Banner Advertiser

Tuesday, September 2, 2014

[mukto-mona] আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের চারটি স্তম্ভ - ওয়াহিদ নবি



বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ১৯ ভাদ্র ১৪২১
আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের চারটি স্তম্ভ
ওয়াহিদ নবি
এই লেখাটির প্রথম অংশ ছাপা হয়েছে ২৭ আগস্ট। আজ শেষ অংশ ছাপা হলো।
গণতন্ত্র
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিরূপণ সহজ নয়। তাই বিজ্ঞজনেরা কি বলেছেন তা আমরা উল্লেখ করব। দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, 'সবাই প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন সবার মধ্য থেকে কয়েকজনকে।' পেরিক্লিস বলেছিলেন, 'আমাদের দেশকে গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয় এই জন্য যে, শাসনক্ষমতা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে নয়, অনেকের হাতে।' গণতন্ত্র সম্বন্ধে আব্রাহাম লিংকনের উক্তি সর্বজন পরিচিত, 'জনগণের জন্য, জনগণের এবং জনগণের দ্বারা।' 
গণতান্ত্রিক মানসিকতার ভেতরে রয়েছে কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু ধারণা ও কিছু বিশ্বাস। গণতন্ত্রের আবির্ভাবে জনগণ একটা পরিবর্তনের আস্বাদ পায়। এমনকি গণতন্ত্র আসার আগেই মানুষ এই স্বাদ পেয়ে থাকে। আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা একটু ভিন্ন অবস্থা দেখতে পাই। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলন শুরু হয়। সামরিক শাসনের একগুঁয়েমির জন্য গণতন্ত্রের এই আন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়। দেশ স্বাধীন হলে স্বাধীনতার আস্বাদটা এত বিশালভাবে অনুভূত হয় যে গণতন্ত্রের স্বাদটা গৌণ হয়ে যায়। ফরাসী দার্শনিক এলেক্সি টকভিল বলেছিলেন, 'জনগণের মত নিয়ে শুধু নয়, জনগণের দ্বারা গণতন্ত্র অর্জন করতে হবে।' 
সমাজের বিভিন্ন অংশের সমন্বিত কার্যকলাপ প্রয়োজন হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। গ্রিসের গণতন্ত্র বিকাশে পোলিস গঠন খুব সাহায্য করেছিল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিয়ে গঠিত পোলিসগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণীর কার্যকলাপ ছিল সমন্বিত। তাদের মধ্যে ছিল সহযোগিতার মনোভাব। জনগণের যদি ধারণা থাকে প্রশাসন সম্বন্ধে এবং যদি ধারণা থাকে প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে তবে গণতন্ত্র বিকাশে সুবিধা হয়। স্থানীয় সরকারের সক্রিয়তা তাই বিশেষভাবে সাহায্য করে। 
কর্তৃপক্ষ সম্বন্ধে গণতান্ত্রিক মানুষের ধারণা প্রভু-ভৃত্যের মতো নয়। গণতন্ত্রে কর্তৃপক্ষের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয় না। কিছুদিনের জন্য তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় জনগণের সেবা করার জন্য। গণতন্ত্রে কর্তৃপক্ষ জনগণের প্রতিনিধি। গণতন্ত্রে মানুষ বিমূর্ত ধারণায় অভ্যস্ত। সমতা বলতে সব নাগরিকের সমতা বোঝায় না সব ব্যাপারে। গণতন্ত্রে সবার সমান সুযোগ সুবিধা রয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান। স্বাধীনতা বলতে এটা বোঝায় না যে সবার যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা রয়েছে। গণতন্ত্রে বাক-স্বাধীনতা রয়েছে। রয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। কিন্তু জনগণ বুঝে যে স্বাধীনতা তখনই মানুষ উপভোগ করতে পারে যখন তাদের দায়িত্ববোধ থাকে। 
গণতান্ত্রিক মন যুক্তিতে বিশ্বাসী। আমাদের পৃথিবী সব সময়ই বদলাচ্ছে। যুক্তি আমাদের সাহায্য করে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। যুক্তি আমাদের সাহায্য করে বিভেদের মাঝে একতা খুঁজে নিতে। যুক্তিসম্পন্ন মানুষ নমনীয়। ইউরোপের ইতিহাসে দেখা যায় যে কৃষিভিত্তিক সমাজের চেয়ে রেনেসাঁপরবর্তী শিল্পভিত্তিক সমাজ অধিকতর নমনীয়। 
অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার মানুষ গোপালকে নির্বাচিত করেছিল দেশ শাসন করার জন্য। দেশে চলমান অরাজকতা দূর করার জন্য দেশবাসী এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে বাংলার একটা স্থান রয়েছে, যদিও সেদিনের গণতন্ত্রের চরিত্র ছিল ভিন্ন। পাল বংশের পরে বাঙালীর হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব আসে ১৯৭১ সালে। এককথায় বাংলা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭১ সালে। বাংলায় গণতন্ত্র প্রথম আসে ১৯৭১ সালে। অর্থাৎ স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র বাঙালীরা প্রথম উপভোগ করে ১৯৭১ সালে। এরপর দুই সেনানায়ক দেশ শাসন করে ১৫ বছর ধরে। তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের গণতন্ত্রের বয়স মাত্র ২৫ বছর। একজন মানুষের জীবনে ২৫ বছর দীর্ঘ সময় মনে হলেও একটা জাতির ইতিহাসে এই সময়টা দীর্ঘ নয়। এই সময়টার কথা চিন্তা করতে হবে অন্যান্য দেশের গণতন্ত্র বিকাশের সময়কালের কথা চিন্তা করে। আমাদের অগ্রগতি কিছু হয়েছে, কিছু হয়নি। গণতন্ত্রের সমস্যা দেখলেই অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে দেশ তুলে দেবার চিন্তা আমাদের পরিহার করতে হবে। সমস্যা থাকলে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। 
একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছিলেন যে, অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা লাভ করা উচিত। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। 'জাভেডি বারবু' তাঁর 'ডেমোক্র্যাসি এ্যান্ড ডিক্টেটরশিপ' গ্রন্থে বলেছেন যে, গণতন্ত্র বিকাশের জন্য দেশে একটা বিরাজমান স্থিতিশীল অবস্থা প্রয়োজন। আমাদের গণতন্ত্র আসার আগে আমরা একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও তারপর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের পর স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে আসার আগেই আমাদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব নিতে হয়। গ্রিস, ব্রিটেন ও আমেরিকায় স্থিতিশীল অবস্থায় গণতন্ত্র আসে। কিন্তু গণতন্ত্র আসার আগে ফ্রান্সে স্থিতিশীল অবস্থা ছিল না বলেই অনেকের বিশ্বাস। কিন্তু টকভিলের মতে এই ধারণা ঠিক নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের এবং আমলাদের দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাদের দেশে চলছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, যা গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল নয়। এ সবের কারণ আমাদের দীর্ঘদিনের পরাধীনতা। আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তৃণমূল থেকে গণতন্ত্র বিকশিত হতে হবে, না হলে সংসদীয় গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হবে না। আমাদের নিজেদের মানসিকতা উন্নত করা প্রয়োজন সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য। প্রকৃত শিক্ষা গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল। দীর্ঘদিনের পরাধীনতার জন্য আমাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠেনি। আমরা অন্যের কাজে খুব উঁচু মান আশা করি। নিজের কাজ সম্পর্কে চিন্তা করি না। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে দৈবের ওপর আমাদের আস্থা অনেক বেশি। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য আরও তিনটি আদর্শিক স্তম্ভের বিকাশ প্রয়োজন। জাতীয়তাবোধ, পার্থিব চিন্তা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র একসূত্রে বাঁধা। 
সমাজতন্ত্র 
সমাজতন্ত্র একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি। সমাজতন্ত্র একটি রাজনৈতিক আদর্শ। একটি জীবনব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের জন্য সমাজতন্ত্র কল্যাণ বয়ে আনবে এই আশাতেই প-িত ব্যক্তিগণ এই আদর্শের কথা ভেবেছেন। সমাজতন্ত্রের অনেক দিশারী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেকে চরম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বার্থান্বেষীরা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। এমনটা সারা পৃথিবীতেই ঘটেছে। আমাদের দেশের কথা ভাবা যাক। বহু বছর থেকেই সমাজতন্ত্র আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি। কিন্তু অতি দ্রুত পদোন্নতি লাভ করা সেনাকর্তা ক্ষমতা দখল করার পর শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন পরিবর্তনের সময় সমাজতন্ত্র শাসনতন্ত্র থেকে গায়েব করে দিলেন। এটা তিনি করলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের খুশি করে নিজের ক্ষমতা দৃঢ় করার জন্য। কাজেই সেখানে তাঁর বসানো 'সামাজিক ন্যায় বিচার' কথাটা একটা রসিকতার মতো শোনায়। সমাজতন্ত্র কর্মজীবী মানুষের মুক্তির সোপান। সেনা কর্তা 'মুক্তি' কথাটাও শাসনতন্ত্র থেকে মুছে দেন। যিনি সার্বিকভাবে মুক্তির বিরোধী তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে হবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু স্বার্থান্বেষীরা সমাজতন্ত্রের নামে সব সময়েই অবান্তর সব কুৎসা রটাচ্ছে তাই সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা হওয়া উচিত সাধারণের মন থেকে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার লক্ষ্যে। 
