ফিরে দেখা তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন : স্যার নিনিয়ান প্রস্তাবিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হাসিনা
জাকির হোসেন |
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে অবিরাম সাফাই গাইলেও পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিনি স্যার নিনিয়ান উত্থাপিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাবকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে অভিহিত করে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের প্রায় পুরো সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সরকারি ও বিরোধী দলের সমঝোতার লক্ষ্যে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকু'র বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। ঢাকার আসার পর থেকে তিনি প্রায় মাসব্যাপী উভয় দলের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় সংলাপের মধ্যস্থতা করেন। সংলাপের এক পর্যায়ে তিনি একটি ফর্মুলা উত্থাপন করেন। এতে স্যার নিনিয়ান সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলেন। এ সরকারে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের ৫ জন এবং বিরোধী দলের ৫ জন মন্ত্রী থাকবেন। এরা সবাই ওই সময়ের অর্থাত্ ৫ম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত এমপিদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন। এছাড়া বাকি একজন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। যার ওপর স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর ভার ন্যস্ত থাকবে। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপে সহায়তাকারী স্যার নিনিয়ান স্টিফেন সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে পৃথকভাবে আলাপ করে তাদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করে। নিনিয়ানের ওই প্রস্তাব তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা তিনি মানবেন না। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ এনে এবং তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উল্লেখ করে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকু'র কাছে ফ্যাক্স বার্তা পাঠায়। কমনওয়েলথ চিফ এমেকা এনিয়াওকু আওয়ামী লীগের এ অভিযোগ নাকচ করে দেন। পাকিস্তান সফররত কমনওয়েলথ চিফ ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিনিয়ান কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। সব মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে স্যার নিনিয়ান সাংবাদিকদের কাছে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। সহিংসতা ও হাঙ্গামা শুধু ক্ষোভ আর হতাশার পথেই দেশকে নিয়ে যাবে। ব্যর্থ মিশন শেষে তিনি ১৪ নভেম্বর দেশে ফিরে যান। এর আগে ১৯৯৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকু ৫ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। এ সময় তিনি দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন এবং উভয় দলের মধ্যে সংলাপের ভিত্তিতে সঙ্কট নিরসনের প্রস্তাব করেন। প্রয়োজনে তিনি এ ব্যাপারে আবারও বাংলাদেশে আসার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন অথবা বিশেষ দূত পাঠাবেন বলে উল্লেখ করেন। দুই নেত্রী এতে সম্মতি প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সফর শেষে তিনি আলোচনা শুরু করার জন্য দুই নেত্রীর কাছে ফ্যাক্স বার্তা পাঠান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় আসেন।
এসব খবর ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। তখনকার দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো :
সঙ্কটের সমাধান সম্পর্কে আশাবাদী : এমেকা
কূটনৈতিক সংবাদদাতা : বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ অভিহিত করে কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু বলেছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে তিনি সরকার ও বিরোধী দলের কাছে পৃথক পৃথক প্রস্তাব রেখেছেন। গণতান্ত্রিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে এই প্রস্তাব বিশেষ ফলপ্রসূ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে পাঁচ দিনের সফর শেষে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগের আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক সংবাদ সম্মেলনে মি. এমেকা গণতন্ত্রের সম্ভাবনাময় অভিষ্যত্ সম্পর্কে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এ দেশ সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উঁচু ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ, বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে তার আলোচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব আলোচনা অত্যন্ত ফলদায়ক হয়েছে এবং এসব আলোচনা তাকে দেশের বর্তমান সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে। তিনি বলেন, সরকার ও প্রধান বিরোধী দল অবশ্যই একটি সমাধানে উপনীত হবে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ লাভ করবে। এক প্রশ্নের জবাবে এমেকা বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার সঙ্গে একবার এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন।
