৭১-এর মার্চ মাসের প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে কোন না কোন জেলায় প্রতিবাদী মিছিলে বাঙালী প্রণোৎসর্গ করছিল এবং ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ঢাকায় তারা শুরু করেছিল হত্যাযজ্ঞ। সাথে সাথেই শুরু হয়, এমন কি কোন কোন জেলায় এর কয়েক দিন আগেই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ। মার্চ আমাদের আত্মত্যাগের, শোকের মাস, আবার এই মার্চেই বাঙালী অস্ত্র ধারণ করে বীর সেনানী হয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার যুদ্ধে যাত্রা করেছিল। আজ ভাবলে বিস্ময় বোধ করি, মাত্র নয় মাসে ভারত ও রাশিয়ার সহযোগিতায় বাঙালী '৭১-এর ডিসেম্বরে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বছর জুড়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালী প্রাণ দিচ্ছিল, আর লক্ষ বাঙালী তাদের শূন্যস্থান পূরণ করে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কিন্তু মার্চে যেমন হানাদার বাহিনী স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীদের টার্গেট করেছিল, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এবং অ-মুসলিমদের পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করতে হিন্দুদের টার্গেট করেছিল, তেমনি ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে, বুঝতে পেরে শিশু রাষ্ট্রটি জন্মের শুরুতেই যাতে সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে সে লক্ষ্যে ঠা-া মাথায় ভেবে-চিন্তে বাঙালীর মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের নাজি বাহিনীর ব্ল্যাকশার্টের মতোই এ দেশীয় খুনী দালালদের দ্বারা বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে হত্যা করে বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। ডিসেম্বরে ত্রিশ লক্ষ বাঙালীর প্রাণ এবং চার লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বড়ই অমূল্য এই বিজয় অর্জিত হয়েছে। তাই, মার্চ আর ডিসেম্বরে বাঙালীর স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মদানের মাধ্যমে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে বাঙালী বিজয় অর্জন করেছে ডিসেম্বরে এক নির্মম পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞে দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী-মেধাজীবীদের হারিয়ে! আর আগস্ট এসেছে জাতির জনককে সপরিবার নির্মম হত্যাকা-ের কালো মাস হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান পরিচালক তাজউদ্দীন আহমদ, জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে খুন করে স্বাধীনতাবিরোধী সামরিক-রাজনৈতিক চক্র। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে এই আগস্ট মাসে সারা দেশে বিএনপি জামায়াতের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা জঙ্গী-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হরকাতুল জেহাদ, হিজবুত তাহ্রীর ইত্যাদির দ্বারা সারা দেশে ১৭ আগস্ট বোমা হামলা করা হয় তাদের উত্থানের ঘোষণা দিতে। এ মাসেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ১৯৭১-এর মতোই আওয়ামী লীগের সমাবেশে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে পরিকল্পিত স্মরণকালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আগস্ট শুধু আর ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনায় সীমাবদ্ধ রইল না বরং এ শোকের মাসে এই ভয়াবহ হামলায় নেত্রী আইভী রহমানসহ চব্বিশজন নেতাকর্মী নিহত হয়। আহত হয় আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা এবং অনেক তরুণ-তরুণী কর্মী। ১৯৭১-এর মতোই ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের স্বাধীনতাবিরোধী সরকারের ক্যাডার ও পুলিশের হাতে নিহত হয় আওয়ামী লীগের প্রায় বিশ হাজার নেতা-কর্মী, হিন্দু ও আদিবাসী সংখ্যালঘু এবং প্রগতিশীল সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী। ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা শহীদদের স্মরণ করার শোকের মাস। ২০০৯ সালের এ মাসেও ২৫ ও ২৬ তারিখে জঙ্গী ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী সদ্য প্রতিষ্ঠিত মহাজোট সরকার উৎখাতে সংঘটিত হয় মর্মান্তিক পরিকল্পিত এক হত্যাকা-! এ হত্যাকা-ে নিহত হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সেনা-সন্তান, জঙ্গীবিরোধী সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও গবেষণাকারী সেনা কর্মকর্তা, জনমানুষকে পণ্য সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করতে ডাল-ভাত কার্যক্রম পরিচালনাকারী সেনা কর্মকর্তারা যারা ছিল দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্ত দেশকে সেবা দিতে আন্তরিক। দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক বাঙালী এবং জঙ্গী-জেহাদী সন্ত্রাসবিরোধী বাঙালীই বারংবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে পাকিস্তানপন্থী, লুটেরা অপরাজনীতিকদের লেলিয়ে দেওয়া জঙ্গী বা চারদলীয় ক্যাডারদের দ্বারা। এবার আবারও মার্চ, মাসে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার পতনের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার লক্ষ্যে ১২ মার্চ সমাবেশ, 'ঢাকা চলো' ইত্যাদি নামের অযৌক্তিক আন্দোলনের ডাক দেয়। খালেদার আন্দোলনের ডাকের আগে আগে সেনাবাহিনীতে একটি ক্যু হতে যাচ্ছিলÑযা হিযবুত তাহরীর অনুসারীদের প্রচেষ্টা বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটি সহজ হিসাব অনুসারে খালেদা-তারেক কোকোর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, ২১ আগস্টের হত্যা মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এবং বাংলাভাই- আবদুর রহমান-কৃত সর্ব হত্যা মামলায় জামায়াতের নিজামী-মুজাহিদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ যখন পাওয়া গেছে, এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে পাকিস্তান ও সৌদি প্রিয় গোলাম আযমসহ জামায়াত নেতাদের বিচার শুরু হওয়ায় যুদ্ধাপরাধী, তাদের সৃৃষ্ট জঙ্গী-সন্ত্রাসী এবং তাদের লক্ষ্য-আদর্শ বাস্তবায়নকারী খালেদা-তারেক, '৭৫-এর ঘাতক ফ্রিডম পার্টির খুনীরা ও যুদ্ধাপরাধী চক্র ঐক্যবদ্ধ আঘাত হানবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলের মহাজোট সরকারের ওপর। এদের পাশে এই সরকারের ওপর আঘাত হানতে যখন দেশের অতি উচ্চ শিক্ষিত, আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও তার সমর্থকরা সরকারের জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত সেতু বা বিদ্যুত স্থাপনা নির্মাণে বিদেশী সংস্থাকে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে লবিং করে, তখন অসম্ভব বিস্মিত হয়ে নতুন করে ভাবতে হয়, তাহলে খালেদা-তারেক বঙ্গবন্ধুর খুনী '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা কি না করতে পারে। ৬ মার্চ সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হবার খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাই প্রথম মনে পড়ল-সৌদি সরকার আমাদের দক্ষ, আন্তরিক শ্রমমন্ত্রীকে অযথা ডেকে নিয়ে শ্রমিকদের চাকরি বদলানোর সঙ্গত অধিকারটিতেও সম্মত হয়নি, অতিরিক্ত শ্রমিক নেওয়া তো দূরের কথা। প্রশ্ন ওঠে-তাহলে সৌদি সরকারকে যেটি সবসময় জামায়াত-বিএনপিপন্থী, এ সরকারের প্রতি আরও ক্রুব্ধ করে দিতেই কি সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তাকে টার্গেট করা হলো? উচ্চ শিক্ষিতদের জাতি ও দেশবিরোধী কার্যক্রম এই নিম্নমানের রুচিহীন, ক্ষমতা ও অর্থলোভী অপরাজনীতিক এবং যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে খুন হত্যার মাধ্যমে সরকারবিরোধী অপতৎপরতাকে উস্কে দেওয়া হয় না কি? আমার মনে হয়, উচ্চ শিক্ষিত অর্থ, বিত্তশালী পাশ্চাত্যের আদরণীয় ব্যক্তিবর্গকে দেশে এই প্রথম সংঘটিত কূটনীতিক হত্যার মাধ্যমে সরকার বিরোধিতার দায় নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, খালেদা জিয়া উচ্চ শিক্ষিতের দেশের