একি, আমার রসিকতাটা শেষ পর্যন্ত এমন সত্য হয়ে উঠবে এবং আমাকে একই সঙ্গে পুরো জাতিকে বাণবিদ্ধ করে বাকহীন করে তুলবে, তা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এশীয় ক্রিকেটে তামিম, শাকিবের কাক্সিক্ষত ভাল রান তুলতে থাকার প্রক্রিয়া কিছুটা যখন থমকে গেল ওরা আউট হয়ে চলে গেল, তখন হঠাৎ দেখি টেলিভিশনের পর্দায় অভাবিত ও অদৃষ্টপূর্ব এক দৃশ্য বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্রিকেট খেলার মাঠে উপস্থিত হয়েছেন! একি, এই ভদ্রমহিলা খেলাটাকে তো মাটি করে দেবেন। ইনি যখন এসেছেন, তখন বাঙালীরা হারবে, পাকিরা জিতে যাবে বলে উঠলাম আমি। তখন সত্যি সত্যি ব্যাটিংরত নাসির হোসেন রান করতে অক্ষম হয়ে পড়ল! বল ব্যাটেই লাগাতে পারছিল না, সুতরাং রান উঠবে কিভাবে! দু'পাশের দুই বাঙালী ব্যাটসম্যান কিন্তু ঠিক এই সময় থেকেই খেলতে অপরাগ হয়ে উঠল! কিছুক্ষণ আগেই যে টিমটি পাকিস্তানের আগ্রাসী ব্যাটসম্যানদের দু'শ' বত্রিশ রানে বেঁধে ফেলল, দু'দিন আগে ভারতের তিন শ' ছত্রিশ রান অতিক্রম করে ভারতকে হারাল, শক্তিশালী শ্রীলঙ্কা টিমকেও হারিয়ে দিল, একটু আগেও বেশ ভাল রান উঠছিল, হঠাৎ অদ্ভুত এক রানখরায় আক্রান্ত হলো বাংলাদেশ! ওভার শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ কোন রান হচ্ছে না! এমন কি খেলায় এ রকম কোন কোন সময় আসে, তখন যে খেলোয়াড় ব্যাটে-বলে ঠিকমতো লাগিয়ে রান তুলতে পারে না, তাদের ক্যাচ তুলে আউট হয়ে পরের খেলোয়াড়কে দ্রুত সুযোগ করে দিতে দেখা যায়। কিন্তু কি যে হলো, ওভার রানহীনভাবে ফুরিয়ে যাচ্ছে, তবু নাসির হোসেন ক্রিজে দাঁড়িয়ে আছে! কেন? আমি বললাম, 'কার জাদুতে এই ছেলেটা বুদ্ধিহীন হয়ে আউট না হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে? নাঃ, ও কি পাকিদের পক্ষে? ও আউট না হয়ে কাদের ক্ষতি করছে? নিজ দলের ও দেশের তো?' আমার সঙ্গী দর্শক বলল 'সবকিছুতে তোমার সন্দেহ। ও কি করবে। ও খেলতেই পারছে না। হ্যাঁ, আজকে দেখছি এরা হারবে।' বললাম 'বিএনপি নেত্রী এলো, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রান নেয়া বন্ধ হয়ে গেল। খুব আশ্চর্য লাগছে, কিন্তু ঘটনা এটিই।' সঙ্গী দর্শক বলল-'খালেদা, হাসিনা তো খেলছে না, খেলছে?' বললাম 'প্রতীকী অর্থে খেলছে।' যাহোক, অবশেষে বেশ দেরিতে ক্যাচ তুলে নাসির হোসেন ড্রেসিং রুমে ফিরে গেলে সম্ভবত পুরো জাতি হাঁফছেড়ে বাঁচল। বললামÑ 'আর খেলা দেখব না, পরে দেখব।'
দূরে বসে আমি বই পড়তে বসলাম। মাঝে মাঝে এসে খেলাটা দেখতে গিয়ে শেষদিকে দেখি তুমুল লড়াই চলছে। বাংলাদেশ রান খরা কাটিয়ে উঠেছে বেশ ভালভাবে। সেই সঙ্গে উইকেট পতনও ঘটছে, আবার রানও উঠছে। এক পর্যায়ে বল রয়েছে রানের চেয়ে বেশি! সবাই আগ্রহী ও আশান্বিত হয়ে উঠলাম। একে মার্চ মাস, স্বাধীনতার মাস। তাও আবার পাকিস্তানীদের বিপক্ষে খেলা হচ্ছে। মনটা খুঁত খুঁত করছে। ভারতের অতবড় রানের পাহাড়কে ডিঙ্গিয়ে গেল অত সহজে, পাকিস্তানীরা শক্তিশালী হলেও এত কম রান ডিঙ্গানো বাংলাদেশের টিমের জন্য কঠিন হবার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন, জিয়া সর্বপ্রথম পাকিস্তানের দালাল শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং যুদ্ধাপরাধীদের ও বঙ্গবন্ধুর খুনী ও জাতীয় চারনেতার খুনীদের পুনর্বাসন ও পুরস্কৃত করলেন দেশে বিদেশে বাংলাদেশের দুতাবাসে