কোন ইতিবাচক পরিস্থিতি তাকে সঙ্কট নিরসন সম্পর্কে এমন আশাবাদী করে তুলেছে এবং কতদিনে এ সমাধান আসবে জানতে চাওয়া হলে তিনি এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বলেন, কত শিগগির এ সমাধানের সম্ভাবনা আছে—এ কথা তারাই বলতে পারবেন যাদের কাছে এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। (দৈনিক বাংলা : ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪)।
এমেকার ফ্যাক্স পেয়েছি
আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে : হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণকে চালমান রাজনৈতিক ও জাতীয় সঙ্কট সমাধানে দিকনির্দেশনাহীন বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সরকার এবং তার দলের মধ্যে কমনওয়েলথ মাহসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর মধ্যস্থতার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। বুধবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এ কথা বলেন। তিনি দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। শেখ হাসিনা দেশের বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে কমনওয়েলথ মহাসচিবের সঙ্গে তার আলোচনাকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে মন্তব্য করেন। তবে তিনি সঙ্কট উত্তরণে কমনওয়েলথ মহাসচিবের দেয়া প্রস্তাব সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, চিফ এমেকার সম্মতি ছাড়া কিছু বলা ঠিক হবে না। আনফেয়ার হবে। তবে এটুকু বলতে পারি—এটা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। (দৈনিক বাংলা : ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪)।
এমেকার মধ্যস্থতা
হাসিনা-খালেদা সংলাপে রাজি
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা কমনওয়েলথের মধ্যস্থতায় একটি উন্মুক্ত আলোচ্যসূচির অধীনে তাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন। সোমবার কমনওয়েলথের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। খবর বাসস
সরাসরি আলোচনার ব্যাপারে তাদের সম্মতির কথা ঘোষণা করে কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু বলেন, আলোচনার জন্য তাদের কাছে আমি তিন দফা পরিকল্পনা পেশ করেছি। আমি এ কথা বলতে পেরে খুশি যে, এই প্রস্তাবের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা উভয়ের কাছ থেকে আমি সম্মতি পেয়েছি। ...এনিয়াওকু বলেন, উভয় পক্ষের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখছি। আমি আশা করি বিলম্ব ছাড়াই আলোচনা শুরু করা সম্ভব এবং বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে একটি সমঝোতা প্রস্তাবের দিকে আলোচনাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। (দৈনিক বাংলা : ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪)
বিদায়ী বিবৃতি
আমার প্রস্তাবে সরকারি সম্মতিতে খুশি
সহিংসতা হাঙ্গামায় কিছুই অর্জিত হবে না : নিনিয়ান
বিশেষ সংবাদদাতা : সংলাপের সাফল্য সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বলেছেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। এ পথ পরিহারের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামা শুধু ক্ষোভ আর হতাশার পথেই দেশকে নিয়ে যাবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান উত্তেজনা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির নিরসন এখনও সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন রোববার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বিবৃতিতে বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনার পর আমি কিছু প্রস্তাব রেখেছিলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই প্রস্তাবে যদি সবাই সম্মত হতো এবং এগুলো যদি বাস্তবায়িত করা যেত, তবে উভয়পক্ষের উদ্বেগেরই নিরসন হতো এবং বর্তমান অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব হতো। এ প্রসঙ্গে স্যার নিনিয়ান সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সরকারিপক্ষ তার এই প্রস্তাব মেনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, তার এই প্রস্তাব পেশ করা রইল। দু'পক্ষই বিচার-বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনে কিছু সংশোধন করে যথাসময়ে এটি গ্রহণ করবে বলে তিনি আশাবাদী।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ ওই সংবাদ সম্মেলনে স্যার নিনিয়ানকে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি শুধু তার বিবৃতি পাঠ করেন এবং এটি পড়া শেষ হতেই দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করেন। সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগেই স্যার নিনিয়ানের অন্যতম সহকারী ক্রিস্টোফার চাইল্ড সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, স্যার নিনিয়ান কোনো প্রশ্নের জবাব দেবেন না। তাকে কোনো প্রশ্ন না করার জন্য তিনি অনুরোধ জানান। স্যার নিনিয়ান ১০টা ৫ মিনিটে সম্মেলন কক্ষে আসেন। ৫ মিনিট সময় দেয়া হয় আলোকচিত্র সাংবাদিকদের। ছবি তুলে তারা বেরিয়ে গেলে তিনি বিবৃতি পড়া শুরু করেন। বিবৃতি পাঠ করতে তার সময় লাগে ১৩ মিনিট।
উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন গত ১৩ অক্টোবর সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন।
বিবৃতির শুরুতেই তিনি আজ সোমবার তার এবং লেডি স্টিফেনের বাংলাদেশ ত্যাগের কথা ঘোষণা করে বলেন, কমনওয়েলথ মহাসচিবের কাছে তিনি পূর্ণাঙ্গ লিখিত বক্তব্য পেশ করবেন। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি অভাবিত কোনো অগ্রগতি না ঘটে, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার মিশনের সাফল্য সম্পর্কে কিছুই আমি এই রিপোর্টে পেশ করতে পারব না। এই প্রেক্ষিতে আমি দুঃখজনকভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ঢাকায় আমার অব্যাহত উপস্থিতি আর কোনো প্রয়োজনেই আসবে না। তাই আমি এখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের জনগণের আতিথ্যের ভূয়সী প্রশংসা করে স্যার নিনিয়ান বলেন, এমন অতিথিপরায়ণ ও দরদি জাতি তিনি আর কখনও দেখেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই জনগণই হচ্ছে এ দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই শক্তিকে কখনই অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। প্রজ্ঞা ও সহনশীলতা দিয়ে পরিচালিত হলে এই জনগণই বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ অর্জন করে আনবে এবং অতীতে বৈরিতা ও বর্তমানের রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে।
স্যার নিনিয়ান বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এক ক্রান্তিকালে রয়েছে। এ অবস্থায় এদেশের জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক সমঝোতা। এগুলো কায়েম করা গেলেই বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যত্ বংশধরদের জন্য একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে এদেশের মানুষ আত্মনিয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, এ কারণেই আমি আমার মিশনের সাফল্য নিশ্চিত করার ব্যাপারে এত আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু সে কাজে সফল হতে না পেরে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।
বাংলাদেশে আসার পটভূমিকার ব্যাখ্যা করে স্যার নিনিয়ান বিবৃতিতে বলেন, কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা আনিয়াওকুর তিন দফা প্রস্তাব সরকারি ও বিরোধী দল উভয় পক্ষ মেনে নেয়ায় সংলাপ প্রক্রিয়ার যে সূচনা হয়, তাকে সহায়তা করতে মহাসচিবের দূত হিসেবে আমি এখানে আসি। কিন্তু সংলাপে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় আমি অবশ্যই অত্যন্ত হতাশ।
স্যার নিনিয়ান বলেন, এখানকার রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের প্রাথমিক দায়িত্ব বরাবরই এদেশের জনসাধারণের। তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করে বলেন, যেসব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো দূর করলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক তত্পরতা আবার শুরু করা সম্ভব হবে।
স্যার নিনিয়ান বলেন, বাংলাদেশে এসে আমি বলেছিলাম সংলাপ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, এ সুযোগ এখনও রয়েছে। পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস অত্যন্ত গভীর ও দৃঢ় হওয়া সত্ত্বেও বাস্তব সত্য হচ্ছে—পক্ষগুলো এগিয়ে এসেছিল, একটি যুক্তিসঙ্গত বিতর্কে অংশ নিয়েছিল। সহিংসতা-হাঙ্গামার পথ পরিহারের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার দ্বারা কিছুই অর্জিত হয় না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, উত্তেজনা ও সংঘাত পরিস্থিতির নিরসন করা, স্বাভাবিক রাজনৈতিক তত্পরতা আবার শুরু করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা সংহত করা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এখনও সম্ভব বলে তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন।
স্যার নিনিয়ান বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে এ আশা ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র সংবলিত একটি ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বিধানে দেশের নেতারা সক্রিয় উদ্যোগ নেবেন এবং তাদের সে উদ্যোগ অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে।
এমেকার কাছে ফ্যাক্স
বিরোধী দল সোমবার কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর কাছে তার দূত স্যার নিনিয়ানের কিছু মন্তব্য ও আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে ফ্যাক্স প্রেরণ করেছে। স্যার নিনিয়ানের এই আচরণ সংলাপের সর্বসম্মত নীতি বহির্ভূত বলে প্রেরিত ফ্যাক্স বার্তায় উল্লেখ করা হয়। খবর ইউএনবি'র
