শচীন দেববর্মণের কুমিল্লার আদি নিবাস কি রক্ষা করা যায় না?
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
উপ-মহাদেশের কিংবদন্তি গায়ক ও সুরকার শচীন দেববর্মণ ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লার চর্থায় এক বিশাল রাজপ্রাসাদসম অট্টালিকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তদানীন্তন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের অর্থানুকূল্যে যুবরাজ নবদ্বীপচন্দ্র বর্মণ ৬০ একর জমিতে, সামনে পিছনে বড় দীঘি ও পৃথক অন্দর মহলসহ, এই ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। শচীনদেবের মা রাজকুমারী নির্মলা দেবী তদানীন্তন মনিপুর রাজ্যের রাজবংশের সদস্য ছিলেন।
চর্থার বাসভবনেই শচীন বাবু তাঁর জীবনের প্রথম ১৯টি বছর অতিবাহিত করেন। স্কুলপর্ব শেষ করে ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গীতের চর্চা চালিয়ে গেলেন। পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র বর্মণ ছিলেন নিপুণ সেতার শিল্পী ও মার্গ সঙ্গীতের গায়ক। মা নির্মলা দেবী ও সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাদের হাতেই শচীনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রথম হাতেখড়ি।
তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা 'সরগমের নিখাদ' থেকে জানা যায়, গ্রামবাংলার লোকসঙ্গীতের প্রতি তাঁকে প্রথম আকৃষ্ট করেন বাড়ির দুই গৃহভৃত্য, মাধব ও আনোয়ার। মাধব সহজ সুর করে রামায়ণ পড়ে শোনাত যা যুবরাজকে করত মোহিত। অপরদিকে আনোয়ার দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি গান গেয়ে তাঁকে গ্রামবাংলায় নিয়ে যেত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার গ্রাম ও গ্রামান্তরে লোক গানের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন শচীন দেব।
পরবর্তীতে তাঁর অনুপম সৃষ্টি হিন্দী ও বাংলা গানগুলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী ভাটিয়ালী, ভাওইয়া, সারি, মুর্শিদী, বাউল, ঝুমুর গানের ভিত্তির ওপর রচিত। শচীন বাবু যে অপূর্ব সঙ্গীত জগৎ তৈরি করেছিলেন তার মূল উপাদান হচ্ছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও আমাদের লোকগীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। পরবর্তীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত তৃতীয় ধারা হিসেবে যোগ দেয়।
চর্থার রাজপ্রাসাদেই গড়ে উঠেছিল সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার এক অপূর্ব মিলন কেন্দ্র। সেখানে আসতেন আলাউদ্দিন খাঁ, হিমাংশু দত্ত ও অন্য দিকপালরা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজুরুল ইসলাম অনেকবার এসেছেন কুমিল¬ার চর্থায় এই রাজপ্রাসাদেও গান গেয়েছেন শচীন দেবের সঙ্গে।
উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯২৫ সালে কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতায় গেলেন শচীন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করলেন। একই সঙ্গে সঙ্গীতের তালিম নিলেন কৃষ্ণ দেব, বাদল খান, ভীষ্ণদেব চট্টোপাধ্যায়, শ্যামলাল ক্ষেত্রী প্রমুখের কাছ থেকে। কলকাতায় তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা নিলেন। তাঁর অনেক হিন্দী গান রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদলে গাওয়া।
১৯৩১ সালে তাঁর বাবা তদানীন্তন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী নবদ্বীপ মৃত্যুবরণ করেন। শচীনবাবু ইচ্ছা করলে ত্রিপুরা বা কুমিল্লায় ফিরে এসে একটি উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজপ্রাসাদেই আরাম আয়েসে দিন কাটাতে পাতেন। কিন্তু সঙ্গীত পাগল শচীন দেব সেই সব প্রলোভন উপেক্ষা করে সঙ্গীতের কঠিন জীবন বেছে নিলেন।
