বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০১৪, ৩০ আশ্বিন ১৪২১ RbKÉ
গরু পাচারের টাকায় জঙ্গীদের জিহাদ
আইএসআই নাটের গুরু
শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গীদের জিহাদী কাজ চলত গরু পাচারের টাকায়। প্রতি বছর ভারত থেকে বাংলাদেশে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার গরু পাচার হচ্ছে। বছরে গরু পাচার হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ লাখ। প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে ৫ কোটি টাকা মূল্যের গরু। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ১৪৯টি গ্রামের ৬৮টি এলাকাকে স্মাগলিং করিডর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গরু পাচারের টাকা দিয়ে যে জঙ্গী তৎপরতা চলছে সেই ব্যাপারে আগেই কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারকে। আর দুই দেশের জঙ্গী তৎপরতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মদত দিচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে নেমে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। জামায়াতের সঙ্গে বাংলাদেশের জেএমবি, ইন্ডিয়ান আইএমএর যোগসূত্র পাওয়া গেছে তদন্তে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল হাকিম, রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবিকে গোয়েন্দা হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
তদন্তে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার হচ্ছে। গরু পাচারের লভ্যাংশের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা জঙ্গী তৎপরতায় বিনিয়োগ হতো। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে। বর্ধমানের খাগড়াগড়সহ বিভিন্ন রাজ্য ও জেলায় যে জঙ্গী তৎপরতা চলছে তার অর্থের যোগান দিচ্ছে গরু চোরাকারবারিরাই। আর গরু চোরাকারবারিরাই নিয়ন্ত্রণ করছে সীমান্তে গরু চোরাচালান বা পাচারের কাজটি। বাংলাদেশের রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত গরু চোরাকারবারের ঘাঁটি বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গরু পাচারকারীদের সঙ্গে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির অসৎ সদস্যরা জড়িত। সীমান্তের গরু পাচারের নিয়ন্ত্রক জঙ্গীরা তাদের লভ্যাংশের টাকায় নাশকতা ও জিহাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে সীমান্তে গরু পাচারের কাজে আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। ভারত থেকে গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই ৫শ' টাকা থেকে ১ হাজার টাকা ট্যাক্স দিলেই আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। শুধু গরু চোরাকারবারিদের একটি মুচলেকা দিতে হয় যে, গরুগুলো সীমান্ত এলাকায় ঘুরাফেরা করছিল। গরু চোরাকারবারিকে আইনসিদ্ধ করে বছরে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ৫০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে। ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকাকে গরু পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গরু চোরাকারবারের সঙ্গে জাল নোটের ব্যবসারও তদন্ত করা হচ্ছে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ।
সাতক্ষীরার জঙ্গী জুম ॥
ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ সূত্রের খবর, গরু পাচারের অর্থ যে জঙ্গীদের নাশকতা, জিহাদের তৎপরতায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা অনেক আগেই প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের কাশ্মীরের জঙ্গী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদদিনকে যে গরু পাচারের লভ্যাংশের অর্থ দেয়া হয়েছিল তা একটি জঙ্গী তৎপরতার মামলার চার্জশীটে উল্লেখ করেছে তদন্ত সংস্থা এনআইএ। এই চার্জশীটে সাতক্ষীরা জুম নামের এক জঙ্গী রয়েছে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই চার্জশীটে। সাতক্ষীরার জঙ্গী জুমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গীদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়। গরু পাচারের অর্থ জঙ্গীদের কাছে জিহাদী কার্যক্রমের জন্য যায় আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে। এই বিষয়টি জানিয়েছেন প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল এমকে নারায়ণ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তদন্ত সংস্থা এনআইএর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এ ধরনের তথ্য তুলে ধরেছেন তিনি।