সরকারবিরোধী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে দেশের ও জাতির স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করার পর পরই সরকার পতন আন্দোলন দিতে অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সময়টা মিলে যায়। তাছাড়াও, যারা ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ২১ আগস্ট সংঘটন করতে পারে, এই সেদিনও যারা সভা-সমাবেশের কাছাকাছি রেললাইনের ওপর বসে গালগল্পেরত নিরীহ গ্রামীণজন যারা ধূর্ত অপরাজনীতি বোঝে না, তাদের ওপর রেলগাড়ি চালিয়ে দিয়ে ১০-১১ জন নিরীহ, গ্রামের মানুষকে নিহত করা হলো। শোনা যায়, হয় সেনা অভ্যুত্থান, নয় লাশ-এছাড়া বিরোধী নেত্রী রাজনীতি বোঝেন না। ক্ষমতায় যেতে চান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নয়, জাল ভোটার ও ইলেকশনের ফল ম্যানিপুলেশন দ্বারা। এ তথ্য উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও তাঁরা বিরোধী নেত্রীকে ঢোলের সঙ্গত দিয়ে মাথায় তুললেন কেন তা বোধগম্য নয়। তাঁদের কেউ ক'দিন আগে বলেছিলেন ১২ মার্চের পর দেশের রাজনীতির আমূল পরিবর্তন হবে। কি আশায় কাকে নিয়ে তাঁরা এ খেলাঘর বাঁধবেন ভেবেছিলেন, সে সম্পর্কে এই সৌদি কর্মকর্তার নিহত হবার ঘটনা থেকে কি কোন ইঙ্গিত পেয়েছেন? চল্লিশ বছরে যে ধরনের ঘটনা ঘটেনি, তেমন ঘটনা এখন, ১২ মার্চের আগে ঘটল কেন? ধারণা করা যায় সম্ভবত ১২ মার্চের দিন বেশি হবে না। তার আগে বা পরে আরও কিছু অনাকাক্সিক্ষত অপঘটনা ঘটতে পারে। গুলশানে এত পুলিশ পাহারা ও চেক পোস্টের ভেতরে কে ভাবতে পেরেছিল এমন একটি হত্যাকা- ঘটানো সম্ভব? ওই দিনের চেকপোস্টের প্রহরারত পুলিশদের কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে? তাদের তো দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। তারা কি খুনীদের কাজে বাধা না দিয়ে নীরবতা পালন করেছিল? তদন্ত কাজে নিয়োজিতদের দ্রুত তদন্ত শেষ করতে হবে, কেননা সৌদি আরবে কর্মরত বাঙালীদের ওপর কারা কাদের পক্ষ হয়ে মারপিট করছে, তাও কিন্তু জানতে হবে। স্মর্তব্য, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সৌদি উচ্চ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে সুতরাং কাকে টার্গেট করে খুন করলে সরকার সমস্যায় পড়বে, সৌদি প্রবাসী বাঙালীরা নির্যাতিত হয়ে সরকারের প্রতি আস্থাহীন ও বিরক্ত হবে এইসব কিছু এ তদন্তে বের হয়ে আসা দরকার এবং দ্রুতই তা বের করতে হবে।
এ সঙ্গে বলতেই হবে-সাংবাদিক দম্পতি হত্যায় যেই জড়িত থাকুক, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে। সেই সাথে সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বোঝাতে হবে নিরপেক্ষ থাকা মানে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুর পক্ষ নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষভুক্ত থাকা। কিছু বড় বড় মিডিয়া সম্পাদক নিরপেক্ষতার নামে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা বিরোধিতায় অন্ধের মতো সমালোচনায় নামেন। তাঁদের বুঝতে হবে নিরপেক্ষতার অর্থ খুনী এবং নিহত (ভিকটিম) দু'জনের প্রতি একই আচরণ করা বা অন্যায়কারী ও ক্ষতিগ্রস্তের প্রতি সমান আচরণ করা। এর চাইতে ভুল আর কিছু হতে পারে না। নিরপেক্ষতার নামে স্বজাতির মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ও নেতা দলেরও যুদ্ধাপরাধী পক্ষ সমর্থনকারী দল ও সে দলের নেতাকে একই পাল্লায় মাপার কোন সুযোগ নেই। যারা এ কাজ করছে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে, কেননা পৃথিবীর মানুষ মানবসভ্যতাকে যে উচ্চতায় নিয়ে এসেছে, যা সব দেশ মান্য করে, তা হচ্ছে আইনের শাসন বা সুশাসন যা সব ধরনের অন্যায়কারী, যুদ্ধাপরাধী, খুনী, লুটেরা, ধর্ষক, ক্ষমতা সম্পদ গ্রাসকারীদের শাস্তি দিয়ে নিহত, ক্ষতিগ্রস্ত, নির্যাতিত ও অধিকারচ্যুতদের ক্ষতিপূরণ করা, অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা। এটি না করে নিরপেক্ষতাকে দূষিত করা কি আইন বিরুদ্ধ নয়? এবং এ কাজটি করার জন্য তাদের বিচার হওয়া কি উচিত নয়? মিডিয়া কর্মীদের এসব ভাবতে হবে।