কলকাতার 'ত্রিপুরা প্যালেস' ছেড়ে উঠলেন ভাড়া করা ছোট এক ঘরে। কিন্তু সঙ্গীত জীবনে প্রবেশটা মসৃণ ছিল না। তদানীন্তন সর্ববৃহৎ বেকর্ড প্রস্তুতকারী কোম্পানি এইচএমভির অডিশনে ফেল করলেন শচীন ১৯৩২ সালে। কারণ তাঁর নাঁকি কণ্ঠস্বর ও গানের সুর ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রত্যাখ্যাত শচীন সাধনা চালিয়ে গেলেন ও সার্থক হলেন। ঐ বছরই হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস বের করল শচীনের প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান। পল্লীগীতির আদলে গাওয়া 'ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে' ও ঠুমরী অঙ্গের রাগপ্রধান গান 'এ পথে আজ এসো প্রিয়।' গান দুটি বিপুল জনপ্রিয়তা পেল। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি শচীন দেববর্মণকে।
১৯৩৮ সালে শচীন দেব প্রেম করে বিয়ে করলেন তাঁরই ছাত্রী ও কমলনাথ দাসগুপ্তের দৌহিত্রী সঙ্গীতশিল্পী মীরা ধরকে। শচীন দেবের সঙ্গীত জগতের তিনি ছিলেন আজীবন সাথী। তাঁর অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা মীরা দেবী।
শচীন কর্ত্তা ১৯৪৪ সালে মুম্বাই পাড়ি দিলেন বিখ্যাত বাঙালী চিত্র পরিচালক শশধর মুখার্জীর আমন্ত্রণে। তাঁর সুরারোপিত গান 'মেরা সুন্দর স্বপ্না বীত গ্যায়া' তদানীন্তন বলিউডে বিশাল সাড়া জাগালো। গানটির গায়িকা ছিলেন আমাদের ফরিদপুরের শিল্পী গীতা রায় (পরে দত্ত) একের পর এক হিট গানের সুরকার শচীনবাবু অত্যন্ত কম সময়ে নিজেকে অধিষ্ঠিত করলেন মুম্বাই ফিল্ম জগতের এক দিকপাল হিসেবে। পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হলেন ১৯৬৯ সালে আর শ্রেষ্ঠ গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন ডজন খানেক বার।
কিংবদন্তি গায়ক শচীন দেবের অনেক ভক্ত ছিলেন সারা উপমহাদেশে। তাঁদের মধ্যে একজন তাঁর প্রিয় নাতিকে নামকরণ করলেন তাঁর প্রিয় গায়কের নামে। নাতিটি ক্রিকেট জগতের কিংবদন্তি ব্যাটস্ম্যান শচীন টেন্ডুলকার।
কুমিল্লা থেকে হাজার মাইল দূরে বোম্বাই গিয়েও শচীন দেব বাংলাদেশকে ভুলেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গান গেয়ে আমাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন ও উদ্বাস্তুদের জন্য সাহায্য তহবিল গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালে তাঁর লেখা 'তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল' গানটির মধ্যদিয়ে উজাড় করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি তাঁর সব ভালবাসা। যার শেষ পঙক্তিটি ছিলো 'বাংলা জনম দিলা আমারে, তোমার পরান, আমার পরান, এক নাড়িতে বাঁধারে। মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারও নেই, সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা, বাংলা মায়ের কোল।'
গভীর পরিতাপের বিষয়, শচীন বাবু বাংলাদেশকে না ভুললেও আমরা তাঁকে ভুলে গেছি। বছর কয়েক আগে সস্ত্রীক কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়েছিলাম পুত্রবধূ ডেনা ও নাতি ফয়সালকে নিয়ে। কুমিল্লা আমার প্রিয় শহর। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের জেলা প্রশাসনের ট্রেনিং নিতে এই শহরে আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিলো ১৯৬৯ সালে। এই শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমাকে আজও মোহিত করে।
