দেশে ফেরা হচ্ছে না লতিফ সিদ্দিকীর
পাভেল হায়দার চৌধুরী
অঅ-অ+
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে প্রধানমন্ত্রী অব্যাহতি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকীর অব্যাহতির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সূত্র থেকে আরো জানা গেছে, অব্যাহতির পরে আপাতত দেশেও আসছেন না লতিফ সিদ্দিকী। সরকারের প্রভাবশালী মহল থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে ঈদের আগে দেশে আসতে বারণ করা হয়েছে। অব্যাহতি দেওয়া হলেও লতিফ সিদ্দিকী দেশে এলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠতে পারে- এই আশঙ্কাও করছে ক্ষমতাসীনরা। তাই আপাতত দেশে আসতে তাঁকে বারণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, দেশে না আসার ব্যাপারে লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠদের দিয়েও তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে। পরিবার থেকেও তাঁকে এ রকম বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাঁরা সরাসরি কিছু না বললেও এই মুহূর্তে লতিফ সিদ্দিকীর দেশে আসা ঠিক হবে না বলে অভিমত দিয়েছেন।
দলের একাধিক নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত বড় ক্ষতির হাত থেকে সরকারকে বাঁচিয়েছে। লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য তাদের দৃষ্টিতে ঔদ্ধত্যপূর্ণও ছিল। তাঁর ওই বক্তব্যের ইস্যুকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে, এ আশঙ্কা থেকেই ত্বরিত এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, প্রধানমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। এ কারণে মেক্সিকোতে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর যে পুরস্কার নেওয়ার কথা ছিল, তা তিনি নেননি। তাঁর বদলে ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক পুরস্কার গ্রহণ করেছেন।
দলীয় পদ থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, 'দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে সব ধরনের সিদ্ধান্তের কথা আপনারা জানতে পারবেন।'
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগ প্রতিটি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বঙ্গবন্ধুও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শত ব্যস্ততার মধ্যেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। তিনি নিজে হজ পালন করেছেন। এর আগে পবিত্র ধর্ম নিয়ে যারাই মন্তব্য করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন তিনি। লতিফ সিদ্দিকী ইসলাম ধর্ম নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।
যুক্তরাষ্ট্রে রবিবার এক অনুষ্ঠানে সমালোচিত মন্তব্যের পর মেক্সিকোতে যান টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। তাঁর সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদও যান। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি পুরস্কার গ্রহণের কথা ছিল লতিফ সিদ্দিকীর। কিন্তু বুধবার বাংলাদেশ সময় ভোরে মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা শহরে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সরকারের পক্ষ থেকে 'গ্লোবাল আইসিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড' নেন বলে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সূত্র জানায়, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পর দেশে উদ্ভূত সর্বশেষ পরিস্থিতি পরিবারের পক্ষ থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে অবহিত করা হয়েছে বলেও ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা জানান। তিনি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী দেশের মানুষের ভেতরের প্রতিক্রিয়া কী, তাও জেনেছেন দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী বলেন, 'লতিফ সিদ্দিকী অপরাধ করেছেন, তাঁর ব্যাপারে দল ও সরকার একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে তাঁর দেশে না আসাই হবে উত্তম। এই ভেবে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দিয়ে অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। এখন উনি কী করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার।' তবে তাঁর দেশে না আসাই যে ভালো, তা আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী মহলও মনে করে।
আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বেশির ভাগ নেতাই চান, এই মুহূর্তে লতিফ সিদ্দিকীর দেশে না আসাই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। জানতে চাইলে সভাপতিমণ্ডলীর প্রভাবশালী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আপাতত তাঁর দেশে না ফেরারই কথা। তিনি দেশে ফিরলে পরিস্থিতি যেকোনো দিকে গড়াতে পারে।
সূত্র জানায়, দেশের পরিস্থিতি শান্ত রাখা, এটাকে পুঁজি করে কাউকে রাস্তায় নামতে না দেওয়া এবং সরকারের ও দলের ভাবমূর্তি ঠিক রাখা- এসব নানা দিক চিন্তা করেই লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত দ্রুত গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তাঁর এই ত্বরিত সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন মন্ত্রী ও দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে দ্রুত এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাজনৈতিক চিরশত্রুরা সুবিধা করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে একটু দেরি হলেই সরকার ও দলকে কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হতো।
এর প্রশংসা করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ভুল করেন না। লতিফ সিদ্দিকীর দেশে ফেরা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুরঞ্জিত বলেন, 'উনি দেশে আসবেন কী আসবেন না, এটা তাঁর ব্যাপার।'
তবে লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে আরো বড় কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কি না- জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'এর জন্য শেখ হাসিনার আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। তিনি এলেই আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।'
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ব্যাপারে লতিফ সিদ্দিকীই ভালো বলতে পারবেন। তবে তাঁর ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও সরকারের যা করণীয় ছিল, তা করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে যে বক্তব্য লতিফ সিদ্দিকী দিয়েছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।' অব্যাহতি বিষয়ে কোনো কালক্ষেপণ হতে পারে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অব্যাহতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্তই। এ নিয়ে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। এ আনুষ্ঠানিকতাটুকুও শিগগিরই কার্যকর হবে। হানিফ বলেন, অব্যাহতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলেই ম্যাক্সিকোতে মন্ত্রী হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীর যে পুরস্কার নেওয়ার কথা ছিল; যেহেতু তিনি আর মন্ত্রী নন, তাই এ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।
উল্লেখ্য, গত রবিবার বিকেলে নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী টাঙ্গাইলবাসীর সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, 'আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। তবে তার চেয়েও হজ ও তাবলিগ জামাতের বেশি বিরোধী।' তিনি বলেন, 'এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়! হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রোডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।' মন্ত্রী বলেন, 'এভারেজে যদি বাংলাদেশ থেকে এক লাখ লোক হজে যায়, প্রত্যেকের পাঁচ লাখ টাকা করে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়।'
হজ কিভাবে এসেছে এর ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করলেন, এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কিভাবে চলবে? তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটা ব্যবস্থা করল যে আমার অনুসারীরা প্রতিবছর একবার একসঙ্গে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।' তাবলিগ জামাতের সমালোচনা করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, 'তাবলিগ জামাত প্রতিবছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদের তো কোনো কাজ নেই। সারা দেশের গাড়িঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।' সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, "কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন? 'জয় ভাই' কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নন। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ারও কেউ নন।"
এ সংক্রান্ত আরো খবর
__._,_.___