গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশ-গ্রহণমূলক না হওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেমন বিদেশিদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হয় নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপিও। কোন প্রেক্ষাপটে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর তা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত ছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিদেশি কূটনীতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অতিথিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঢাকা সফরকালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গও তোলেন। জাপানি প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ছাড়ার আগে তাঁর কার্যালয়ের মুখপাত্র কেনকো সোনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'এটি ছিল একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ। সেখানে তাঁরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি (বাংলাদেশের) নিয়ে নয়, বরং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়েই বেশি আলোচনা করেন।' তিনি বলেন, তবে বিএনপি চেয়ারপারসন জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইনের শাসনের অভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অন্যদিকে শিনজো আবে আশা করেন, রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার নিয়ে খালেদা জিয়া যখন কথা বলছিলেন তখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন- 'আপনি কেন নির্বাচনে যাননি?'
জবাবে খালেদা জিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি পূরণ না হওয়া ও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার জোরালো আশঙ্কার কথা জানান।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, খালেদা জিয়ার এ অবস্থান পুরনো হলেও একে 'পরস্পরবিরোধী' বলেই মনে করে আসছেন বিদেশিরা। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও পরে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে গেছে। সেখানে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই দলটি ভালো ফল পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত জুন মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় যে বার্তা এসেছে তা হলো, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনই ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায়। নির্বাচন বর্জন কখনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আনবে না।
গত মে মাসে ঢাকা সফরকারী মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদও বলে গেছেন, নির্বাচন ও ফলাফল বর্জন কোনো সমাধান নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশ ও জাতির জন্যও কল্যাণকর নয়। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই নিজস্ব অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার সময় ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি এড়িয়ে চলা উচিত। দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল হতে হবে।
লড়াইটা হোক রিংয়েই : বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশের একজন কূটনীতিক নির্বাচন ও সংসদকে 'বঙ্ংি রিং'-এর সঙ্গে তুলনা করে বলেন, লড়াইটা রিংয়েই হওয়া প্রয়োজন। অথচ এ দেশে যে দলই বিরোধী দলে থাকুক না কেন, তারা রিংয়ে নয়, বাইরে লড়াইয়ের চেষ্টা করে।
রিংয়ের বাইরে বঙ্ংি খেলা হলে যেমন দর্শক ও আশপাশের লোকজনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে, এ দেশের অবস্থা সে রকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কূটনীতিক বলেন, এখানে আসার আগেই তিনি শুনেছেন যে এ দেশে বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদে যান না। অধিবেশন বর্জন করেন। অথচ তাঁদের ওপর জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যাশা আছে। তাঁরা সেগুলোর কোনো পরোয়াই করেন না।
'অংশগ্রহণমূলক' নির্বাচন না হওয়ার দায় উভয় দলেরই : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, কে ক্ষমতায় এলো আর কে গেল, তা নিয়ে তাঁর দেশের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে যেহেতু তাঁরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, তাই তাঁরা চান এ দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হোক ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভোটারদের মত গুরুত্ব পাক। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। এটিই বড় হতাশার। আর এর জন্য দায়ী বড় দুই দল। কারণ তারা সব দল বা বড় দলগুলোর সবার অংশগ্রহণের অনুকূল কাঠামোর বিষয়ে একমত হতে পারেনি। তাদের ব্যর্থতার জন্যই ভোটাররা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি।
আত্মঘাতী বা ধ্বংসাত্মক কোনো সিদ্ধান্ত নয় : জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঢাকা সফরে তাঁর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ২১ জন শীর্ষ ব্যবসায়ী-প্রধান নির্বাহী। তাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান মুখপাত্র কুমি সাতোর মতে, বাংলাদেশের প্রতি আস্থা রেখে জি-৭-এর (বিশ্বের শিল্পোন্নত সাতটি দেশের জোট) সদস্য জাপানের বড় পরিসরে এগিয়ে আসাকে বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারবে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলোও বলেছে, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সফর বাংলাদেশের দিক থেকেও ছিল অত্যন্ত সফল ও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ-আগ্রহ দেখে আরো অনেক দেশ এগিয়ে আসতে পারে। তবে জাপান সুস্পষ্টভাবেই কিছু বাধা দূর করে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের তাগিদ দিয়েছে। জাপানের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসতে প্রস্তুত। এখন ওই বাধাগুলো দূর করে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের দায়িত্ব বাংলাদেশের। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগের জন্য অপরিহার্য।
রাজনৈতিক দলগুলোরই দায়িত্ব- মাহাথির : কূটনীতিকরা গত মে মাসে ঢাকা সফরকারী মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেন। মাহাথির মোহাম্মদ ঢাকায় বলেছেন, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করাটা রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এর ওপরই বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভর করে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই দেশের উন্নয়ন হবে।
__._,_.___