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এসএএমএস কিবরিয়া সোমবার সন্ধ্যায় ফ্যাক্সে কমনওয়েলথ মহাসচিবের কাছে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করেছেন। জনাব কিবরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রেরিত বার্তায় স্যার নিনিয়ান কর্তৃক সংলাপের এখতিয়ার লঙ্ঘনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এখতিয়ার ও রূপরেখার অধীনে স্যার নিনিয়ান কোনো ধরনের প্রস্তাব দিতে পারেন না। যা তিনি তার সংবাদ সম্মেলনের বিবৃতিতে করেছেন। জনাব কিবরিয়া বলেন, তিনি এখানে এসেছিলেন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি কীভাবে প্রস্তাব পেশ করেন।
জনাব কিবরিয়া বলেন, সংলাপ প্রক্রিয়ার সময় স্যার নিনিয়ানের কেবল সরকারি ও বিরোধীদলীয় প্রস্তাব আদান-প্রদান করার কথা। তিনি বলেন, গত ১৩ নভেম্বর নিনিয়ান বিরোধী দলের কাছে সরকারি দলের প্রস্তাব হস্তান্তর করেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারি ও বিরোধী দলের সম্মত চুক্তি অনুযায়ী যৌথ বিবৃতি ছাড়া কোনো বিবৃতি দেয়া যাবে না। বিবৃতি দিয়ে তিনি এই রূপরেখা লঙ্ঘন করেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কিবরিয়া বলেন, সোমবার সকালে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্যার নিনিয়ানের বৈঠকের সময় এসব কথা ওঠে। নিনিয়ান তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুক্রবার কমনওয়েলথ মাহসচিব এমেকার সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়। মহাসচিব ইসলামাবাদ থেকে তাকে টেলিফোন করেন।
নিনিয়ান কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি : এমেকা
ইসলামাবাদ, ২৪ নভেম্বর (রয়টার্স/এপি)। কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু বৃহস্পতিবার বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্থতার সময় তার দূত কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি। তিনি বলেন, এই মিশনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সেখানে যেতে পারেন।
স্যার নিনিয়ানের মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশের বিরোধী দল এনিয়াওকুর কাছে মঙ্গলবার এক চিঠিতে তার (নিনিয়ানের) বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে। নিনিয়ান সরকার ও বিরোধী দলকে রাজনৈতিক সংলাপে বসাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এনিয়াওকু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিশনের কাজ চলাকালে নিনিয়ান তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তিনি নিরপেক্ষতার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন—এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।
তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট দলগুলো এবং বাংলাদেশের জন্য যা কল্যাণকর—এছাড়া তিনি অন্য কিছু ভাবেননি।
তিনি বলেন, বিরোধী দলসহ সব বাংলাদেশী দল নিনিয়ানের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ শুনে তিনি দুঃখিত হয়েছেন।
এনিয়াওকু বলেন, বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ার মতো সঙ্কটপূর্ণ সমস্যাসঙ্কুল দেশগুলোয় কমনওয়েলথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চায়। তিনি স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ মেটাতে কমনওয়েলথের সাম্প্রতিক মিশন সফল হয়নি। তবে তিনি বলেন, এখনও কমনওয়েলথের ভূমিকা রয়েছে।
নিনিয়ানের কথিত প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় : হাসিনা
সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সুপ্রিমকোর্ট বার-এর সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্টে যান। শেখ হাসিনা দুপুর ১টার দিকে কোর্ট প্রাঙ্গণে যান এবং প্রায় একশ' মিনিট সেখানে অবস্থান করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান তার এই সফরের ইচ্ছার কথা সোমবার সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদককে অবহিত করেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বার সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের 'কথিত' প্রস্তাব সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, এরকম কোনো এজেন্ডা ছিল না। তাই বিরোধী দলের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। খবর বাসস
বিরোধীদলীয় নেত্রী তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, কেয়ারটেকার প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা প্রয়োজনে স্থায়ী ব্যবস্থাকে সমর্থন জানাব।
এসব খবর ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। তখনকার দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো :
সঙ্কটের সমাধান সম্পর্কে আশাবাদী : এমেকা
