খন্দকার থেকে খন্দকার, অন্ধকার থেকে অন্ধকার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সর্বজনীন আক্রমণের সহজতম লক্ষ্যবস্তু। জীবিত মুজিব ছিলেন দয়ার শরীর, তিনি রূঢ় হতে পারেননি ঘোরতর শত্রুর প্রতিও। মৃত মুজিবও ইঁদুর-বাঁদর-চামচিকেদের আক্রমণের নিরাপদতম বস্তু। মৃত মুজিবকে একটি খামচি মারতে পারলে ক্ষণিকের জন্য ইঁদুরও কুমির হয়ে যায়, বাঁদরও বাঘ হয়ে যায়, চামচিকে হয় হাতি।
জিয়াপরিবারের কারো নিজস্ব কোনো আলো নেই। মুজিব নামক সূর্য থেকে কৌটো-কৌটো আলো খামচে নিয়ে জিয়াপরিবারকে আলোকিত হতে হয়। পঁচিশে মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হবার আগে মুজিব দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এসে এখানে এক-কামড় ভাগ বসিয়ে তৎকালীন অখ্যাত এক ভুঁইফোঁড় মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে দিল। পনেরোই আগস্ট মুজিব খুন হলেন, মুজিবের নামের সাথে নিজের নামটি যেনতেনভাবে উচ্চারিত হবার জন্য পনেরোই আগস্ট নিজের জন্মদিন পাতিয়ে বসলেন বিশ্বের একমাত্র পাঁচ-জন্মদিনধারী মানবী বেগম খালেদা জিয়া। এমনকি তার সুপুত্র তারেক রহমানও মুজিবের সূর্যালোকে খামচি মারতে ভুল করেননি। তারেক মুজিবকে 'অবৈধ রাষ্ট্রপতি' বলেই ক্ষান্ত হননি, মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণপ্রদানের দিন সাতই মার্চকে ইদানীং তিনি পালন করাচ্ছেন তার 'কারাবন্দি দিবস' হিশেবে! অর্থাৎ মুজিবসংশ্লিষ্ট যেকোনো ঐতিহাসিক তারিখে সারমেয়সুলভ কামড় বসিয়ে পাদপ্রদীপের একটুখানি আলোয় আসছে জিয়াপরিবার!
আওয়ামি লিগে পরিত্যক্ত-ব্রাত্য-বঞ্চিত হবার পর একেকজন প্রাক্তন আওয়ামি লিগার আলোচনায় আসার জন্য বেছে নেন ঐ মুজিবকেই। কেবল জিয়াপরিবারের কাছে নয়, মৃত মুজিবের মাংস প্রাক্তন আওয়ামি লিগারদেরও প্রিয় খাদ্য! প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকি নষ্ট-নষ্টতর-নষ্টতম হবার পর, গণমানুষের কাছ থেকে 'নব্য রাজাকার' খেতাব পাবার পর; নিজেকে সাধু প্রমাণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন মুজিবকেই। কাদের বলেছিলেন, 'আমি রাজাকার হলে শেখ মুজিব রাজাকারের কমান্ডার!' নিজের মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী অপকর্মের সাফাই দিতে মুজিবকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করতে লজ্জাও করেনি এই নষ্ট বীরউত্তমটির!
জোহরা তাজউদ্দিন আমৃত্যু আওয়ামি লিগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি; জীবদ্দশায় মুজিব সম্পর্কে তিনি একটি নেতিবাচক কথাও উচ্চারণ করেননি। উচ্চারণ করেছেন তার কন্যা শারমিন আহমদ, তাও তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে। জোহরার জীবদ্দশায় শারমিন মুজিবের ব্যাপারে এই উদ্ভট লেখনীর সাহস পাননি। শারমিন সারা জীবনে কখনও জাতীয়ভাবে আলোচিত না হলেও মুজিবকে নিয়ে কিছু কটূক্তি করে পাদপ্রদীপের এক পোয়া আলো ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছেন!