পুঁজিবাদ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখি। উৎপাদনের মাধ্যম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মানুষের হাতে চলে যায়। এর কারণ হচ্ছে বড় মাছগুলো ছোট মাছগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলে। পুঁজিবাদের লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা। তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো তাই সাধারণ মানুষের ব্যবহারের লক্ষ্যে বা প্রয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুত হয় না। নানা রকমের চোখ ধাঁধানো পণ্য তাই বাজার ছেয়ে ফেলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে খাদ্যদ্রব্যের মান উন্নয়ন না করে এমন কি ভেজাল মিশাল দিয়ে নিকৃষ্ট খাবার তৈরি করে। তারপর ওরা প্রসাধনদ্রব্য প্রস্তুত করে বিজ্ঞাপনের চোখ ধাঁধানো ব্যবহারে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। জাতীয় জীবনে এর প্রতিফলন আমরা কি দেখি? রেল স্টেশনগুলোর করুণ অবস্থা চোখে পড়লেও বিউটি পার্লারগুলোর চাকচিক্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
চাকরির জন্য সাধারণ মানুষ সব সময়েই চিন্তিত থাকে। কারখানাগুলোর মালিকানা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে চলে গেলে সাধারণ মানুষের জীবিকা এদের করুণার ওপরে নির্ভর করে। শ্রমিকদের বেতন তারা যত কম দেবে ততই তাদের মুনাফা বাড়বে। এদিকে চাকরির সংখ্যা কম হলে সাধারণ মানুষ চাকরি হারানোর ভয়ে ভীত থাকবে। তাদের দাবিদাওয়া উচ্চকণ্ঠে ধ্বনিত হবে না। এদের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাবে। ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' উপন্যাসে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার করুণচিত্র ফুটে উঠেছে। এমনি করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে ডিএইচ লরেন্সের বর্ণনায়। আমাদের দেশের বস্তিগুলোর মানবেতর চিত্র আমাদের অজানা নয়। 
পুঁজিবাদী ধনিকগোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে বাজার খোঁজার জন্য বিদেশের দিকে বদ নজর দিয়েছিল, যার ফলে ঔপনিবেশিকতার জন্ম হয়েছিল। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিল অনগ্রসর দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে দু'টি বিশ্বযুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। 'পুঁজিবাদী দেশগুলোর অর্থনৈতিক নৈরাজ্যই হচ্ছে আমার মতে সমস্ত অমঙ্গলের কারণ।' এই কথাটি কোন সমাজতান্ত্রিক বা কোন সাম্যবাদী নেতা বলেননি। এই কথাটি ১৯৪৯ সালে 'মান্থলি রিভিউ' পত্রিকায় 'হোয়াই সোস্যালিজম' নামে একটি প্রবন্ধে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন লিখেছিলেন। 
পুঁজিবাদের শোষণে কর্মজীবী মানুষের দুরবস্থা দেখে সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করেন কল্যাণকামী মানুষেরা। সমাজতন্ত্র অনুযায়ী উৎপাদনের মাধ্যমের মালিকানা জনগণের হাতে রাখা উচিত বলে বিবেচনা করা হয় কিংবা সমবায় পদ্ধতিতে উৎপাদনের মাধ্যমগুলোকে পরিচালিত করা উচিত বলে মনে করা হয়। মানুষের কাজে লাগে এমন সব জিনিসের উৎপাদনের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করা হয়। উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাত করার পর যে মুনাফা অর্জিত হবে তা আবার মানুষের উপকারে ব্যয় করা হবে বলে সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন। সমাজে শ্রেণী বিভাগের ফলে মানুষে মানুষে তারতম্য যেন ভীষণ আকার ধারণ না করে। যারা উৎপাদন করবে পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে তাদের যেন ভূমিকা থাকে। 