কূটনৈতিক সংবাদদাতা : বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ অভিহিত করে কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু বলেছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে তিনি সরকার ও বিরোধী দলের কাছে পৃথক পৃথক প্রস্তাব রেখেছেন। গণতান্ত্রিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে এই প্রস্তাব বিশেষ ফলপ্রসূ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে পাঁচ দিনের সফর শেষে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগের আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক সংবাদ সম্মেলনে মি. এমেকা গণতন্ত্রের সম্ভাবনাময় অভিষ্যত্ সম্পর্কে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এ দেশ সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উঁচু ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ, বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে তার আলোচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব আলোচনা অত্যন্ত ফলদায়ক হয়েছে এবং এসব আলোচনা তাকে দেশের বর্তমান সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে। তিনি বলেন, সরকার ও প্রধান বিরোধী দল অবশ্যই একটি সমাধানে উপনীত হবে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ লাভ করবে। এক প্রশ্নের জবাবে এমেকা বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার সঙ্গে একবার এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন।
কোন ইতিবাচক পরিস্থিতি তাকে সঙ্কট নিরসন সম্পর্কে এমন আশাবাদী করে তুলেছে এবং কতদিনে এ সমাধান আসবে জানতে চাওয়া হলে তিনি এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বলেন, কত শিগগির এ সমাধানের সম্ভাবনা আছে—এ কথা তারাই বলতে পারবেন যাদের কাছে এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। (দৈনিক বাংলা : ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪)।
এমেকার ফ্যাক্স পেয়েছি
আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে : হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণকে চালমান রাজনৈতিক ও জাতীয় সঙ্কট সমাধানে দিকনির্দেশনাহীন বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সরকার এবং তার দলের মধ্যে কমনওয়েলথ মাহসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর মধ্যস্থতার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। বুধবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এ কথা বলেন। তিনি দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। শেখ হাসিনা দেশের বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে কমনওয়েলথ মহাসচিবের সঙ্গে তার আলোচনাকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে মন্তব্য করেন। তবে তিনি সঙ্কট উত্তরণে কমনওয়েলথ মহাসচিবের দেয়া প্রস্তাব সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, চিফ এমেকার সম্মতি ছাড়া কিছু বলা ঠিক হবে না। আনফেয়ার হবে। তবে এটুকু বলতে পারি—এটা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। (দৈনিক বাংলা : ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪)।
এমেকার মধ্যস্থতা
হাসিনা-খালেদা সংলাপে রাজি
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা কমনওয়েলথের মধ্যস্থতায় একটি উন্মুক্ত আলোচ্যসূচির অধীনে তাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন। সোমবার কমনওয়েলথের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। খবর বাসস
সরাসরি আলোচনার ব্যাপারে তাদের সম্মতির কথা ঘোষণা করে কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু বলেন, আলোচনার জন্য তাদের কাছে আমি তিন দফা পরিকল্পনা পেশ করেছি। আমি এ কথা বলতে পেরে খুশি যে, এই প্রস্তাবের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা উভয়ের কাছ থেকে আমি সম্মতি পেয়েছি। ...এনিয়াওকু বলেন, উভয় পক্ষের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখছি। আমি আশা করি বিলম্ব ছাড়াই আলোচনা শুরু করা সম্ভব এবং বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে একটি সমঝোতা প্রস্তাবের দিকে আলোচনাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। (দৈনিক বাংলা : ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪)
বিদায়ী বিবৃতি
আমার প্রস্তাবে সরকারি সম্মতিতে খুশি
সহিংসতা হাঙ্গামায় কিছুই অর্জিত হবে না : নিনিয়ান
বিশেষ সংবাদদাতা : সংলাপের সাফল্য সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বলেছেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। এ পথ পরিহারের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামা শুধু ক্ষোভ আর হতাশার পথেই দেশকে নিয়ে যাবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান উত্তেজনা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির নিরসন এখনও সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন রোববার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বিবৃতিতে বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনার পর আমি কিছু প্রস্তাব রেখেছিলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই প্রস্তাবে যদি সবাই সম্মত হতো এবং এগুলো যদি বাস্তবায়িত করা যেত, তবে উভয়পক্ষের উদ্বেগেরই নিরসন হতো এবং বর্তমান অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব হতো। এ প্রসঙ্গে স্যার নিনিয়ান সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সরকারিপক্ষ তার এই প্রস্তাব মেনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, তার এই প্রস্তাব পেশ করা রইল। দু'পক্ষই বিচার-বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনে কিছু সংশোধন করে যথাসময়ে এটি গ্রহণ করবে বলে তিনি আশাবাদী।