চর্থার শচীন দেববর্মণের বাসভবনটি দেখতে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানী আমলে তাঁর প্রাসাদসম বাড়িটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় ও সেটা মিলিটারি গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ আমলে প্রথমে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ও বর্তমানে হাঁস-মুরগির খামার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দীঘি দুটিতে মাছের চাষ হচ্ছে। খামারের সরকারী ভবন শচীন বাবুদের আদি রাজপ্রাসাদটি প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সেই ভবনটি পিছন দিক দিয়ে অতি কষ্টে ঢুকে এক জরাজীর্ণ প্রাসাদসম বাড়ির ভগ্নাংশের সামনে দাঁড়াই। মনে হচ্ছিল যুগযুগ অবহেলা ও অযতেœ বাড়িটি যেকোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়বে। ভবনটির বুকে শিলালিপিতে লেখা আছে তার গৌরবময় নাম ও পরিচয়। লেখা আছে কবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে এসেছিলেন ও গান গেয়েছিলেন শচীন দেবের সঙ্গে। সারা বাড়ি ঘিরে রেখেছে জঙ্গল ও হাঁটু সমান উঁচু উঁচু ঘাস।
আমাদের জাতীয় দৈন্য ও উদাসীনতা দেখে রাগে দুঃখে চোখে পানি আসছিল। সারা কুমিল¬া শহরে কি হাঁস-মুরগি ও মাছের খামারের জন্য আর কোন জায়গা ছিল না? এই প্রাসাদসম অট্টালিকা কি সারানো যায় না? এটাকে শচীনবাবুর স্মৃতিভবন হিসেবে গড়া যায় না? শুধু এই ভবনটিকে পুঁজি করে কুমিল্লাকে গড়া যেত উপমহাদেশের এক বিখ্যাত সঙ্গীত কেন্দ্র ও প্রদর্শনশালা হিসেবে। মুম্বাই ও কলকাতার সিনেমা জগতের দিকপালরা আসতেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। প্রতিবছর ১ অক্টোবর লোকগানের এক আর্ন্তজাতিক জলসা বসান যেত এখানে। সেই রাত কুমিল¬ায় ভাল ঘুম হয়নি।
বার বার মনে হয়েছে আমাদের জাতীয় দৈন্য ও উদাসীনতা কি এতটাই অপরিসীম? নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কি এতটাই অক্ষম? সরকার ও কুমিল্লাবাসীর কাছে আমার আকুল আবেদন, এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন ও গড়ে তুলুন শচীন স্মৃতি সঙ্গীত ভবন আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য। সেটাই হবে আমাদের সুযোগ্য সন্তান শচীন দেবের প্রতি আমাদের যোগ্য সম্মান।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব।
চর্থার বাসভবনেই শচীন বাবু তাঁর জীবনের প্রথম ১৯টি বছর অতিবাহিত করেন। স্কুলপর্ব শেষ করে ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গীতের চর্চা চালিয়ে গেলেন। পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র বর্মণ ছিলেন নিপুণ সেতার শিল্পী ও মার্গ সঙ্গীতের গায়ক। মা নির্মলা দেবী ও সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাদের হাতেই শচীনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রথম হাতেখড়ি।
তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা 'সরগমের নিখাদ' থেকে জানা যায়, গ্রামবাংলার লোকসঙ্গীতের প্রতি তাঁকে প্রথম আকৃষ্ট করেন বাড়ির দুই গৃহভৃত্য, মাধব ও আনোয়ার। মাধব সহজ সুর করে রামায়ণ পড়ে শোনাত যা যুবরাজকে করত মোহিত। অপরদিকে আনোয়ার দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি গান গেয়ে তাঁকে গ্রামবাংলায় নিয়ে যেত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার গ্রাম ও গ্রামান্তরে লোক গানের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন শচীন দেব।
পরবর্তীতে তাঁর অনুপম সৃষ্টি হিন্দী ও বাংলা গানগুলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী ভাটিয়ালী, ভাওইয়া, সারি, মুর্শিদী, বাউল, ঝুমুর গানের ভিত্তির ওপর রচিত। শচীন বাবু যে অপূর্ব সঙ্গীত জগৎ তৈরি করেছিলেন তার মূল উপাদান হচ্ছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও আমাদের লোকগীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। পরবর্তীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত তৃতীয় ধারা হিসেবে যোগ দেয়।
চর্থার রাজপ্রাসাদেই গড়ে উঠেছিল সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার এক অপূর্ব মিলন কেন্দ্র। সেখানে আসতেন আলাউদ্দিন খাঁ, হিমাংশু দত্ত ও অন্য দিকপালরা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজুরুল ইসলাম অনেকবার এসেছেন কুমিল¬ার চর্থায় এই রাজপ্রাসাদেও গান গেয়েছেন শচীন দেবের সঙ্গে।
উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯২৫ সালে কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতায় গেলেন শচীন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করলেন। একই সঙ্গে সঙ্গীতের তালিম নিলেন কৃষ্ণ দেব, বাদল খান, ভীষ্ণদেব চট্টোপাধ্যায়, শ্যামলাল ক্ষেত্রী প্রমুখের কাছ থেকে। কলকাতায় তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা নিলেন। তাঁর অনেক হিন্দী গান রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদলে গাওয়া।
১৯৩১ সালে তাঁর বাবা তদানীন্তন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী নবদ্বীপ মৃত্যুবরণ করেন। শচীনবাবু ইচ্ছা করলে ত্রিপুরা বা কুমিল্লায় ফিরে এসে একটি উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজপ্রাসাদেই আরাম আয়েসে দিন কাটাতে পাতেন। কিন্তু সঙ্গীত পাগল শচীন দেব সেই সব প্রলোভন উপেক্ষা করে সঙ্গীতের কঠিন জীবন বেছে নিলেন।
কলকাতার 'ত্রিপুরা প্যালেস' ছেড়ে উঠলেন ভাড়া করা ছোট এক ঘরে। কিন্তু সঙ্গীত জীবনে প্রবেশটা মসৃণ ছিল না। তদানীন্তন সর্ববৃহৎ বেকর্ড প্রস্তুতকারী কোম্পানি এইচএমভির অডিশনে ফেল করলেন শচীন ১৯৩২ সালে। কারণ তাঁর নাঁকি কণ্ঠস্বর ও গানের সুর ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রত্যাখ্যাত শচীন সাধনা চালিয়ে গেলেন ও সার্থক হলেন। ঐ বছরই হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস বের করল শচীনের প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান। পল্লীগীতির আদলে গাওয়া 'ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে' ও ঠুমরী অঙ্গের রাগপ্রধান গান 'এ পথে আজ এসো প্রিয়।' গান দুটি বিপুল জনপ্রিয়তা পেল। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি শচীন দেববর্মণকে।
১৯৩৮ সালে শচীন দেব প্রেম করে বিয়ে করলেন তাঁরই ছাত্রী ও কমলনাথ দাসগুপ্তের দৌহিত্রী সঙ্গীতশিল্পী মীরা ধরকে। শচীন দেবের সঙ্গীত জগতের তিনি ছিলেন আজীবন সাথী। তাঁর অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা মীরা দেবী।
শচীন কর্ত্তা ১৯৪৪ সালে মুম্বাই পাড়ি দিলেন বিখ্যাত বাঙালী চিত্র পরিচালক শশধর মুখার্জীর আমন্ত্রণে। তাঁর সুরারোপিত গান 'মেরা সুন্দর স্বপ্না বীত গ্যায়া' তদানীন্তন বলিউডে বিশাল সাড়া জাগালো। গানটির গায়িকা ছিলেন আমাদের ফরিদপুরের শিল্পী গীতা রায় (পরে দত্ত) একের পর এক হিট গানের সুরকার শচীনবাবু অত্যন্ত কম সময়ে নিজেকে অধিষ্ঠিত করলেন মুম্বাই ফিল্ম জগতের এক দিকপাল হিসেবে। পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হলেন ১৯৬৯ সালে আর শ্রেষ্ঠ গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন ডজন খানেক বার।
কিংবদন্তি গায়ক শচীন দেবের অনেক ভক্ত ছিলেন সারা উপমহাদেশে। তাঁদের মধ্যে একজন তাঁর প্রিয় নাতিকে নামকরণ করলেন তাঁর প্রিয় গায়কের নামে। নাতিটি ক্রিকেট জগতের কিংবদন্তি ব্যাটস্ম্যান শচীন টেন্ডুলকার।
কুমিল্লা থেকে হাজার মাইল দূরে বোম্বাই গিয়েও শচীন দেব বাংলাদেশকে ভুলেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গান গেয়ে আমাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন ও উদ্বাস্তুদের জন্য সাহায্য তহবিল গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালে তাঁর লেখা 'তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল' গানটির মধ্যদিয়ে উজাড় করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি তাঁর সব ভালবাসা। যার শেষ পঙক্তিটি ছিলো 'বাংলা জনম দিলা আমারে, তোমার পরান, আমার পরান, এক নাড়িতে বাঁধারে। মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারও নেই, সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা, বাংলা মায়ের কোল।'
গভীর পরিতাপের বিষয়, শচীন বাবু বাংলাদেশকে না ভুললেও আমরা তাঁকে ভুলে গেছি। বছর কয়েক আগে সস্ত্রীক কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়েছিলাম পুত্রবধূ ডেনা ও নাতি ফয়সালকে নিয়ে। কুমিল্লা আমার প্রিয় শহর। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের জেলা প্রশাসনের ট্রেনিং নিতে এই শহরে আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিলো ১৯৬৯ সালে। এই শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমাকে আজও মোহিত করে।
চর্থার শচীন দেববর্মণের বাসভবনটি দেখতে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানী আমলে তাঁর প্রাসাদসম বাড়িটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় ও সেটা মিলিটারি গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ আমলে প্রথমে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ও বর্তমানে হাঁস-মুরগির খামার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দীঘি দুটিতে মাছের চাষ হচ্ছে। খামারের সরকারী ভবন শচীন বাবুদের আদি রাজপ্রাসাদটি প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সেই ভবনটি পিছন দিক দিয়ে অতি কষ্টে ঢুকে এক জরাজীর্ণ প্রাসাদসম বাড়ির ভগ্নাংশের সামনে দাঁড়াই। মনে হচ্ছিল যুগযুগ অবহেলা ও অযতেœ বাড়িটি যেকোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়বে। ভবনটির বুকে শিলালিপিতে লেখা আছে তার গৌরবময় নাম ও পরিচয়। লেখা আছে কবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে এসেছিলেন ও গান গেয়েছিলেন শচীন দেবের সঙ্গে। সারা বাড়ি ঘিরে রেখেছে জঙ্গল ও হাঁটু সমান উঁচু উঁচু ঘাস।
আমাদের জাতীয় দৈন্য ও উদাসীনতা দেখে রাগে দুঃখে চোখে পানি আসছিল। সারা কুমিল¬া শহরে কি হাঁস-মুরগি ও মাছের খামারের জন্য আর কোন জায়গা ছিল না? এই প্রাসাদসম অট্টালিকা কি সারানো যায় না? এটাকে শচীনবাবুর স্মৃতিভবন হিসেবে গড়া যায় না? শুধু এই ভবনটিকে পুঁজি করে কুমিল্লাকে গড়া যেত উপমহাদেশের এক বিখ্যাত সঙ্গীত কেন্দ্র ও প্রদর্শনশালা হিসেবে। মুম্বাই ও কলকাতার সিনেমা জগতের দিকপালরা আসতেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। প্রতিবছর ১ অক্টোবর লোকগানের এক আর্ন্তজাতিক জলসা বসান যেত এখানে। সেই রাত কুমিল¬ায় ভাল ঘুম হয়নি।
বার বার মনে হয়েছে আমাদের জাতীয় দৈন্য ও উদাসীনতা কি এতটাই অপরিসীম? নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কি এতটাই অক্ষম? সরকার ও কুমিল্লাবাসীর কাছে আমার আকুল আবেদন, এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন ও গড়ে তুলুন শচীন স্মৃতি সঙ্গীত ভবন আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য। সেটাই হবে আমাদের সুযোগ্য সন্তান শচীন দেবের প্রতি আমাদের যোগ্য সম্মান।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব।
__._,_.___