ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা এবং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য মিথ্যা মিথ
কুলদা রায় / এমএমআর জালাল
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদ নানাপ্রকার প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব নবাব স্যার সলিমুলস্নাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুলস্নাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ জে হার্টজ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তিনি প্রথম ভাষণেই বলেন, 'এটি কোন মুসলিম কিংবা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি সবার এবং প্রত্যেক মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।' প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে তাকে সাহায্য করেন মি. ডাব্লিউ হোরনেল, স্যার নীলরতন সরকার, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নবাব স্যার শামসুল হুদা ও নবাবজাদা খান বাহাদুর কেএম আফজাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল 'সলিমুল্লাহ মুসলিম হল'। এ হলের প্রথম প্রোভস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এএফ রাহমান। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার গবর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলিজ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুলস্নাহ্-এর নামানুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে 'সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে'র ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষে এর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বলিয়াদির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলের আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহে জগন্নাথ হলের প্রথম বার্ষিক সাহিত্যপত্র 'বাসনত্মিকা' ১৯২৩ সালের প্রথমে প্রকাশিত হয়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের পর প্রভোস্ট হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।
দুই.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে একটি অপপ্রচার রয়েছে। কিন্তু এটা নিছকই অপপ্রচার। এর কোন ভিত্তি নাই।
দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ১ জুলাই ২০১১ সংখ্যায় আলী নিয়ামত লিখেছেন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ড. রাসবিহারী ঘোষ ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এই তথ্যটির কোন সূত্র-উৎস দেননি। কিন্তু আলী নিয়ামত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী মৌলানা আকরাম খান, চবি্বশ পরগণার জেলা মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, দি মুসলিম পত্রিকার নাম উলেস্নখ করেননি। আলী নিয়ামতের এই অভিযোগে সত্যের অপলাপ আছে। এবং এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতও আছে।
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরম্নল কবীর গত ২৫ বৈশাখ এনটিভিতে একই অভিযোগ করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। নূরম্নল কবীর বাংলাদেশের অন্যতম সাংবাদিক কাম সম্পাদক। সুতরাং তিনি যখন কোন তথ্য বলেন দায়-দায়িত্ব নিয়েই বলেন। খোঁজখবর নিয়েই বলেন। রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের মতো যা মুখে এলো তা বলবেন একজন সম্পাদক_এটা মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু তিনিও আলী নিয়ামতের মতো এই তথ্যটি কোথায় পেয়েছেন সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু তথ্যটি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথ কোন এলেবেলে লোক নন। তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী চলছে। তিনি ঊনসত্তর বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর জীবনের সকল তথ্যই সংরক্ষিত আছে। খুঁজলে পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তিনি 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর' নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরম্নদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের তথ্য পাওয়া যায় না। কাজী মোতাহার হোসেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি অকপটে সত্য বলতে পিছপা হননি কখনও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা আছে। কিন্তু তিনি উলেস্নখ করেননি রবীন্দ্রনাথের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার তথ্যটি। এ বিষয়ে কোন সত্যতা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তা প্রকাশ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন_এ অভিযোগটি অধুনা পাকিসত্মানপন্থী কলমজীবীরা করছেন। কিছু কিছু পাকিসত্মানপন্থী পত্রিকায় মাঝে মাঝে এ ধরনের রবীন্দ্রবিরোধিতা দেখা যায়। ফরহাদ মজহার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের অনেক ছিদ্রান্বেষণ করেছেন তাঁর 'রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ' বইটিতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে ফরহাদ মজহার কোন ছাড় দেননি। সাদ কামালী নামে একজন গল্পকার-প্রবন্ধকার ফরহাদ মজহারের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান বিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ নানাবিধ ত্রম্নটি খুঁজেছেন। ড. আহমেদ শরীফও রবীন্দ্রনাথের প্রজা উৎপীড়ন খুঁজেছেন। অবাক কা- হলো এই রচনাকারদের কোথাও 'রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন' এই তথ্যটি নাই। রবীন্দ্রনাথ যে সব শাকসবজি কলাটা মূলোটা খেতেন, দৈ-খৈ কোথা থেকে খেতেন, কাদের ক্ষেতেখামারে সেসব উৎপাদিত হতো ফরহাদ মজহার এবং সাদ কামালী নানাপ্রকার খাটাখাটুনি করে তাও বের করে ফেলেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন_ এই ধরনের রগরগে অতি বিখ্যাত রবীন্দ্রছিদ্রটি তাদের রচনাতে উলেস্নখ করেননি। কেন করেননি সেটা একটা কোটি টাকার প্রশ্ন বটে। এই তথ্যটি সঠিক হলে নিশ্চয়ই তারা তাদের রচনাতে উলেস্নখ না করে পারতেন না।
২০০০ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে 'আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা' নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব) এমএ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) একটি তথ্য জানান যে, "১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।" তিনি অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
এজেড এম আব্দুল আলী দৈনিক সমকালে লেখেন, শোনা যায়, এই তথ্যটি (লেখক আব্দুল মতিন কর্তৃক উত্থাপিত রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোন বইতে আছে। তিনি অনুসন্ধান করে জানান_রবীন্দ্রনাথ ঐ মিটিং-এ উপস্থিত থেকে এবং মিটিং-এ সভাপতিত্ব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন বলে একজন লেখক উলেস্নখ করেন। লেখকটি এই তথ্যটি কোথায় পেয়েছিলেন তার কোন সূত্র বইটিতে উলেস্নখ করেন নাই। আব্দুল আলী জানান, বইটি ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। এবং রবীন্দ্রনাথের বিরম্নদ্ধে এই বানানো গপ্পটি ব্যবহার করা হয়। ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেন নাই।
তাহলে খুঁজে দেখা যাক ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখটিকে। খুঁজে দেখব ঐ দিন রবীন্দ্রনাথ কোথায় ছিলেন? কী করেছিলেন?