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ ওই সংবাদ সম্মেলনে স্যার নিনিয়ানকে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি শুধু তার বিবৃতি পাঠ করেন এবং এটি পড়া শেষ হতেই দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করেন। সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগেই স্যার নিনিয়ানের অন্যতম সহকারী ক্রিস্টোফার চাইল্ড সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, স্যার নিনিয়ান কোনো প্রশ্নের জবাব দেবেন না। তাকে কোনো প্রশ্ন না করার জন্য তিনি অনুরোধ জানান। স্যার নিনিয়ান ১০টা ৫ মিনিটে সম্মেলন কক্ষে আসেন। ৫ মিনিট সময় দেয়া হয় আলোকচিত্র সাংবাদিকদের। ছবি তুলে তারা বেরিয়ে গেলে তিনি বিবৃতি পড়া শুরু করেন। বিবৃতি পাঠ করতে তার সময় লাগে ১৩ মিনিট।
উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন গত ১৩ অক্টোবর সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন।
বিবৃতির শুরুতেই তিনি আজ সোমবার তার এবং লেডি স্টিফেনের বাংলাদেশ ত্যাগের কথা ঘোষণা করে বলেন, কমনওয়েলথ মহাসচিবের কাছে তিনি পূর্ণাঙ্গ লিখিত বক্তব্য পেশ করবেন। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি অভাবিত কোনো অগ্রগতি না ঘটে, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার মিশনের সাফল্য সম্পর্কে কিছুই আমি এই রিপোর্টে পেশ করতে পারব না। এই প্রেক্ষিতে আমি দুঃখজনকভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ঢাকায় আমার অব্যাহত উপস্থিতি আর কোনো প্রয়োজনেই আসবে না। তাই আমি এখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের জনগণের আতিথ্যের ভূয়সী প্রশংসা করে স্যার নিনিয়ান বলেন, এমন অতিথিপরায়ণ ও দরদি জাতি তিনি আর কখনও দেখেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই জনগণই হচ্ছে এ দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই শক্তিকে কখনই অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। প্রজ্ঞা ও সহনশীলতা দিয়ে পরিচালিত হলে এই জনগণই বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ অর্জন করে আনবে এবং অতীতে বৈরিতা ও বর্তমানের রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে।
স্যার নিনিয়ান বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এক ক্রান্তিকালে রয়েছে। এ অবস্থায় এদেশের জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক সমঝোতা। এগুলো কায়েম করা গেলেই বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যত্ বংশধরদের জন্য একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে এদেশের মানুষ আত্মনিয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, এ কারণেই আমি আমার মিশনের সাফল্য নিশ্চিত করার ব্যাপারে এত আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু সে কাজে সফল হতে না পেরে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।
বাংলাদেশে আসার পটভূমিকার ব্যাখ্যা করে স্যার নিনিয়ান বিবৃতিতে বলেন, কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা আনিয়াওকুর তিন দফা প্রস্তাব সরকারি ও বিরোধী দল উভয় পক্ষ মেনে নেয়ায় সংলাপ প্রক্রিয়ার যে সূচনা হয়, তাকে সহায়তা করতে মহাসচিবের দূত হিসেবে আমি এখানে আসি। কিন্তু সংলাপে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় আমি অবশ্যই অত্যন্ত হতাশ।
স্যার নিনিয়ান বলেন, এখানকার রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের প্রাথমিক দায়িত্ব বরাবরই এদেশের জনসাধারণের। তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করে বলেন, যেসব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো দূর করলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক তত্পরতা আবার শুরু করা সম্ভব হবে।
স্যার নিনিয়ান বলেন, বাংলাদেশে এসে আমি বলেছিলাম সংলাপ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, এ সুযোগ এখনও রয়েছে। পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস অত্যন্ত গভীর ও দৃঢ় হওয়া সত্ত্বেও বাস্তব সত্য হচ্ছে—পক্ষগুলো এগিয়ে এসেছিল, একটি যুক্তিসঙ্গত বিতর্কে অংশ নিয়েছিল। সহিংসতা-হাঙ্গামার পথ পরিহারের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার দ্বারা কিছুই অর্জিত হয় না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, উত্তেজনা ও সংঘাত পরিস্থিতির নিরসন করা, স্বাভাবিক রাজনৈতিক তত্পরতা আবার শুরু করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা সংহত করা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এখনও সম্ভব বলে তিনি দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন।
স্যার নিনিয়ান বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে এ আশা ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র সংবলিত একটি ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বিধানে দেশের নেতারা সক্রিয় উদ্যোগ নেবেন এবং তাদের সে উদ্যোগ অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে।