ফরাসী দেশের কাউন্ট হেনরি দ্য সেইন্ট-সাইমন সমাজতন্ত্র কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন। 'লেটারস ফ্রম এ্যান ইনহ্যাবিট্যান্ট অব জেনেভা টু হিজ কনটেমপোরারিজ' নামে একটি প্রবন্ধে তিনি সমাজের তিনটি শ্রেণীর মানুষের কথা উল্লেখ করেন। বৈজ্ঞানিক, লেখক, শিল্পী প্রভৃতি সৃজনশীল ব্যক্তিদের তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে অভিহিত করেন। মালিক শ্রেণীকে তিনি ফরাসী বিপ্লবের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করার উপদেশ দেন। কর্মীদের তিনি জ্ঞান আহরণের উপদেশ দেন। 
সমাজতন্ত্র কি করে প্রবর্তন করা উচিত বা কি করে কার্যকর করা উচিত এ নিয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারা রয়েছে। রবার্ট ওয়েন ঊনবিংশ শতাব্দীতে 'আদর্শ সমাজতন্ত্র' প্রবর্তন করার চেষ্টা করেন। তিনি ধনতান্ত্রিক সমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে সমাজতান্ত্রিক কমিউন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। 'সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা' গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন। কেউ কেউ মনে করেন যে বিপ্লব ছাড়া সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়। 
ধর্মনিরপেক্ষতা 
কালের আবর্তে একটি বিশেষ চিন্তাধারা যখন গতি হারিয়ে স্থবিরতার শিকার হয় তখন নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব হয়। পুরনো চিন্তাধারার ধারক ও বাহকেরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা বোঝাার চেষ্টা না করে নতুন চিন্তাধারার প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব গ্রহণ করে। অনেক সময় নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য তাঁরা পশ্চাৎমুখী চিন্তাধারাকেই আঁকড়ে ধরে থাকেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে রক্ষণশীলদের আচরণ আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে। ইতিহাসে এই জাতীয় ঘটনার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। 
আরবের রক্ষণশীল দার্শনিক ইবনে গাজালি মুক্তচিন্তার অধিকারী দার্শনিকদের আক্রমণ করে 'ইনকোহারেন্স অব দ্য ফিলোসফার্স' নামে একটি বই লেখেন। এর উত্তরে স্পেনের মুসলমান দার্শনিক ইবনে রুশদ 'ইনকোহারেন্স অব দ্য ইনকোহারেন্স' নামে একটি বই লেখেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, এ বইটির মাধ্যমে ইবনে রুশদ পার্থিব চিন্তাধারা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। ইবনে গাজালি ও ইবনে রুশদের মসিযুদ্ধ প্রধানত দর্শনশাস্ত্রের চর্চা সম্বন্ধে। কিন্তু ইবনে রুশদের লেখায় ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা ফুটে ওঠে। যদিও প্রাচীন দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস বা প্রোটাগোরাস প্রমুখের লেখায় পার্থিব চিন্তাধারা প্রকাশ পেয়েছিল কিন্তু ইবনে রুশদ প্রথম স্পষ্টভাবে পার্থিব চিন্তাধারা প্রকাশ করেন। 
রক্ষণশীল চিন্তাধারার মানুষেরা যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে ইউরোপের ইতিহাসের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে কপার্নিকাস আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু বাইবেলের শিক্ষা বিপরীত। কপার্নিকাস জীবিতকালে ধর্মযাজকদের ভয়ে তাঁর আবিষ্কার প্রকাশ করতে সাহস করেননি। গ্যালিলিও এই সত্য প্রকাশ করায় ধর্মযাজকদের রোষানলে দগ্ধ হন। কারান্তরালে তাঁর মৃত্যু হয়। স্পেনের বৈজ্ঞানিক মাইকেল সার্ভেটাস মানুষের রক্তসঞ্চালন প্রণালী ব্যাখ্যা করেন। ধর্মান্ধরা তাঁকে পুড়িয়ে মারে। জিওরডিনো ব্রুনো সূর্যকে অনেক নক্ষত্রের একটি বলে বর্ণনা করেন। ধর্মযাজকরা বিশ্বের বিশালতার কথা বুঝতে পারেনি। তারা ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারে। সত্য বলার অপরাধে ডারউইনকেও কম নাজেহাল হতে হয়নি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আজ আমরা দেখি পার্থিব চিন্তাধারার অনুসারী মহাপুরুষদের খুঁজে পাওয়া তথ্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে আর ধর্মান্ধরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বে¡ও কোন কোন দেশে প্রতিক্রিয়াশীলরা চোখ রাঙিয়ে বেড়াচ্ছে। ইতিহাসের অগ্রগতিকে বাধা দিচ্ছে। নিজেদের জন্মভূমিকে পিছিয়ে রাখছে জ্ঞানের অগ্রযাত্রায়।
