জাতীয় সংসদের স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুুল হামিদ শেষ পর্যন্ত বলেই বসলেন, 'বিরোধীদলীয় নেতা সারা বছর না এসে একদিন এসে এত সময় নিয়ে বক্তব্য দিলে আমার সমস্যা হয়। সংসদ নেতা এত সময় যদি বক্তব্য রাখেন, এতক্ষণ বসে থাকলে আমারও বারোটা বেজে যাবে।' স্পীকার! কী যে কষ্টে কথাগুলো বলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এতদিন ধরে সংসদ বর্জন করতে করতে বিধিবিধান অনুযায়ী ৯০ দিন হওয়ার আগেই সংসদে যোগ দিয়েছেন দলকে নিয়েই। না হলে যে সদস্যপদ থাকে না। আর সদস্য পদ না থাকলে যে বেতনভাতা, সুযোগসুবিধা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হবে। সে কি করে হয়! তাই বেগম সাহেবা সংসদে সানুগ্রহ উপস্থিতি দিয়ে চার দেয়াল ঘেরা ভবনের বিশেষ অংশটিকে সমুজ্জ্বল করেছিলেন। তারই সুবাদে মাগরিবের নামাজের আগে এবং পরে স্পীকারের ভাষ্য অনুযায়ী ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট দারুণ বক্তৃতা করেছেন! উহ্্ কী চমৎকার! এই না হলে বিরোধীদলীয় নেত্রী!
বেগম সাহেবা উঠে দাঁড়ালেন। পাশেই বসেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং তাঁর পাশেই ছিলেন সংসদের পূর্বতন স্পীকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। বক্তৃতা করতে যখন শুরু করলেন, প্রথমেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যাচার দিয়ে শুরু করলেন, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। এ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি মেজর জিয়াকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' হিসেবে পুনঃউচ্চারিত করলেন একটি বাক্য তারপর পুরনো কাসুন্দির লম্বা ফিরিস্তি দিতে দিতে সংসদের এক ঘণ্টা তিপ্পান্ন মিনিট খেয়ে ফেললেন। বেগম সাহেবা অবশ্য সৌজন্যবোধ থেকে নয়, জেদ এবং হিংসার বশবর্তী হয়ে, এতদিন আসতে পারেননি বলে খানিকটা বেশি সময় দেবার আবদার করে স্পীকারের জবাবের প্রত্যাশা না করেই তাঁর 'বক্তব্য পাঠ' করতে আরম্ভ করলেন। বক্তব্যের তথ্যসামগ্রী এবং বক্তব্যের লিখিত কাগজপত্র নিয়ে বসেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ। এক হাতে পঠিত পাতা নিয়ে অন্য হাতে পঠিতব্য পাতাটি এগিয়ে দিচ্ছিলেন। মাঝে মধ্যে বক্তব্যের রেফারেন্স হিসেবে 'বস্তুনিষ্ঠতা'র সাথে সে সময়ের খবরের কাগজ তুলে তুলে দেখাচ্ছিলেন বেগম সাহেবা। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, বেগম সাহেবা মেজর জিয়াকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি তো জানেন, জিয়াউর রহমান বহু অপকর্মের স্রষ্টা, কিন্তু তিনি নিজেও নিজেকে 'ঘোষক' বলে দাবি করেননি। একথা নিশ্চয়ই জানেন বেগম সাহেবা যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্তব্যরত মেজর হিসেবে জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া পাকিস্তানী জাহাজ 'সোয়াত' থেকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ খালাস করতে পাকিস্তানীদের হুকুমেই বন্দরে গিয়েছিলেন। রাস্তায় ব্যারিকেড দেখে বন্দর শ্রমিকদের উদ্দেশে গালমন্দ করে ওগুলো অপসারণ করাচ্ছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যেই তাঁরই কোন বন্ধু তাঁকে খবর দেন, 'তার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মজুমদার গ্রেফতার হয়েছেন এবং বাঙালী সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে আটক করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণে বাঁচার জন্য অকুস্থল ত্যাগ করে যিনি পালাতে চেষ্টা করছিলেন, গ্রামবাসী সীমান্তে তাদের আটকে দিয়েছিলেন বলে এবং ইপিআর বাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের স্বার্থহীন তথ্যের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক কসরত করে কাঠখড় পুড়িয়ে বেলাল মোহাম্মদ মেজর জিয়াকে দুটি কারণে কালুরঘাটে নিয়ে আসেন। এক. ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর মুক্তির যে লড়াই শুরু হয়েছিল, তাতে বাঙালী সৈন্যরাও আছেন সেটা জানান দেয়া এবং এর মাধ্যমে বাঙালীদের মধ্যে সাহসের সঞ্চার করা, দুই. স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারের নিরাপত্তা বিধান করা।
কিন্তু মেজর জিয়া যখন বেলাল মোহাম্মদের সাথে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে আসতে বাধ্য হলেন, তখন তাঁর মাথায় সামরিক রেওয়াজ ঢুকলো। কারণ তাঁর রাজনীতির ন্যূনতম আকর্ষণ ছিল না বরঞ্চ বিরোধীই ছিলেন। তাঁর মন-মানসিকতার বহির্প্রকাশ ঘটল বেতার থেকে 'বিপ্লবী' শব্দটা প্রত্যাহার করতে যখন বলেছিলেন। মেজর জিয়া এই দারুণ গণবিদ্রোহকে এক্সপ্লয়েট করে নিজেই ক্যুর নেতা বনে যাওয়ার কথা ভেবে প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমার যতদূর জানা, তাতে এতে কোন মিথ্যা নেই। কিন্তু যাঁরা শুনেছিলেন তাঁরা এবং স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারের সংগঠকরা তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে এটা ক্যু নয়, এ রাজনৈতিক সংগ্রাম। আমি বেচারা জিয়াকে দোষ দিই না। দেশের রাজনীতি, পাকিস্তানী শাসকদের চক্রান্ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত বাঙালীর দুর্যোগের কথা তিনি জানতেন না কারণ তিনি তো অন্ধ পাকিস্তানী ছিলেন। সুতরাং তাঁকে 'মহান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতেই হয়েছিল। এই ইতিহাস। আর এ ইতিহাস জিয়ার কণ্ঠেই বাণীবদ্ধ হয়ে আছে। অনেকের কাছেই আছে। দেশে যদি তার উত্তরসূরি খালেদা জিয়া ওই রেকর্ড ধ্বংস করেও থাকেন, তবে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও জাপান, রেডিও অস্ট্রেলিয়া, আকাশবাণী এমনকি পাকিস্তান বেতারেও রেকর্ডেড ভার্সন রয়েছে। বেগম সাহেবা সেগুলো তো মুছতে পারেননি। একি, আমিও তো পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি। কিন্তু এ যে ইতিহাস। একে আমি তো মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিক হয়ে পাল্টাতে পারি না। যখনই লিখি কিংবা প্রসঙ্গ আসে, তখন তো চর্বিত চর্বণই করতে হয়। ইতিহাস তো পাল্টানো যায় না। ইতিহাসের নায়ক জনগণ। জনগণ তো মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই বলছিলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে জিয়া যেমন এসব জানতেন না, কারণ ঐ সেনাবাহিনীর কাজই ছিল জনগণকে বিপর্যস্ত করা। তিনি তো তারই সদস্য ছিলেন। সুতরাং জনগণের মুক্তির কথা ভাববেন কি করে? আর বেচারা বেগম সাহেবা তো লাজনম্র গৃহবধূই ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধকালে বসবাস করেছেন ক্যান্টনমেন্টেই। তিনি কি মর্ম বুঝবেন মুক্তিযুদ্ধের? তাঁর 'রাখোয়ালা'রা যে গণহত্যা চালিয়েছে সে কথা বিশ্বাস করবেন কেন? তাই সঙ্গত কারণেই বেগম জিয়া জামায়াতের সঙ্গে 'মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি'র ভড়ং করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য প্রাণপাত করছেন রাজপথে। ওটাকেই 'জনগণের আন্দোলন' বলে আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলছেন চেলাচামু-াদের নিয়ে।