বাংলাদেশের দুই ছাত্রের ফর্মুলা ॥
বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে নেমে তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের দুই ছাত্রই জেএমবির হয়ে বোমা তৈরির যাবতীয় ফর্মুলার দায়িত্বে ছিলেন। এই ছাত্র দুই জনের নাম প্রকাশ না করে তদন্ত সংস্থা বলেছে, তারা নামী দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তাদের ফর্মুলায়ই বর্ধমানের বোমা তৈরির কাজ হচ্ছিল। এই দুই ছাত্রের সঙ্গে নিহত শাকিল জঙ্গীর স্ত্রী রাজিয়া বিবির সঙ্গে কথা হয়েছিল। রাজিয়া বিবি তদন্তকারীদের কাছে বলেছেন, অনেক সময়ে দুই ছাত্রের পাঠানো ফর্মুলা তারা বুঝে ওঠে পারত না। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংক, যার মুম্বাই শাখা রয়েছে তার মাধ্যমেই জামায়াতের টাকা এসেছে বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।
কে এই সুমন ॥
বর্ধমানের খাগড়াগড়ের তদন্তে নেমে সুমন নামে এক ছাত্রের নাম জানতে পেরেছে তদন্তকারীরা। সে বাংলাদেশের একটি পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র। রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছে সে। বাংলাদেশের এক জামায়াত নেতার মাধ্যমেই সে জঙ্গী জিহাদী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরেক ছাত্র। এই ছাত্র বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তারা দুইজনেই একাধিকবার বিদেশে গিয়েছে। তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্যের ফর্মুলা তৈরি করার। বাংলাদেশে বসেই তারা বিদেশের জঙ্গী তৎপরতা, নাশকতা ও গ্রেনেড-বোমা তৈরির ফর্মুলার দেখভালের কাজ করছে। গ্রেফতারকৃত রিজিয়া বিবি ও আলিমা বিবি জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তকারীদের জানিয়েছে, অক্টোবর মাসে তাদের হাতে বিস্ফোরক তৈরির নতুন ফর্মুলা আসার কথা ছিল। দুই ছাত্রের সঙ্গে অসমের জঙ্গী সংগঠন মুজাহিদিনের সিøপার সেলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। কম খরচে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী দুই ছাত্র। বাংলাদেশের একটি বেসরকারী ব্যাংকের মাধ্যমে জামায়াতের অর্থ পাঠানো হচ্ছে জঙ্গীদের কাছে। প্রায় এক মাস আগেই এ ধরনের তথ্য আসে পুলিশের কাছে। বেসরকারী ব্যাংকটিতে জামায়াত নেতার একাধিক এ্যাকাউন্টস আছে। জামায়াতের টাকা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কার কাছে কিভাবে পৌঁছানো হচ্ছে সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পাসপোর্ট হলো কিভাবে ॥
বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদ ওরফে শাকিল গাজি, সুবাহান ম-ল পাসপোর্ট পেল কিভাবে? ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ তাদের ছাড়পত্র দিয়েছিল। তারা বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন জেএমবির জঙ্গী সদস্য। শুধু তাই নয়, তারা ভারতীয় নাগরিক হওয়ার প্রমাণস্বরূপ ভোটার আইডি কার্ড যোগাড় করে ফেলেছে। গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা নিহত শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও নিহত সুবাহান ম-লের স্ত্রী আলিমা বিবি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরিরও পরিকল্পনা করেছে। তাদের জন্ম কোথায়, তারা কি করে সেই বিষয়ে খোঁজই নেয়নি পুলিশ। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে যাতায়াতের মাধ্যমে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়েছে।
তৃণমূলের বড় নেতা গোয়েন্দা নজরদারিতে ॥
বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তৃণমূলের কংগ্রেসের এক এক প্রথম সারির নেতা। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে এ ধরনের যোগাযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী সংস্থা। তদন্তকারী সংস্থা মনে করে, আশপাশের এলাকায় স্থানীয় স্তরের রাজনৈতিক চক্র জড়িত না হলে এত বড় মাপের জঙ্গী চক্রে তৈরি হতে পারত না। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে জেএমবির জঙ্গীদের সঙ্গে স্থানীয় স্তরের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। খাগড়াগড়ের যেই বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই বাড়িটির মালিক তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা হাসান চৌধুরীর বাড়ি এবং বাড়ির নিচেই ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের দফতর। তদন্ত সংস্থা এনআইএর সূত্রের উল্লেখ করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেসের কোন বড় মাপের নেতার নাম প্রকাশ না করে বলেছে, জামায়াত-জঙ্গীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা আছে এটা প্রায় নিশ্চিত।
জামায়াত কানেকশন, মদতদাতা আইএসআই ॥
বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশে জেএমবির সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের (আইএম) যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহপোষণ করে তদন্ত করছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। তদন্তকারীদের ধারণা, প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারতের জঙ্গী তৎপরতায় জামায়াতের অর্থায়নে মদত দিচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণে আহত আবদুল হাকিমকে কড়া নিরাপত্তায় রেখে এই বিষয়টিও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জেএমবির সদস্য নিহত শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও সুবাহান ম-লের স্ত্রী আলিমা বিবিকেও।
ভাল মৃত্যুর উপায় কী ॥
জিহাদের ডাক দেয়া লিফলেট। আরবি, উর্দু, অসমিয়া, বাংলায় লেখা। ভাল মৃত্যুর উপায় কী? লিফলেটের সঙ্গে পাওয়া গেছে বইও। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণস্থল ও ঢিল ছোড়া দূরত্বে মঙ্গলকোর্টের শিমুলিয়ার অননুমোদিত মাদ্রাসায় তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে নানা ধরনের জিহাদী কথাবার্তার বই ও লিফলেট। শুধু কি তাই, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বাংলাদেশের কিছু পুরুষ ও মহিলার নাম, ফোনের ডায়েরি, বহু ফোন নাম্বার, পোড়া কাগজপত্র, তিনটি মোবাইল ফোন, ছয়টা সিমকার্ড, নাম্বারিং মেশিন, আরবি, উর্দু, বাংলায় জিহাদী তালিমের বই, ল্যাপটপ চার্জার, গ্রামোফোনের রেকর্ড, বিদেশী ব্যাংকের পাস বই, যুবকের ছবি, এয়ারগানের গুলি, ফুটো বোতল, অনেক নি-ক্যাপ, রোলার স্কেট, বক্সিং গ্লাবস, জামাকাপড়, মুড়ি, চালের ড্রাম গ্যাস সিলিন্ডার, সাদা পাউডার ভর্তি প্যাকেট, বালি বোঝাই বস্তা, বড় তলোয়ার, খুকরি, জঙ্গী প্রশিক্ষণের যাবতীয় সরঞ্জামাদিও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকারী পুলিশ কর্মকর্তারা খেদোক্তির সুরে বলেছেন, গোয়েন্দা উপন্যাসে যেভাবে রহস্য ভেদ করার যেসব কথা পড়েছি, তা এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। যেন সিনেমার দৃশ্য।
তদন্তে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার হচ্ছে। গরু পাচারের লভ্যাংশের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা জঙ্গী তৎপরতায় বিনিয়োগ হতো। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে। বর্ধমানের খাগড়াগড়সহ বিভিন্ন রাজ্য ও জেলায় যে জঙ্গী তৎপরতা চলছে তার অর্থের যোগান দিচ্ছে গরু চোরাকারবারিরাই। আর গরু চোরাকারবারিরাই নিয়ন্ত্রণ করছে সীমান্তে গরু চোরাচালান বা পাচারের কাজটি। বাংলাদেশের রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত গরু চোরাকারবারের ঘাঁটি বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গরু পাচারকারীদের সঙ্গে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির অসৎ সদস্যরা জড়িত। সীমান্তের গরু পাচারের নিয়ন্ত্রক জঙ্গীরা তাদের লভ্যাংশের টাকায় নাশকতা ও জিহাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে সীমান্তে গরু পাচারের কাজে আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। ভারত থেকে গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই ৫শ' টাকা থেকে ১ হাজার টাকা ট্যাক্স দিলেই আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। শুধু গরু চোরাকারবারিদের একটি মুচলেকা দিতে হয় যে, গরুগুলো সীমান্ত এলাকায় ঘুরাফেরা করছিল। গরু চোরাকারবারিকে আইনসিদ্ধ করে বছরে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ৫০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে। ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকাকে গরু পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গরু চোরাকারবারের সঙ্গে জাল নোটের ব্যবসারও তদন্ত করা হচ্ছে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ।