'সেক্যুলারিজম' কথাটি প্রচলন করেন বিলাতের দার্শনিক জর্জ জ্যাকব হলিওক। তিনি ছিলেন 'এগনিস্টিসিজম' আদর্শের অনুসারী। এই আদর্শের প্রবক্তা হ্যাক্সলি বিশ্বাস করতেন যে, এই আদর্শ একটি প্রক্রিয়া, যার দ্বারা একটি মতামতের সত্যাসত্য যাচাই করে নেয়া যায়। হলিওক বলেছিলেন যে সেক্যুলারিজম খ্রীস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। তাঁর মতামত ধর্ম থেকে স্বাধীন। সত্যের অগ্রগতি সেক্যুলারিজমের উদ্দেশ্য। সত্যকে জানার আর কোন পথ নেই-এ কথা তিনি বলেননি। কিন্তু সত্যকে জানার একটি পথ যে সেক্যুলারিজম সে কথা তিনি বলে গেছেন।
আমরা মনে করি যে সেক্যুলার শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি বেছে নেয়া ঠিক হয়নি। এর ফলে মুক্তচিন্তার বিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে। এই অপপ্রচারের সামনে মুক্তচিন্তার অধিকারীরা অসহায় বোধ করেছেন। তাঁরা স্বাধীনভাবে খোলামেলাভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারেননি। এইসব কারণে অগ্রগতির আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বিকশিত হচ্ছে না। আমরা পরমুখাপেক্ষী থেকে যাচ্ছি। পার্থিব চিন্তার বিরোধীরা পার্থিব দেশের আবিষ্কৃত জিনিস ব্যবহার করছেন ঠিকই কিন্তু নিজের দেশে পার্থিব চিন্তার বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে নিজের দেশকে পিছিয়ে রাখছেন। 
পার্থিব চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটে ইতালিতে রেনেসাঁস (ৎবহবংংধহপব) শুরু হবার পর। রেনেসাঁস শুরু ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে চতুর্দশ শতাব্দীতে। রেনেসাঁসের পথিকৃৎ ফ্রানসেস্কো পেট্রার্ক। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। রেনেসাঁস ইউরোপের সাংস্কৃতিক জীবনে নবজাগরণ নিয়ে আসে। রেনেসাঁস ইউরোপের শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে-এক কথায় জীবনের সর্বস্তরে একটা বিশাল বিপ্লব ঘটায়। প্রধানত ক্যাথলিকরা ইউরোপের চিন্তার জগতে একটা স্থবিরতা এনেছিল। ইতালির মানুষ বুঝেছিল যে জীবনে অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন মুক্তচিন্তা। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উন্নতির জন্য প্রয়োজন প্রাসঙ্গিক তথ্য এ কথা তারা বুঝতে পেরেছিল। জ্ঞানের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন উৎস। সামন্তবাদ আর ধর্মযাজকরা মিলে যে বদ্ধ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল তাতে মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছিল। পার্থিব চিন্তাধারা এনে দিল নতুন পথের সন্ধান। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, শিল্পে রাজনীতিতে ইউরোপে একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো। 
এবার নিজের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে মুক্ত মন নিয়ে। মুসলমান রাজত্বের পাঁচ শ' বছরে স্থানীয় মুসলমানরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর ধারেকাছে ছিল না কিন্তু এক ধরনের মানসিক সম্পর্ক ছিল তাদের সঙ্গে যার কোন বাস্তব ভিত্তি ছিল না। এই কারণে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করলে মুসলমানরা একই সঙ্গে, ক্রোধ ও অসহায় বোধ করে। ইংরেজী ভাষাকে তারা বর্জন করল। উইলিয়াম হান্টারের লেখা 'দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস' পড়লে সে সময়ের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে প্রধানত রাজা রাম মোহন রায়ের শেখানো পথ অনুসরণ করে হিন্দুরা অনেক দূর এগিয়ে গেল। একটি বিষয় উল্লেখ করলে বিষয়টি অনেক পরিষ্কার হবে। ইংরেজ সরকার যখন পুরনো হিন্দু ধর্ম শিক্ষার জন্য বিদ্যায়তন খোলার উদ্যোগ নেয় তখন রাজা রাম মোহন রায় তার প্রতিবাদ করেন। তিনি দাবি করেন যেন ইংরেজ সরকার আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে অর্থাৎ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক, দর্শন ইত্যাদি শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে মুসলমানরা মাদ্রাসা শিক্ষক।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের ফেলো
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=13&dd=2014-09-03&ni=184188
প্রকাশ : বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ১৯ ভাদ্র ১৪২১