ও বিদেশে বসবাসের সুযোগ-সুবিধা করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানকে পাকিস্তানী করেন। তারপর জিয়া নিহত হলে খালেদা জিয়া (পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশে কি?) ক্ষমতায় বসেন, সেখানে ড. বদরুদ্দোজা চৌ বা জিয়া-বন্ধু কর্নেল ওলি বা এরকম কেউ বিএনপি নেতা হতে না পারা এবং গৃহিণী খালেদা জিয়ার সেই পদ লাভÑ এই অস্বাভাবিক ঘটনাটিতে কি পাকিস্তানের কোন হাত ছিল না? এই ঘটনাগুলোর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে অনেক অজানা তথ্য গোপন রয়ে গেছে বলেই অনেকে মনে করেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসের মিসিং লিংক। যাহোক, খালেদা জিয়া জিয়ার পথেই পাকিস্তানপন্থী হয়ে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতার খুনীদের আশ্রয় প্রশ্রয়Ñ পুরস্কার দেয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও এর নায়কদের অবদান, স্বাধীনতার আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদাকে ভূলষ্ঠিত করে পাকিস্তানপন্থী জঙ্গীদের উত্থানে সহায়তা করে। '৯২ সালেই খালেদা সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত গণআদালতের উদ্যোক্তা, বিচারক ও সাক্ষী দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করে। এরপর ২০০১-এর বিতর্কিত নির্বাচনে খালেদা-তারেক-এর বিএনপি জোটবদ্ধ হয় যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-এর সঙ্গে এবং মৃতপ্রায় জামায়াতকে প্রাণ দিয়ে দু'টি মন্ত্রীপদ প্রদান করে স্বাধীন বাংলাদেশের পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। সে সঙ্গে শত শত জঙ্গী সংস্থার জন্ম দিয়ে বাংলাভাই, আবদুর রহমান নামক অসংখ্য জঙ্গীর জন্ম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, আদালত-বিচারক, প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী যাত্রা, সিনেমা, মেলা সব কিছু ধ্বংসের লক্ষ্যে একের পর এক বোমা গ্রেনেডে উন্মত্ত হামলা চালায়। সেই বিভীষিকাপূর্ণ মৃত্যুউপত্যকায় পরিণত হওয়া বাংলাদেশ কে কোন ক্ষেত্রে বিজয়ী দেখতে, উন্নত দেখতে অনিচ্ছুক বলেই এ নেত্রীর সব কার্যক্রম প্রমাণ করে! তা না হলে, একজন জাতীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার দিন, ১৫ আগস্টে কেক কেটে ধুমধাম করে জন্মদিবস পালন করত কি?
সুতরাং সত্যি বলতে কি, এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ফাইনালে এই বিরোধী দলের নেত্রীকে দেখে প্রথমে চমকে উঠেছি, তারপর চিন্তিত হয়েছি এই মার্চ মাসে, স্বাধীনতার মাসে কি অশুভ কিছু ফল বয়ে আনবে এ নেত্রী! শুনেছি আজকাল ক্রিকেট খেলায় বাজিকর পাতানোখেলা অর্থ, ইত্যাদি বড় ভূমিকা নিচ্ছে।
তাই সন্দেহ বাতিক মন বিরোধী নেত্রীর উপস্থিতি আর বাংলাদেশের রানখরা শুরুর ঘটনাটি পুরোপুরি কাকতালীয় ছিল কিনা! সে প্রশ্ন করে শেষ দিকের খেলোয়াড়দের মধ্যে খেলায় বিজয় ছিনিয়ে আনার চেষ্টা দেখা গেছে যদিও শেষ তিন বলের একটিতে একটি বাউন্ডারি হতে পারত এমন আশাই ছিল সব দর্শকের। হলো না! সবাই স্তব্ধ। আমারও চোখ ফেটে জল এসেছিল। মিরপুর স্টেডিয়ামে তো কান্নার রোল উঠেছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল এ খেলায় জেতার কথা ছিল। পাকিস্তানীরা বলেছে বাংলাদেশই জিতেছে। তবু কোথায় একটা 'কিন্তু' রয়ে গেল যেন।