চলমান অবরোধ-হরতালে সহিংসতায় নিহত ১২৮ জনের মধ্যে ৭২ জনই পেট্রলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আর দগ্ধ হয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরাও দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে চিন্তিত। কষ্টে আছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাও। সব মিলিয়ে তাঁরা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের ৭৯তম দিন আজ বুধবার। এর পাশাপাশি বিরতি দিয়ে হরতাল। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৮১ জন। মারা গেছেন ১৯ জন। এখনো চিকিৎসাধীন ২৮ জন। তাঁদের মধ্যে সাতজন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও সার্বক্ষণিক পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসাধীন দগ্ধ রোগীদের পাশেই তাঁদের স্বজনদের চোখেমুখে এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা।
ভাগ্য ফেরাতে কাতার যাওয়ার জন্য কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসছিলেন রাশেদুল ইসলাম (২৮)। টাকা জোগাড় করেছিলেন ভিটা বন্ধক রেখে। পথে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রলবোমা হামলা কেড়ে নিয়েছে তাঁকেই। তাঁকে হারিয়ে স্ত্রী, দুই ছেলে আর বিধবা মায়ের দিন কাটছে চরম কষ্টে।
মানবেতর দিন কাটছে সিলেটের নিহত ট্রাকচালক বকুল দেবনাথ, কুড়িগ্রামের বাদাম-বিক্রেতা রহিম বাদশা, বগুড়ার জাহাঙ্গীরের পরিবারেরও। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগের পরিবারের অবস্থা একই রকম। শোকের ভারের মতো কোনো কোনো পরিবারে চেপে বসেছে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার বোঝাও।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক জুলফিকার আলী বলেন, পেট্রলবোমায় দগ্ধদের চিকিৎসার দায়দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এ টাকা ব্যাংকে জমা থাকবে এবং মাসে মাসে সবাই নির্দিষ্ট একটা অঙ্কের টাকা হাতে পাবেন। এ ছাড়া দগ্ধ হওয়ার পরপরই প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে, চিকিৎসাও বিনা মূল্যে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র হাতে পেয়েছেন ৩৬ জন। চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের প্রায় প্রত্যেকে হাসপাতালে থাকার সময় লাখ খানেক টাকা হাতে পেয়েছেন। চিকিৎসা বিনা মূল্যে হলেও দগ্ধ মানুষদের সেরে উঠতে প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। একেকজন রোগীকে কেবল ডিমই খেতে হয় ৬ থেকে ২০টি পর্যন্ত। এক মাসেরও বেশি সময় রোগীর সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে বা হচ্ছে স্বজনদের। এই থাকার খরচ জোগাতে দানের টাকা ভাঙতে হয়। ফলে তাঁরা যখন হাসপাতাল ছাড়ছেন, তখন অবশিষ্ট থাকছে কম টাকাই। অথচ চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছাড়া এসব রোগীকে দু-তিন বছর পর্যন্ত নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হবে। দরিদ্র এবং পেট্রলবোমায় কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা মানুষের পক্ষে এত দিন চিকিৎসার খরচ জুগিয়ে চলাও অসম্ভব বলে জানান স্বজনেরা।
কষ্টে আছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা: কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুরে গত ৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের রাশেদুল ইসলাম। পরদিন তিনি ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে মারা যান। গত রোববার গোবিন্দপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় তাঁর স্ত্রী সুমি আক্তারের (২২) সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামে খেতমজুরি করতেন রাশেদুল। ওই আয়ে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার ঠিকমতো চলত না বলে ভাগ্য ফেরাতে কাতার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাশেদুল।
রাশেদুলের স্বজনেরা জানান, কাতার যেতে রাশেদুল ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করেন। এর মধ্যে জমানো ছিল ৬০ হাজার টাকা। ভিটা বন্ধক রেখে জোগাড় করেছিলেন বাকিটা। সুমি জানান, কখনো ভাবতেও পারেননি স্বামীহারা হবেন। তাঁর চার ও দুই বছর বয়সী ছেলেদের কাছে আর কখনো জীবিত ফিরবে না তাদের বাবা। রাশেদুল যাওয়ার আগে খেতে মরিচ বুনেছিলেন, সেই মরিচ বিক্রি করে সংসার চলছে। সামনের দিন কীভাবে কাটবে, তা জানেন না তিনি। ঘরভিটা বন্ধক, এটি হারালে কোথায় যাবেন, তা-ও অজানা।
সুমি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী পেট্রলবোমায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারের জন্য ১০ লাখ টাকা দেবেন বলেছেন। এখনো ওই টাকা পাইনি।'