মুজিব নামক সমুদ্রটিতে একটি ঢিল ছুঁড়ে, মুজিব নামক সূর্যটি থেকে এক ছটাক আলো খামচে নিয়ে এভাবেই একটুখানি আলোচনায় এসে তৃপ্তিতে বগল বাজিয়েছেন অজস্র অর্বাচীন। এবার মুজিবসাগরে ঢিল মেরেছেন এক প্রাচীন প্রবীণ। প্রবীণটি হেলাফেলাযোগ্য কেউ নন। তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি, ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত একমাত্র ব্যক্তিও তিনি। তিনি আবদুল করিম খন্দকার। করিম সম্প্রতি তার আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন মুজিব সাতই মার্চের ভাষণ শেষ করেছেন 'জিয়ে পাকিস্তান' বলে। করিমের বক্তব্যকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, তাকে খুলখাল্লাম গালিগালাজ করারও সুযোগ নেই। সামরিক দিক থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড, তিনি বীরউত্তম, তিনি সেক্টর কমান্ডার ফোরামের প্রধান এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও একজন অগ্রদূত। মুক্তিযোদ্ধা করিমের অবদান নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও কূটনীতিক করিম বা রাজনীতিক করিমকে খুব-একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখার অবকাশ নেই। আমার চোখে মওদুদ আহমদের সাথে রাজনীতিক করিমের খুব-একটা পার্থক্য নেই। মওদুদ মুজিবের আমলে পোস্টমাস্টার জেনারেল ছিলেন; জিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী, এরশাদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন; ছিলেন খালেদার আইনমন্ত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশে মওদুদ একমাত্র হাসিনা সরকারেরই কিছু ছিলেন না। আবদুল করিম জিয়ার আমলে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এরশাদের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন হাসিনারও পরিকল্পনামন্ত্রী। এমনকি মুজিবহত্যার পর করিম মোশতাক সরকারকেও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন! অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে করিম একমাত্র খালেদা সরকারেরই কিছু ছিলেন না। জিল্লুর রহমানের প্রয়াণের পর আবদুল করিমেরও নাকি খায়েশ ছিল রাষ্ট্রপতি হবার। রাষ্ট্রপতি না হতে পারার দুঃখে কিংবা পরবর্তীতে খালেদা ক্ষমতায় এলে খালেদার মন্ত্রিসভায় ঢুকে কোটা পূরণের আশায় করিম মুজিবকে নিয়ে বিতর্কিত উক্তি করছেন কি না, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার।
আওয়ামি লিগের প্রচার সেল নবতীপর বুড়োর মাঢ়ির দাঁতের চেয়েও দুর্বল। মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যত গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার হচ্ছে, এর উপযুক্ত জবাব দিয়ে সহজ ভাষায় কিছু বই লিখে মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা প্রয়োজন; প্রয়োজন এলাকায়-এলাকায় জবাবমূলক প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের। লুটপাটে ব্যস্ত নেতারা এসবের কিছুই না করে কিছু গালিগালাজ করে চুপ মেরে যান, ফাঁকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে গোয়েবলসদের মিথ্যাচার। জবাবটা করিমকে দিয়েই শুরু হোক। তিনি এখনও আওয়ামি লিগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। তাকে ডাকা হোক, ডাকা হোক সাতই মার্চের জনসভায় মঞ্চে থাকা মুজিববাহিনী-নেতা তোফায়েল আহমেদকে। তাদের দুজনকে টেলিভিশনবিতর্কে বসিয়ে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হোক, করিমকে তার বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ হাজির করতে বলা হোক। এভাবে গণবিতর্কের মাধ্যমে একে-একে নিষ্পত্তি করা হোক মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উত্থাপিত সব বিতর্ক। প্রজন্মকে উপহার দেয়া হোক এক ও অভিন্ন ইতিহাস।
আমাদের যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে, তারা মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে খণ্ডিত-বিকৃত-গলিত-স্বরচিত ইতিহাস দেখতে-দেখতে ক্লান্ত। মুক্তিযুদ্ধের মহারথীরা যখন মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একেকজন একেক কথা বলেন, তখন আমরা বিভ্রান্ত ও অসহায় হয়ে যাই। মহারথীদের এই কামড়াকামড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজন্ম যদি মুক্তিযুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে এর দায়ে মহারথীদেরকে একদিন ইতিহাসের মরণোত্তর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হবে অতি ভয়াবহ!
__._,_.___