল হয়েছে তারা। মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘি ময়দানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সমন্বয় কমিটি আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে নেতারা এ কথা বলেন।
সমাবেশ থেকে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক টিভি চ্যানেল পিস টিভি বন্ধ করতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। বক্তারা বলেন, খুনিরা দ্রুত গ্রেফতার না হলে তীব্র আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান নেতারা। এ সময় ফারুকী হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৪ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর দেশের পীর মাশায়েখ, ওলামায়ে কেরাম ও সুন্নি সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় এবং অভিমত সংগ্রহ, ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ওলামা মাশায়েখ পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি সম্মেলনের ঘোষণা দেয়া হয় । আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমীর সভাপতিত্বে সংগঠনের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার ও মাওলানা সউম আবদুস সামাদের সঞ্চালনায় এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের খতিব অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দিন আল কাদেরীসহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতারা।
http://www.alokitobangladesh.com/last-page/2014/09/03/94188
|
__._,_.___