রাশেদুলের সঙ্গে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় প্রাণ হারান একই গ্রামের আবু ইউছুফ ও একই উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের গাইনাকাটা গ্রামের আবু তাহের। তাঁরাও কাতার যাচ্ছিলেন। তাঁদের পরিবারও অভাব-অনটনে জর্জরিত। বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়া উদ্দিন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিলে পেট্রলবোমায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন।
ঋণের ভারে জর্জরিত সিলেটে পেট্রলবোমায় নিহত ট্রাকচালক বকুল দেবনাথের (৩৫) পরিবার। সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের বাঘের সড়ক এলাকায় গত ১৯ জানুয়ারি রাতে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২৭ জানুয়ারি।
বকুল দেবনাথের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার শশারকান্দি গ্রামে। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নীলিমা দেবনাথ, ছেলে নিলয় দেবনাথ ও ছোট ভাই রন্টু দেবনাথকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। তিনিই ছিলেন পরিবারের চালিকাশক্তি। তাঁকে অকালে হারানোর শোক আর অর্থসংকটে দিন কাটছে পরিবারটির। রন্টু জানান, ভাই মারা যাওয়ার পর সাকল্যে ৪২ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। আর ট্রাক কিনতে ভাই ঋণ নিয়েছিলেন ৩৫ লাখ টাকা। সেই ঋণের সুদও রয়েছে, রয়েছে পরিবারের সদস্যদের খরচ। ট্রাকটি এখনো পোড়া অবস্থায় রয়েছে। দেনা নিয়ে ওসমানীনগরের ইউএনও বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ঋণ মওকুফ হবে কি না, জানেন না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে ছেলেকে স্কুলে পাঠাবেন বলেছিলেন বকুল। সেই কথা মনে হলে কাঁদেন নীলিমা। নীলিমা বলেন, 'এই রাজনীতি আর কাটবনি, কাটলেও বা আমার ছেলে তো আর তার বাপরে ফিইরা পাইত না।'
ভালো নেই কুড়িগ্রামের উলিপুরের বাদাম-বিক্রেতা রহিম বাদশার (৪৮) পরিবারও। ১৩ জানুয়ারি মা রহিমা বেগমকে (৬৮) সঙ্গে করে বিশ্ব ইজতেমায় আসছিলেন। মা-ছেলে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তিন সন্তানের বাবা রহিম ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তাঁর স্ত্রী নিলুফা বেগম বলেন, 'খুব কষ্টে চলছি। জানি না কী করব। সরকার থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিল। লাশ আনা, দাফন ও অন্যান্য বাবদ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। স্বামীর দেনা ছিল ৪০ হাজার টাকা, তা শোধ করেছি। বাকি টাকায় কোনোরকমে চলছি।'
আর্থিক সংকটে আছে বগুড়ার কাহালুর ট্রাকচালকের সহকারী জাহাঙ্গীরের পরিবারও। ২৩ জানুয়ারি ভগ্নিপতি মাসুদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। মাসুদ বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। জাহাঙ্গীর মারা গেছেন।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বিউটি বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র থেকে এখনো কোনো টাকা পাননি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ লাখ টাকা পেয়েছিলেন, তাই দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে আর স্কুলে যাচ্ছে না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, 'দেকার তো কোনো মানুষ নেই। ঘরে ওর বুন আছে, মা, দাদা-দাদি। পড়বে, লেকবে ক্যামনে?'
সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক: বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও সার্বক্ষণিক পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন সাতজনের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। এঁদের ছয়জন মাগুরার মঘিরঢালে পেট্রলবোমায় গুরুতর দগ্ধ হন। অন্যজন যশোরের ঝিকরগাছার।
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ইয়াদুল ও খোরশেদ। ইয়াদুল মাগুরার মঘিরঢালের বাসিন্দা, শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ঝিকরগাছার খোরশেদ, পেশায় রাখাল। তাঁর সহযাত্রী দুজন মারা গেছেন, একজন চাঁদপুরের চান্দ্রায় ১৯ মার্চ রাতে পেট্রলবোমা হামলায় ঘটনাস্থলে, অন্যজন ২১ মার্চ। সার্বক্ষণিক পরিচর্যা কেন্দ্রে মঘিরঢালের ইমরানসহ অন্যরা রয়েছেন। ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে ইমরানের।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম বলেন, ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থা স্থিতিশীল। এখন যাঁরা হাসপাতালে আছেন তাঁদের ২০ জনের অস্ত্রোপচার করতে হবে। ছাড়া পাওয়া ৩০ জনের দুই থেকে তিনটি করে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে তাঁদের কেউ কেউ ভয়ে অস্ত্রোপচার করাতে চাইছেন না। তাঁদের অভয় দিতে আজ বুধবার মেডিকেল বোর্ড বসছে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন উজ্জ্বল মেহেদী, সিলেট; সফি খান, কুড়িগ্রাম; এস এম হানিফ, চকরিয়া (কক্সবাজার)।}
অবরোধ: ৭৭ দিনে পুড়ে মরেছেন ৭৪ জন
ফুয়াদ হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলামেইল২৪ডটকম
__._,_.___