'গোলাপী এবার ট্রেন মিস করবে না।'
ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনী উত্তেজনা, দৌড়ঝাপ, প্রার্থিতা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সবই শুরু হয়েছে। দেশের সর্ব বৃহৎ দুই শহরে উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতে চলেছে। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরের মেঘ দেখলেও ভয় পায়! এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, 'দাদা, নির্বাচনটা কি আসলে হবে?' বললাম, এ ক্যামন কথা, নির্বাচন হবেনা কেন? তিনি বললেন, 'গোলাপী তো এবার ট্রেন মিস করবে না।' তাকে বললাম, এমনিতে তো অবরোধ-টবরোধ-হরতাল-টরতাল হচ্ছেনা, গণতন্ত্রে বিরোধীদের দেখভাল করাও সরকারের দাযিত্ব; তাই জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০-দলকে বাঁচানোর জন্যেই এ নির্বাচন দিয়েছেন, যাতে ওরা ইজ্জত বাঁচাতে পারে এবং এই উপলক্ষ্যে গাড়ী পোড়ানো, পেট্রল বোমা ছোঁড়া বন্ধ করে নির্বাচনী জোয়ারে গা ভাসায় এবং তাতে দেশও বেঁচে যায়। একে বলে 'এক্সিট রুট' দেয়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওদের তাই দিয়েছেন। সুতরাং নির্বাচন না হবার তো কোন কারণ দেখিনা। তিনি আবারো বললেন, আমরা জিতবো তো? বললাম, নির্বাচন একটি খেলা, খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই। হারি-জিতি নাহি লাজ।
নির্বাচনকে যেমন আমরা কখনো স্পোর্টিং মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করতে পারিনি, তেমনি ক্রিকেট-কেও পারলাম না। ভারতের সাথে পরাজয়ের পর দায়িত্বশীলদের অনেক মন্তব্য নিতান্তই দায়িত্বহীনতার পরিচয়। এতে ক্রিকেট অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হবে। তাই আইসিসি'র সভাপতির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নির্বাহী পরিচালক বলতে পেরেছেন, 'তার আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিলো।' আমি খেলা দেখিনি, রিপ্লে দেখেছি। আগেরদিন অফিস থেকে যাওয়ার সময় আমাদের সহকর্মী কামরুল হাসান জানালেন, তিনি খেলা দেখবেন। খেলা শেষ হবার ঠিক পরপরই আমাদের অফিস শুরু। কামরুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে জিতেছে? উত্তর: ইন্ডিয়া। বাংলাদেশ ভালো খেলে হেরেছে তো? ভালো খেললে কি ১১৩ রানে হারে? তাকে সান্তনা দেয়ার জন্যে বললাম, অন্তত: আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে তো গেছি? কামরুল ক্ষোভের সাথে বললেন, বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়ার সাথে পয়েন্ট ভাগাভাগি না হলে তাও যেতাম না। বুঝলাম, তার রাগের কারণ আছে। ঘন্টাখানেক পর ইন্টারনেটে প্রথম 'নো' বল সম্পর্কে মন্তব্য দেখলাম। কামরুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, তেমন সমস্যা মনে হলো না। বাংলাদেশ জিতুক আমরা সবাই তা চাইলেও বাস্তবতা কি সেকথা বলে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন, 'বাংলাদেশ একদিন চ্যাম্পিয়ান হবে', সেই চেষ্টাই তো আমাদের করা উচিত। সাবের হোসেন চৌধুরী যেমন বলেছেন, 'আমাদের ছেলেরা ভালো খেলেছে, সামনে যাতে আমরা জিততে পারি সেই চেষ্টা করতে হবে।' আমাদের আর এক বন্ধু বলেছেন, দাদা, প্রতিপক্ষে ভারত না থাকলে এতকথা কি হতো?
অর্ধ-শতাব্দী আগে ১৮ই মার্চ ১৯৬৫ রাশিয়ার এলেস্কি লিওনেভ প্রথম মহাশুন্যে পদার্পণ করেন এবং মিনিট দশেক হেটে বেড়ান। বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে বা আকাশে হেটে বেড়াচ্ছে, আমরা তখন কবি নজরুলের ভাষায়, 'বিবি তালাকের ফতোয়া---' খুঁজে বেড়াচ্ছি। পরনিন্দা, পরচর্চা নাকি বাঙালীর মজ্জাগত। খেলা থেকে রাজনীতি, নির্বাচন সবকিছুতেই আমরা পিছিয়ে বা এগিয়ে যাবার কোন স্পৃহা নেই। খেলায় হারার পর অন্তত: হাজার খানেক বার ফেইস বুকে 'মালাউন' শব্দটির ব্যবহার দেখেছি। যারা লিখেছেন তারা সবাই বাঙালী এবং এই বাঙালিদের নিয়েই আমরা গর্বিত! মানলাম, রেফারীর সিদ্ভান্ত ভুল ছিলো, তারপরও কি এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক হয়েছে? গতকাল আমরা একটি ডিনারে ছিলাম। সেখানে আমাদের এক বন্ধু-ছোটভাই, যিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং একটি এল্যুমনি এসোসিয়েশনের সভাপতি একটি ঘটনার কথা বললেন। তারা কিছুদিন আগে বস্টনে এক কবিতা সন্মেলনে যান এবং ওঠেন এক উচ্চ-শিক্ষিত ভদ্র পরিবারের বাসায়। তারা পাঁচ বন্ধু ছিলেন এবং এরমধ্যে একজন হিন্দু, যা ভদ্রলোক জানতেন না, কিন্তু তার স্ত্রী জানতেন। যাহোক, ওই কবিতা সন্ধ্যায় একটি মেয়ে চমত্কার নৃত্য পরিবেশন করে। পরে ভদ্রলোকের বাসায় খাবার টেবিলে এই নিয়ে কথাবার্তায় সবাই মেয়েটি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। ভদ্রলোক তখন হটাত বলেন, 'হবেনা, ওতো মালুর মেয়ে।'এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।' ভদ্রমহিলা কাঁচুমাঁচু হয়ে নানান কথা বলে প্রসংগ ঘুরাতে চান। ভদ্রলোক শেষমেষ বুঝতে পারেন, অতিথিদের মধ্যে একজন হিন্দু। পরের দিন ভদ্রলোক তাকে বলেন, কিছু মনে করবেন না, ওটা একটা কথার কথা মাত্র। হিন্দু ভদ্রলোক বলেন, 'দাদা, আমি কিছু মনে করি নাই, কারণ ওটা আমরা শুনতে অভ্যস্ত। তাছাড়া, এতে আমার কোন ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি যদি কিছু হয়, তা আপনার হয়েছে।' ক্রিকেট খেলায় হারার পর দেশশুদ্ধ মানুষের মন্তব্যে অনেকেরই মনে হয়েছে, এটা দেশপ্রেম নয়, ভারত বিদ্বেষ। এতে ভারতের কোন ক্ষতি হবেনা, ক্ষতি যদি কিছু হয়, তা আমাদের হবে। আমাদের ক্রিকেটের হবে। আমরা কি আইসিসি থেকে বেরিয়ে আসবো? আমরা নিজেদের ভালোটা বুঝবো কবে?
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ২২শে মার্চ ২০১৩।
__._,_.___