Also read:
আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের চারটি স্তম্ভ
ওয়াহিদ নবি
...........আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের চারটি স্তম্ভ হচ্ছে (১) জাতীয়তাবাদ, (২) ধর্মনিরপেক্ষতা, (৩) সমাজতন্ত্র ও (৪) গণতন্ত্র। আমরা এই স্তম্ভগুলো সম্বন্ধে অতিসংক্ষেপে আলোচনা করব এই আশায় যে, এগুলো সম্বন্ধে বিস্তৃততর ও গভীরতর আলোচনা হবে।
জাতীয়তাবাদ 
১৮৮২ সালে ফরাসী দার্শনিক আর্নেস্টো রেনাঁ একটি মহামূল্যবান ভাষণ দেন জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে। জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আলোচনা হলে রেনাঁর এই ভাষণের কথা কেউ না কেউ উল্লেখ করবেনই। অথচ ছাপার অক্ষরে এই ভাষণটি মাত্র ৭২ লাইন। রেনাঁ বলেছিলেন "অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে বীরত্বপূর্ণ গৌরবগাথা সৃষ্টি করেছিলেন তাই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি। বর্তমানে আমরা যখন অতীতের সেই গৌবের কথা স্মরণ করে সমষ্টিগতভাবে ভবিষ্যতে মহান কাজ করার সঙ্কল্প গ্রহণ করব তখন আমরা একটা প্রকৃত জাতি গড়ে তুলব।" তিনি আরও বলেছিলেন, ''অতীতের গৌরবের চেয়ে অতীতের শোক ও দুঃখ আমাদের কাছে বেশি মূল্যবান। কারণ দুঃখ আমাদের কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে এবং একত্রে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।'' একাত্তরে বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের গৌরবগাথা। আমাদের মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব, আমাদের মিত্র ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ২০ হাজার সৈনিকের আত্মদান, রাশিয়ার মানুষের সর্বাত্মক সমর্থন-এসব আমাদের মানসনেত্রে চিরজাগরুক থাকবে। কিন্তু এর চেয়েও বড় ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, শতসহস্র নারীর সম্ভ্রম হারানো, অগণিত আহত মানুষের সীমিত জীবনযাপন-এগুলো আমাদের শোকগাথা। আমাদের গৌরবগাথা আর শোকগাথা আমাদের কর্তব্যবোধকে জাগরিত করুক। এই হোক আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি। ...............................  Details at:
প্রকাশ : বুধবার, ২৭ আগষ্ট ২০১৪, ১২ ভাদ্র ১৪২১

উপ-সম্পাদকীয় | কালের কণ্ঠ

আমাদের একঘেয়েমি বোধটাও কি ভোঁতা হয়ে গেছে! 


http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/08/26/121133








__._,_.___

Posted by: SyedAslam <Syed.Aslam3@gmail.com>


****************************************************
Mukto Mona plans for a Grand Darwin Day Celebration: 
Call For Articles:

http://mukto-mona.com/wordpress/?p=68

http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=585

****************************************************

VISIT MUKTO-MONA WEB-SITE : http://www.mukto-mona.com/

****************************************************

"I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it".
               -Beatrice Hall [pseudonym: S.G. Tallentyre], 190





__,_._,___