এমেকার কাছে ফ্যাক্স
বিরোধী দল সোমবার কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর কাছে তার দূত স্যার নিনিয়ানের কিছু মন্তব্য ও আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে ফ্যাক্স প্রেরণ করেছে। স্যার নিনিয়ানের এই আচরণ সংলাপের সর্বসম্মত নীতি বহির্ভূত বলে প্রেরিত ফ্যাক্স বার্তায় উল্লেখ করা হয়। খবর ইউএনবি'র
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এসএএমএস কিবরিয়া সোমবার সন্ধ্যায় ফ্যাক্সে কমনওয়েলথ মহাসচিবের কাছে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করেছেন। জনাব কিবরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রেরিত বার্তায় স্যার নিনিয়ান কর্তৃক সংলাপের এখতিয়ার লঙ্ঘনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এখতিয়ার ও রূপরেখার অধীনে স্যার নিনিয়ান কোনো ধরনের প্রস্তাব দিতে পারেন না। যা তিনি তার সংবাদ সম্মেলনের বিবৃতিতে করেছেন। জনাব কিবরিয়া বলেন, তিনি এখানে এসেছিলেন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি কীভাবে প্রস্তাব পেশ করেন।
জনাব কিবরিয়া বলেন, সংলাপ প্রক্রিয়ার সময় স্যার নিনিয়ানের কেবল সরকারি ও বিরোধীদলীয় প্রস্তাব আদান-প্রদান করার কথা। তিনি বলেন, গত ১৩ নভেম্বর নিনিয়ান বিরোধী দলের কাছে সরকারি দলের প্রস্তাব হস্তান্তর করেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারি ও বিরোধী দলের সম্মত চুক্তি অনুযায়ী যৌথ বিবৃতি ছাড়া কোনো বিবৃতি দেয়া যাবে না। বিবৃতি দিয়ে তিনি এই রূপরেখা লঙ্ঘন করেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কিবরিয়া বলেন, সোমবার সকালে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্যার নিনিয়ানের বৈঠকের সময় এসব কথা ওঠে। নিনিয়ান তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুক্রবার কমনওয়েলথ মাহসচিব এমেকার সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়। মহাসচিব ইসলামাবাদ থেকে তাকে টেলিফোন করেন।
নিনিয়ান কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি : এমেকা
ইসলামাবাদ, ২৪ নভেম্বর (রয়টার্স/এপি)। কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকু বৃহস্পতিবার বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্থতার সময় তার দূত কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি। তিনি বলেন, এই মিশনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সেখানে যেতে পারেন।
স্যার নিনিয়ানের মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশের বিরোধী দল এনিয়াওকুর কাছে মঙ্গলবার এক চিঠিতে তার (নিনিয়ানের) বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে। নিনিয়ান সরকার ও বিরোধী দলকে রাজনৈতিক সংলাপে বসাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এনিয়াওকু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিশনের কাজ চলাকালে নিনিয়ান তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তিনি নিরপেক্ষতার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন—এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।
তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট দলগুলো এবং বাংলাদেশের জন্য যা কল্যাণকর—এছাড়া তিনি অন্য কিছু ভাবেননি।
তিনি বলেন, বিরোধী দলসহ সব বাংলাদেশী দল নিনিয়ানের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ শুনে তিনি দুঃখিত হয়েছেন।
এনিয়াওকু বলেন, বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ার মতো সঙ্কটপূর্ণ সমস্যাসঙ্কুল দেশগুলোয় কমনওয়েলথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চায়। তিনি স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ মেটাতে কমনওয়েলথের সাম্প্রতিক মিশন সফল হয়নি। তবে তিনি বলেন, এখনও কমনওয়েলথের ভূমিকা রয়েছে।
নিনিয়ানের কথিত প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় : হাসিনা
সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সুপ্রিমকোর্ট বার-এর সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্টে যান। শেখ হাসিনা দুপুর ১টার দিকে কোর্ট প্রাঙ্গণে যান এবং প্রায় একশ' মিনিট সেখানে অবস্থান করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান তার এই সফরের ইচ্ছার কথা সোমবার সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদককে অবহিত করেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বার সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের 'কথিত' প্রস্তাব সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, এরকম কোনো এজেন্ডা ছিল না। তাই বিরোধী দলের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। খবর বাসস
বিরোধীদলীয় নেত্রী তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, কেয়ারটেকার প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা প্রয়োজনে স্থায়ী ব্যবস্থাকে সমর্থন জানাব।
__._,_.___