কিন্তু যাঁদের উদ্ধৃতি দিয়ে বেগম সাহেবা তাঁর বক্তব্যকে দীর্ঘায়িত করেছেন, তাঁরা সবাই রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী বিরোধী ছিলেন। তখন দুর্নীতি, দুরাচার, নিপীড়ন, অপহরণ, হত্যা, গুম রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে লিখেছেন। এতকাল পরে বেগম সাহেবা এইসব ঘটনাপঞ্জি নতুন করে তুলে রাজনীতি নয়, নির্বাচনের ফায়দা ক্যাশ করার কোশেশ করছেন। ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট বক্তৃতা করেছেন, কোন বাধা কেউ দেননি। বরং স্পীকার ঐ বক্তৃতা ধৈর্য ধারণ করে শোনার জন্য অনুরোধ করেছেন। তবুও তার 'পূর্বপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত' পুরনো কাসুন্দির বিবরণ শুনেছেন সবাই। কমরেড শান্তি সেন আমাদের রাজনীতির শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী কমরেড অরুণা সেন ও আরও একজনের নিপীড়নের কাহিনী ও বৌদির বিবৃতি পাঠ করে শুনিয়েছেন। ....শান্তি দা বা বৌদিকে তিনি চেনেনও না। এমনকি দলের সবাই জানেনও না তবে কয়েকজন প্রগতিশীল রাজনীতির পুরনো কর্মীদের দলে পেয়েছেন কেবলমাত্র আওয়ামী বিরোধিতার কারণ, তারাই জোগান দিচ্ছেন এইসব পুরনো নৃশংসতার কাহিনী কারণ এটা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যাবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে এর এফেক্ট পড়বে, সেই কারণেই এই দীর্ঘ বক্তৃতার বিলাসিতা। একটা কথা মনে পড়ে গেল, বেগম সাহেবা বদরউদ্দিন উমর, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আতিউর রহমান প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছেন, এটা দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা সহজেই বোধগম্য। উপরে থু থু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে, বেগম সাহেবা, সে কথা কি ভুলে গেছেন। আপনার তো মাইগ্রেটরি বার্ডদের দল। উঁচু গলা করে কথা বলছেন বটে কিন্তু কাদের জোরে? ওরাও একদিন ঐ দলেরই কর্মী, সংগঠক ছিলেন। আপনি যাঁদের মহাসচিব বানিয়েছেন, 'তাঁরা কারা?' আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরÑএঁরা কোথা থেকে এসেছেন। সকলেই তো মধ্যবিত্ত শ্রেণী চরিত্রের বাইরে নন। এরা ঐ আওয়ামী বিরোধী মানসিকতা থেকে এসেছেন। আপনি তাঁদের ব্যবহার করেছেন এবং তাঁরাও স্বচ্ছন্দেই ব্যবহৃত হচ্ছেন। ...লোকে চোরের চেয়ে ডাকাতকে ভয় পায়, কিন্তু বাটপারদের ঘৃণা করে। ঐ বাটপারীটা করতে পারেননি বলে তিনি যখন নিদারুণ অসুস্থতায় ভুগছিলেন স্কয়ার হাসপাতালে, তখন খালেদা জিয়া তাঁকে একবারও দেখতে পর্যন্ত যাননি এমনকি মারা যাবার পরও। কী পাষাণ হৃদয় ভদ্রমহিলার! অথচ এই মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দক্ষ সংগঠক ছাত্রজীবন থেকেই এবং এই মান্নান ভূঁইয়াই বিএনপি'র হতদরিদ্র অবস্থা থেকে সাংগঠনিকভাবে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন।
কতটা হৃদয়হীনা কিংবা 'ভিন্ডিক্টিভ' হতে পারেন বেগম সাহেবা, তার আরও প্রমাণ আছে। সব তো বলা সবসময় যায় না। আরেকটি কথা বলি, তিনি এত বড় নাকি জাতীয় নেতা হয়েছেন, তাহলে জনগণের সাথে প্রতারণা করছেন কেন? দেশের মানুষদের বিভ্রান্ত করে চটুল সরকারী ব্যর্থতার কথা বলতে বলতে তিনি তো সরলপ্রাণ বাংলার জনসাধারণের কাছ থেকে ভোট গ্রহণ করে নিজে জিতেছেন সংসদের মূল্যবান আসন। যে সংসদ দেশ, জনগণ ও রাষ্ট্রীয় সকল কল্যাণকর কর্মকা-ের দায়িত্বে সিদ্ধান্ত নেয়, আইন প্রণয়ন করে। সেই সর্বোচ্চ সংসদে যাবার সুযোগ পেয়েও যাঁরা যাননি সংসদে, তাঁদের উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য