সাতক্ষীরার জঙ্গী জুম ॥
ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ সূত্রের খবর, গরু পাচারের অর্থ যে জঙ্গীদের নাশকতা, জিহাদের তৎপরতায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা অনেক আগেই প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের কাশ্মীরের জঙ্গী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদদিনকে যে গরু পাচারের লভ্যাংশের অর্থ দেয়া হয়েছিল তা একটি জঙ্গী তৎপরতার মামলার চার্জশীটে উল্লেখ করেছে তদন্ত সংস্থা এনআইএ। এই চার্জশীটে সাতক্ষীরা জুম নামের এক জঙ্গী রয়েছে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই চার্জশীটে। সাতক্ষীরার জঙ্গী জুমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গীদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়। গরু পাচারের অর্থ জঙ্গীদের কাছে জিহাদী কার্যক্রমের জন্য যায় আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে। এই বিষয়টি জানিয়েছেন প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল এমকে নারায়ণ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তদন্ত সংস্থা এনআইএর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এ ধরনের তথ্য তুলে ধরেছেন তিনি।
বাংলাদেশের দুই ছাত্রের ফর্মুলা ॥
বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে নেমে তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের দুই ছাত্রই জেএমবির হয়ে বোমা তৈরির যাবতীয় ফর্মুলার দায়িত্বে ছিলেন। এই ছাত্র দুই জনের নাম প্রকাশ না করে তদন্ত সংস্থা বলেছে, তারা নামী দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তাদের ফর্মুলায়ই বর্ধমানের বোমা তৈরির কাজ হচ্ছিল। এই দুই ছাত্রের সঙ্গে নিহত শাকিল জঙ্গীর স্ত্রী রাজিয়া বিবির সঙ্গে কথা হয়েছিল। রাজিয়া বিবি তদন্তকারীদের কাছে বলেছেন, অনেক সময়ে দুই ছাত্রের পাঠানো ফর্মুলা তারা বুঝে ওঠে পারত না। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংক, যার মুম্বাই শাখা রয়েছে তার মাধ্যমেই জামায়াতের টাকা এসেছে বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।
কে এই সুমন ॥
বর্ধমানের খাগড়াগড়ের তদন্তে নেমে সুমন নামে এক ছাত্রের নাম জানতে পেরেছে তদন্তকারীরা। সে বাংলাদেশের একটি পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র। রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছে সে। বাংলাদেশের এক জামায়াত নেতার মাধ্যমেই সে জঙ্গী জিহাদী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরেক ছাত্র। এই ছাত্র বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তারা দুইজনেই একাধিকবার বিদেশে গিয়েছে। তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্যের ফর্মুলা তৈরি করার। বাংলাদেশে বসেই তারা বিদেশের জঙ্গী তৎপরতা, নাশকতা ও গ্রেনেড-বোমা তৈরির ফর্মুলার দেখভালের কাজ করছে। গ্রেফতারকৃত রিজিয়া বিবি ও আলিমা বিবি জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তকারীদের জানিয়েছে, অক্টোবর মাসে তাদের হাতে বিস্ফোরক তৈরির নতুন ফর্মুলা আসার কথা ছিল। দুই ছাত্রের সঙ্গে অসমের জঙ্গী সংগঠন মুজাহিদিনের সিøপার সেলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। কম খরচে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী দুই ছাত্র। বাংলাদেশের একটি বেসরকারী ব্যাংকের মাধ্যমে জামায়াতের অর্থ পাঠানো হচ্ছে জঙ্গীদের কাছে। প্রায় এক মাস আগেই এ ধরনের তথ্য আসে পুলিশের কাছে। বেসরকারী ব্যাংকটিতে জামায়াত নেতার একাধিক এ্যাকাউন্টস আছে। জামায়াতের টাকা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কার কাছে কিভাবে পৌঁছানো হচ্ছে সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পাসপোর্ট হলো কিভাবে ॥
বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদ ওরফে শাকিল গাজি, সুবাহান ম-ল পাসপোর্ট পেল কিভাবে? ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ তাদের ছাড়পত্র দিয়েছিল। তারা বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন জেএমবির জঙ্গী সদস্য। শুধু তাই নয়, তারা ভারতীয় নাগরিক হওয়ার প্রমাণস্বরূপ ভোটার আইডি কার্ড যোগাড় করে ফেলেছে। গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা নিহত শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও নিহত সুবাহান ম-লের স্ত্রী আলিমা বিবি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরিরও পরিকল্পনা করেছে। তাদের জন্ম কোথায়, তারা কি করে সেই বিষয়ে খোঁজই নেয়নি পুলিশ। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে যাতায়াতের মাধ্যমে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়েছে।
তৃণমূলের বড় নেতা গোয়েন্দা নজরদারিতে ॥
বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তৃণমূলের কংগ্রেসের এক এক প্রথম সারির নেতা। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্তে এ ধরনের যোগাযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী সংস্থা। তদন্তকারী সংস্থা মনে করে, আশপাশের এলাকায় স্থানীয় স্তরের রাজনৈতিক চক্র জড়িত না হলে এত বড় মাপের জঙ্গী চক্রে তৈরি হতে পারত না। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে জেএমবির জঙ্গীদের সঙ্গে স্থানীয় স্তরের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। খাগড়াগড়ের যেই বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই বাড়িটির মালিক তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা হাসান চৌধুরীর বাড়ি এবং বাড়ির নিচেই ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের দফতর। তদন্ত সংস্থা এনআইএর সূত্রের উল্লেখ করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেসের কোন বড় মাপের নেতার নাম প্রকাশ না করে বলেছে, জামায়াত-জঙ্গীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা আছে এটা প্রায় নিশ্চিত।
জামায়াত কানেকশন, মদতদাতা আইএসআই ॥
বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশে জেএমবির সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের (আইএম) যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহপোষণ করে তদন্ত করছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। তদন্তকারীদের ধারণা, প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারতের জঙ্গী তৎপরতায় জামায়াতের অর্থায়নে মদত দিচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণে আহত আবদুল হাকিমকে কড়া নিরাপত্তায় রেখে এই বিষয়টিও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জেএমবির সদস্য নিহত শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও সুবাহান ম-লের স্ত্রী আলিমা বিবিকেও।
ভাল মৃত্যুর উপায় কী ॥
জিহাদের ডাক দেয়া লিফলেট। আরবি, উর্দু, অসমিয়া, বাংলায় লেখা। ভাল মৃত্যুর উপায় কী? লিফলেটের সঙ্গে পাওয়া গেছে বইও। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণস্থল ও ঢিল ছোড়া দূরত্বে মঙ্গলকোর্টের শিমুলিয়ার অননুমোদিত মাদ্রাসায় তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে নানা ধরনের জিহাদী কথাবার্তার বই ও লিফলেট। শুধু কি তাই, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বাংলাদেশের কিছু পুরুষ ও মহিলার নাম, ফোনের ডায়েরি, বহু ফোন নাম্বার, পোড়া কাগজপত্র, তিনটি মোবাইল ফোন, ছয়টা সিমকার্ড, নাম্বারিং মেশিন, আরবি, উর্দু, বাংলায় জিহাদী তালিমের বই, ল্যাপটপ চার্জার, গ্রামোফোনের রেকর্ড, বিদেশী ব্যাংকের পাস বই, যুবকের ছবি, এয়ারগানের গুলি, ফুটো বোতল, অনেক নি-ক্যাপ, রোলার স্কেট, বক্সিং গ্লাবস, জামাকাপড়, মুড়ি, চালের ড্রাম গ্যাস সিলিন্ডার, সাদা পাউডার ভর্তি প্যাকেট, বালি বোঝাই বস্তা, বড় তলোয়ার, খুকরি, জঙ্গী প্রশিক্ষণের যাবতীয় সরঞ্জামাদিও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকারী পুলিশ কর্মকর্তারা খেদোক্তির সুরে বলেছেন, গোয়েন্দা উপন্যাসে যেভাবে রহস্য ভেদ করার যেসব কথা পড়েছি, তা এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। যেন সিনেমার দৃশ্য।
__._,_.___