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছেন জগদানন্দ রায়কে। জগদানন্দ রায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক, রবীন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যাদের গৃহশিক্ষক ও শানত্মিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। চৈত্র ১৫, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি লিখেছেন শিলাইদহ থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "কয়দিন এখানে এসে সুস্থ বোধ করছিলুম। মনে করেছিলুম সেদিন যে ধাক্কাটা খেয়েছিলুম সেটা কিছুই নয়। সুস্থ হয়ে উঠলেই অসুখটাকে মিথ্যা বলে মনে হয়। আবার আজ দেখি সকাল বেলায় মাথাটা রীতিমত টলমল করচে। কাল বুধবার ছিল বলে, কাল সন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের নিয়ে একটু আলোচনা করছিলুম। এইটুকুতেই আমার মাথা যখন কাবু হয়ে পড়ল তখন বুঝতে পারচি নিতানত্ম উড়িয়ে দিলে চলবে না।' (বি, ভা. প, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৬। ২৫৩, পত্র ৫)। (চলবে)
শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদ নানাপ্রকার প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব নবাব স্যার সলিমুলস্নাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুলস্নাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ জে হার্টজ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তিনি প্রথম ভাষণেই বলেন, 'এটি কোন মুসলিম কিংবা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি সবার এবং প্রত্যেক মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।' প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে তাকে সাহায্য করেন মি. ডাব্লিউ হোরনেল, স্যার নীলরতন সরকার, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নবাব স্যার শামসুল হুদা ও নবাবজাদা খান বাহাদুর কেএম আফজাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল 'সলিমুল্লাহ মুসলিম হল'। এ হলের প্রথম প্রোভস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এএফ রাহমান। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার গবর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলিজ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুলস্নাহ্-এর নামানুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে 'সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে'র ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষে এর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বলিয়াদির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলের আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহে জগন্নাথ হলের প্রথম বার্ষিক সাহিত্যপত্র 'বাসনত্মিকা' ১৯২৩ সালের প্রথমে প্রকাশিত হয়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের পর প্রভোস্ট হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।
দুই.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে একটি অপপ্রচার রয়েছে। কিন্তু এটা নিছকই অপপ্রচার। এর কোন ভিত্তি নাই।
দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ১ জুলাই ২০১১ সংখ্যায় আলী নিয়ামত লিখেছেন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ড. রাসবিহারী ঘোষ ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এই তথ্যটির কোন সূত্র-উৎস দেননি। কিন্তু আলী নিয়ামত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী মৌলানা আকরাম খান, চবি্বশ পরগণার জেলা মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, দি মুসলিম পত্রিকার নাম উলেস্নখ করেননি। আলী নিয়ামতের এই অভিযোগে সত্যের অপলাপ আছে। এবং এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতও আছে।
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরম্নল কবীর গত ২৫ বৈশাখ এনটিভিতে একই অভিযোগ করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। নূরম্নল কবীর বাংলাদেশের অন্যতম সাংবাদিক কাম সম্পাদক। সুতরাং তিনি যখন কোন তথ্য বলেন দায়-দায়িত্ব নিয়েই বলেন। খোঁজখবর নিয়েই বলেন। রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের মতো যা মুখে এলো তা বলবেন একজন সম্পাদক_এটা মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু তিনিও আলী নিয়ামতের মতো এই তথ্যটি কোথায় পেয়েছেন সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু তথ্যটি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথ কোন এলেবেলে লোক নন। তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী চলছে। তিনি ঊনসত্তর বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর জীবনের সকল তথ্যই সংরক্ষিত আছে। খুঁজলে পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তিনি 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর' নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরম্নদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের তথ্য পাওয়া যায় না। কাজী মোতাহার হোসেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি অকপটে সত্য বলতে পিছপা হননি কখনও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা আছে। কিন্তু তিনি উলেস্নখ করেননি রবীন্দ্রনাথের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার তথ্যটি। এ বিষয়ে কোন সত্যতা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তা প্রকাশ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন_এ অভিযোগটি অধুনা পাকিসত্মানপন্থী কলমজীবীরা করছেন। কিছু কিছু পাকিসত্মানপন্থী পত্রিকায় মাঝে মাঝে এ ধরনের রবীন্দ্রবিরোধিতা দেখা যায়। ফরহাদ মজহার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের অনেক ছিদ্রান্বেষণ করেছেন তাঁর 'রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ' বইটিতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে ফরহাদ মজহার কোন ছাড় দেননি। সাদ কামালী নামে একজন গল্পকার-প্রবন্ধকার ফরহাদ মজহারের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান বিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ নানাবিধ ত্রম্নটি খুঁজেছেন। ড. আহমেদ শরীফও রবীন্দ্রনাথের প্রজা উৎপীড়ন খুঁজেছেন। অবাক কা- হলো এই রচনাকারদের কোথাও 'রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন' এই তথ্যটি নাই। রবীন্দ্রনাথ যে সব শাকসবজি কলাটা মূলোটা খেতেন, দৈ-খৈ কোথা থেকে খেতেন, কাদের ক্ষেতেখামারে সেসব উৎপাদিত হতো ফরহাদ মজহার এবং সাদ কামালী নানাপ্রকার খাটাখাটুনি করে তাও বের করে ফেলেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন_ এই ধরনের রগরগে অতি বিখ্যাত রবীন্দ্রছিদ্রটি তাদের রচনাতে উলেস্নখ করেননি। কেন করেননি সেটা একটা কোটি টাকার প্রশ্ন বটে। এই তথ্যটি সঠিক হলে নিশ্চয়ই তারা তাদের রচনাতে উলেস্নখ না করে পারতেন না।
২০০০ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে 'আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা' নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব) এমএ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) একটি তথ্য জানান যে, "১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।" তিনি অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
এজেড এম আব্দুল আলী দৈনিক সমকালে লেখেন, শোনা যায়, এই তথ্যটি (লেখক আব্দুল মতিন কর্তৃক উত্থাপিত রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোন বইতে আছে। তিনি অনুসন্ধান করে জানান_রবীন্দ্রনাথ ঐ মিটিং-এ উপস্থিত থেকে এবং মিটিং-এ সভাপতিত্ব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন বলে একজন লেখক উলেস্নখ করেন। লেখকটি এই তথ্যটি কোথায় পেয়েছিলেন তার কোন সূত্র বইটিতে উলেস্নখ করেন নাই। আব্দুল আলী জানান, বইটি ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। এবং রবীন্দ্রনাথের বিরম্নদ্ধে এই বানানো গপ্পটি ব্যবহার করা হয়। ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেন নাই।
তাহলে খুঁজে দেখা যাক ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখটিকে। খুঁজে দেখব ঐ দিন রবীন্দ্রনাথ কোথায় ছিলেন? কী করেছিলেন?
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছেন জগদানন্দ রায়কে। জগদানন্দ রায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক, রবীন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যাদের গৃহশিক্ষক ও শানত্মিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। চৈত্র ১৫, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি লিখেছেন শিলাইদহ থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "কয়দিন এখানে এসে সুস্থ বোধ করছিলুম। মনে করেছিলুম সেদিন যে ধাক্কাটা খেয়েছিলুম সেটা কিছুই নয়। সুস্থ হয়ে উঠলেই অসুখটাকে মিথ্যা বলে মনে হয়। আবার আজ দেখি সকাল বেলায় মাথাটা রীতিমত টলমল করচে। কাল বুধবার ছিল বলে, কাল সন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের নিয়ে একটু আলোচনা করছিলুম। এইটুকুতেই আমার মাথা যখন কাবু হয়ে পড়ল তখন বুঝতে পারচি নিতানত্ম উড়িয়ে দিলে চলবে না।' (বি, ভা. প, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৬। ২৫৩, পত্র ৫)। (চলবে)
বুধবার, ১২ অক্টোবর ২০১১, ২৭ আশ্বিন ১৪১৮
__._,_.___