একটিই, সেটা জনগণের কল্যাণ নয় কিংবা দেশের সুনাম অর্জন নয়। একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতারোহণ। হায় রে দুর্ভাগা দেশ, এত রক্তের বিনিময়ে যে দেশ অর্জন করলাম, যে অপরিমেয় ত্যাগে নিজ মাতৃভূমিকে পুনরুদ্ধার করলাম পাকিস্তানী দখলদার শাসক গোষ্ঠীর কবল থেকে, সে দেশেও সেই পুরনো ভূত সওয়ার করল কেন? তবে কি আমাদের মনে কোন দ্বিধা কাজ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের তাৎক্ষণিক শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে? যদি তাই বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে কেন হলো এত দেরি এদের বিচারে, তার একটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমার তো ধারণা, যদি 'প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে' পারতাম তাহলে আজ বোধহয়, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এত কসরত হতো না। এই সন্ত্রাসী মৌলবাদী দল সুযোগ নিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের কাঁধে চেপে। মাটিতে পা রেখেছে। এমনকি রাজনীতি করার প্রশ্রয়ও পেয়েছে। সত্যিকথা বলতে কি, এই প্রশ্রয় না পেলে ওরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না এবং সমাজে ধর্মান্ধতা ছড়াতে সুযোগ পেত না। মুক্তিযুদ্ধের পরে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও কেন গোলাম আজমকে এ দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া নিজের রাজনীতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠে ক্ষমতায় যাবার কিছুটা শক্তি তাদের কাছ থেকে ধার করেছিলেন। ফলে ওরা প্রশ্রয় পেয়ে মাথায় উঠে গিয়েছিল। আজও তাই যত কষ্ট কিংবা দুঃখই হোক না কেন, বেগম সাহেবা ওদের সঙ্গ ছাড়তে পারছেন না। আর সঙ্গ ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না বলেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্যে একটার পর একটা 'আন্দোলন' নামক কপট খেলা খেলছেন। এতে যে দেশের ক্ষতি, মানুষের দুর্ভোগ সেকথা আদৌ চিন্তা করছেন না, কারণ তাদের যে 'সোনার হরিণ' সেই ক্ষমতায় চড়তে হবেই। তাই দেখলাম, দেশব্যাপী সরকারের ব্যর্থতায় যেমন ক্ষোভ জমা হয়েছে, তেমনি কিন্তু ঐ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় খালেদা জিয়ার পলিটিক্সটাও পরিষ্কার। সবাই বুঝতে পারছেন, দেশের সব মানুষই চাইছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। অথচ তারা মুখে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলে সেই যুদ্ধাপরাধীদের নিয়েই রাজনীতির অঙ্গন সরগরম করছেন। একে কপটতা, ভ-ামি ছাড়া আর কিইবা বলা যায়।
পাঠক, যাঁরা আপনারা সংসদ অধিবেশন প্রচারে যে চ্যানেল ব্যবহার করা হয়, সেটা যদি দেখে থাকেন, তাহলে দেখবেন, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারলেন, কিন্তু যেই সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিতে উঠলেন, অমনি তিনি নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং স্পীকারের দিকে পেছন দিয়ে শ্লথগতিতে অধিবেশন থেকে বেরিয়ে গেলেন। তো আমরা এই কা-টিকে কী ভাবব? অর্থাৎ তিনি কি বক্তৃতা দিয়ে সংসদ টিভিতে প্রচারিত সব কথা দেশবাসীকে জানিয়ে চলে গেলেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যন্ত তিনি থাকবার সৌজন্য দেখাতে পারলেন না। এ কি রাজনীতির কোন শিষ্টাচার বা সংসদীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত কোন বিষয়? সংসদের টিভিতে ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট (স্পীকারের হিসেব) সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে দেশবাসীর কাছে নির্বাচনী প্রচার চালানো হয়ে গেলেই চলে গেলেন, কিন্তু কেন, কোথায় গেল জনগণের স্বার্থের কথা? এতদিন যেখানে বলতে পারেননি না আসার কারণে, একদিনে এতদিনের সুযোগ নিয়ে সম্ভবত সময়ের দিক থেকে সংসদীয় রেকর্ড করলেন তিনি। এবার তো বলতে পারবেন না যে তাকে বলতে দেয়া হয়নি। সময় দেয়া হয়নি। বাধা দেয়া হয়েছেÑ এসবও তো বলার সুযোগ থাকল না। এটাতো পরিষ্কার, ওনারা এমন ভাষা ব্যবহার করেন যে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। যে কোন মানুষের চামড়া যদি গ-ারের না হয় তো ক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে তো অন্যরা ক্ষিপ্ত হবেনই। নিরাসক্ত হয়ে সবাই সুবোধ বালকের মতো বসে থাকবেন, এটা আশা করা কি ঠিক।
মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, আপনাকে তো আমরা 'শিষ্টাচার', 'বিনম্র ও শালীনতা' কথা বলতে বা শিক্ষা দেবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারি না, যেভাবেই হোক আপনি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের স্ত্রীÑসেই সুবাদেই তো রাজনীতি করছেন, তাঁকে ক্যাশ করে এবং যুদ্ধাপরাধী জামায়াতীদের সমর্থন নিয়ে। যে দলই ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতা প্রত্যাশী হোক না কেন, তাদের কারও কাছ থেকেই আমরা সাধারণ মানুষ এই কুৎসিত আচরণ প্রত্যাশা করি না।
কাগজে পড়লাম, সংসদে ভাষণ, শব্দ প্রয়োগে নাকি আইন হচ্ছে শালীনতা বজায় রাখার জন্য। কথাটা শুনতে ভাল লাগল না। আইন প্রণয়নকারীদের মুখে ঠুলি পড়ানো তো আমরা চাই না। ভব্যতা, সভ্যতার কারণে সংসদের মতন জায়গায় খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা প্রত্যাশা করি রাজনীতি বিবর্জিত কোন ভাষাই প্রয়োগ কেউ করবেন না। সংসদের নিজস্ব নীতিমালা, রীতিনীতি তো আছেই, তবে কেন এমন 'অশ্লীলতা' ঠেকাতে আইন করতে হবে। তবে কি যাঁরা সংসদে প্রতিনিধি এসেছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টাতে হবে? তবে কি রাজনীতি কলুষিত হয়ে গেছে? বেনোজল কিংবা অপসংস্কৃতি ঢুকে গেছে ঐ সংসদীয় শিষ্টাচারে, আচরণে? যেখানে মাননীয় স্পীকারকেই মাথায় হাত দিয়ে, মুখ চেপে নিচু হয়ে থাকতে হয়, সেই সংসদে আইন করে কি ঠেকানো যাবে এই অসৌজন্যমূলক আচরণ?...আমার মনে হয়, সংসদীয় রাজনীতি, অধিবেশনে আচরণ, কর্মপদ্ধতির নিয়ম কানুন মানা ইত্যাদি বিষয়ে 'প্রশিক্ষণ' দেয়া প্রয়োজন। শুধু আইন করলেই চলবে না, আইন তো বহু আছে। মানে ক'জনা? সুতরাং আইন মানার জন্য মনিটরিং কমিটি থাকতে হবে, যারা স্পীকারকে রিপোর্ট দেবেন। সেই অনুযায়ী স্পীকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু যত যাই করুন, বিরোধী দলকে রাষ্ট্রীয় সরকার বা প্রশাসনের একাংশ হিসেবে নিজেদের মনে করতে হবে। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতাসীনরা যা সিদ্ধান্ত নেবেন, বিরোধী দল তাতে যদি অংশ না নেয়, তবে তার অকারণ বিরোধিতাও করতে পারবে না। এমন প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সব সদস্যকেই। কী হনুরেÑএ ভাব নিয়ে একজন আরেকজনকে দেখে নেয়ার মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। ভালভাবে সংসদ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করুন। কথা বলুন। শ্রদ্ধা সমালোচনা করুন। এই ভাল দেখে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন, কে হবেন তাদের নেতা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব