প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০:০০ |
ইতিহাস প্রসিদ্ধ 'মীর জাফর আলী খান'কে সবাই চিনতে না পারলেও মীর জাফরকে চেনে না এমন একজনকেও সুবে বাংলায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তিনি সর্বজন পরিচিত।
সিরাজউদ্দৌলাকে রাজনৈতিক কৌশলে পরাজিত করে মীর জাফর আলী খান নিজে নবাবির আসনে বসবেন- এর পেছনের যুক্তিটাও কিন্তু ওই সময়ের অতীতের আলোকে একেবারে অযৌক্তিক ছিল না। তাই অতীতের পথে একটু পর্যটন করা প্রয়োজন। সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ নবাব আলীবর্দী খাঁও কিন্তু নিজ মনিব সুজাউদ্দৌলার ছেলে সফর রাজ খানকে হত্যার মাধ্যমে সিংহাসনচ্যুত করে সে রক্তাক্ত পথ দিয়ে হেঁটে এসে বাংলার সিংহাসন দখল করে নিয়েছিলেন। আর সেই আলীবর্দী খাঁর সূত্র ধরেই তো সিরাজউদ্দৌলার নবাবি পাওয়া। ইতিহাসের ব্যাখ্যাটা ঠিক এরূপ ছিল। ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। ভোরের আলো তখনও ফুটে উঠেনি। ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকানন। শুরু হয় ইংরেজদের সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার মরণপণ যুদ্ধ। কিন্তু নবাবের প্রধান সোনাপতি মীর জাফর আলী খান নিজে নবাবির আসনে বসার উচ্চ মনোবাসনার লোভে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধাচরণ করে বসলেন। সিরাজউদ্দৌলাকে কৌশলে যুদ্ধে পরাজিত করা হলো। তারপর ২৬ জুন ১৭৫৭ সাল। মীর জাফর আলী খানের নবাবি আসনে বসার জমকালো অভিষেক অনুষ্ঠান হলো। ২৯ জুন ১৭৫৭ বাংলা বিহার উড়িষ্যার অর্থাৎ সুবে বাংলার নবাবের সিংহাসনে আসীন হলেন মীর জাফর আলী খান। ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করলেন না। তিনি মীর জাফর আলী খানকে ঠিকই নতশিরে কুর্নিশ করে তার নবাবি মেনে নিলেন। দিলি্লর সম্রাট কর্তৃক মনোনীত বাংলার শেষ সুবাদার মুর্শিদকুলি খানের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তার একমাত্র কন্যা জিনাত-উন-নেছার পুত্র সরফরাজ খানকে বাংলার মসনদের উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তারপর ১৭২৭ সালের ৩০ জুন মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যু হওয়ার পর পূর্ব ঘোষণামতে সরফরাজ খান বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহ মানুষকে বিবেকহীনভাবে অমানুষ করে তোলে। সরফরাজ খানের স্বীয় পিতা সুজাউদ্দৌলা ছিলেন তখন উড়িষ্যার সহকারী সুবাদার। নিজ পুত্র সরফরাজ খান বাংলার মসনদে আরোহণ করেছেন এমন একটা খুশির সংবাদ শুনে তো তার আনন্দ-উল্লাস করার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনা ঘটল তার উল্টো। সরফরাজ খান বাংলার মসনদে আরোহণ করেছেন এ সংবাদ পেয়ে তিনি হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। আর তাই তো তিনি নিজ ঔরসজাত সন্তানকে বাংলার নবাবি মসনদ থেকে উচ্ছেদ করার জন্য দুই উপদেষ্টা হাজী আহম্মেদ ও সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ আলীবর্দী খাঁকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্যে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। তারপর নিজ পুত্রকে সিংহাসন ত্যাগ করতে বলেন। সরফরাজ খান বাংলার মসনদ ত্যাগ করেন। সে সুযোগে নির্লজ্জের মতো সরফরাজ খানের ক্ষমতালোভী পিতা সুজাউদ্দৌলা বাংলার মসনদে আরোহণ করেছিলেন। তাই তো অতীত সাক্ষ্য দেয় রাজনীতিতে কোনো পিতা-পুত্র নেই। এভাবেই সরফরাজ খানের ক্ষমতালোভী পিতা সুজাউদ্দৌলা বাংলার মসনদে আরোহণ করে অবশেষে ১৭৩৯ সালের ১৩ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুও যেন তার কাছে ছিল ঐশ্বরিক এক আশীর্বাদ। সরফরাজ খান আবার বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে গিয়ে বসলেন। যদিও সরফরাজ খানের সৎ ভাই ত্বকী খান বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদের দাবিদার ছিলেন; কিন্তু সরফরাজ খান মসনদে আরোহণ করার আগেই ত্বকী খান মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে রক্ষা। এরপর ক্ষমতার লোভে আলীবর্দী খাঁও সুজাউদ্দৌলার মতো পাগল হয়ে উঠলেন। হোক না সরফরাজ খান তার সম্পর্কে ভাতিজা। হোক না মনিবের ছেলে। একসময় শুরু হয় সরফরাজ-আলীবর্দী খাঁর মরণপণ যুদ্ধ। যুদ্ধে সরফরাজ খান পরাজিত হন এবং যুদ্ধের মাঠেই নির্মমভাবে নিহত হন। বাংলার নবাবি আসনে বসলেন আলীবর্দী খাঁ। তিনি নবাবি চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু তারও কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তিনি নাতি সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবি দেয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু ঘসেটি বেগম গোপনে গোপনে সিরাজউদ্দৌলার আপন ভাই একরামুদ্দৌলাকে নবাব বানানোর জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। এদিকে আলীবর্দী খাঁ তার ভাতিজা ও জামাতা নওয়াজিশ আলী খানকে ঢাকার শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন। কিন্তু নওয়াজিশ আলী খান গুরুতর অসুস্থ থাকার কারণে তার অন্যতম নিকটজন হুসেনকুলি খানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এদিকে ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্রের কপালেও দুর্ভাগ্য নেমে আসে। বসন্ত রোগে একরামুদ্দৌলা মারা গেলেন। সেইসঙ্গে মারা যেতে থাকে ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্রের স্বপ্ন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের তো অত সহজে মৃত্যু হয় না। আর সেই সূত্র ধরেই ষড়যন্ত্র থেমে থাকল না। ঘসেটি বেগম হুসেনকুলি খানের মাধ্যমে সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলার নাকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ চলে আসে। সিরাজউদ্দৌলা পথের কাঁটা সরানোর জন্য নানা আলীবর্দী খাঁর রাজপ্রাসাদেই হুসেনকুলি খানকে আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু আলীবর্দী খাঁর ইশারা ছিল এ কাজ প্রাসাদে নয়। আলীবর্দী খাঁর সেই ইশারাই শেষ অবধি শিরোধার্য হলো। ১৭৫৪ সালের এপ্রিল মাসের এক গভীর রাতে হুসেনকুলি খান মুর্শিদাবাদের রাস্তায় খুন হন। সকালে রাস্তায় তার লাশ পাওয়া গেল। ষড়যন্ত্র যত বাধাগ্রস্ত হয়, ষড়যন্ত্রের ডালপালা তত বিস্তার লাভ করতে থাকে। ঘসেটি বেগমের আরেক হাতিয়ার তার আরেক বোনের ছেলে শওকত জং। তিনি শওকত জংকে সিরাজের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে ষড়যন্ত্রের উনুনে নিয়মিত বাতাস দিতে থাকলেন। এদিকে আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে আসীন হন। ঘসেটি বেগম রাজা রাজ বল্লভকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের প্রথম অাঁতাত গড়তে থাকেন। সে হিসেবে মীর জাফরের কাঁধে সব দোষের পাহাড় চাপানো হবে কেন? ইতিহাস বলে, টাকা অনেককে কাকা ডাকতে বাধ্য করে। শওকত জংও টাকাকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি দিলি্লর বাদশাহের উজিরকে কোটি টাকা উৎকোচ দিয়ে নবাবি সনদ ও সিরাজকে উৎখাতের লিখিত অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন। শওকত জংয়ের সঙ্গে পুর্ণিয়ার যুদ্ধে সেদিন যদি সিরাজের আপন খালাতো ভাই শওকত জংয়ের কাছে সিরাজ পরাজিত হতেন এবং শওকত জংয়ের হাতে যদি তাকে জীবন দিতে হতো তাহলে ইতিহাসের লেখাটা কেমন হতে পারত? এ গল্পটা অবশ্য সে কালের রাজনীতির গল্প। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, সেকালের রাজনীতির মৌলিকত্বের সঙ্গে একালের রাজনীতির পার্থক্য কোথায়? আসলে কোনো পার্থক্য নেই। শত শত বছর পর দেশে দেশে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণ শুধু শাব্দিক সৌন্দর্যেই ভরপুর নয় কী?
* লিয়াকত আলী বাবু
আইনজীবী।
ঘসেটি বেগম
__._,_.___