ফিরোজ মান্না ॥ শাহাবাগের আন্দোলন অরাজনৈতিক। এই আন্দোলন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত শিবির ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি দলের বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার আন্দোলন। এই আন্দোলনকে অপপ্রচারকারীরা নানাভাবে অপব্যাখ্যা করছে। সাইবার যোদ্ধারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতেই টানা ২০ দিন ধরে আন্দোলন চলছে। যারা আন্দোলনকারীদের নাস্তিক ও সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য দিচ্ছে, তারা এখানে একবার এসে দেখে যান কারা নাস্তিক ও সন্ত্রাসী। যাদের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তারাই নাস্তিক ও সন্ত্রাসী। তারা জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে উল্লাস করে। মহান শহীদ মিনারকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। মসজিদে জায়নামাজে আগুন দেয়। মানুষ হত্যা করে। দেশজুড়ে তা-ব চালায়। শাহাবাগের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। এখান থেকে গোটা জাতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়া হযেছে। এই চেতনা রোখার সাধ্য কারও নেই।
এদিকে রবিবার আবারও শিবিরের ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে সাইবার যোদ্ধারা। রবিবার সকাল থেকে শিবিরের পেজটি অন্ধকার করে দেয়া হযেছে। ওয়েবসাইটটির (িি.িংযরনরৎ.ড়ৎম.নফ) হোম পেজ হ্যাক করে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের উৎসর্গ করা হয়েছে। তুর্কী, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার সাইবার আর্মির সহযোগিতায় টুইটারে শাহবাগ প্রজম্ম চত্বরের বিরুদ্ধে অশ্লীল মন্তব্যের জবাব দেয়া শুরু করেছে সাইবার যোদ্ধারা। দেশে ফেসবুকের ব্যবহার বেশিÑ টুইটারের ব্যবহার কম। ফেসবুকে জামায়াত শিবির স্ট্যাটাস দিয়ে সাইবার যোদ্ধার সঙ্গে কোনভাবেই পেরে উঠছিল না। এ কারণে বিদেশীদের সমর্থনে তারা বিশ্ব জনমত তৈরি করার জন্য টুইটার ব্যবহার করছে। সাইবার যোদ্ধারা বলেন, তাঁদের টুইটারের দুনিয়াও গুঁড়িযে দেয়া হবে। আমাদের যোদ্ধারা রাতদিন কাজ করছে।
রবিবার শাহবাগে সাইবার যুদ্ধ পেজে স্ট্যাটাস দিযেছেন, এ কথা সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের পর এভাবে বাংলাদেশ আর কখনও জেগে ওঠেনি। প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ যেভাবে পুরো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে সেটা অতীতে দেখা যায়নি। এ গণতরঙ্গ রুধিবে সাধ্য কার? স্বাধীন দেশে সবাই এক সঙ্গে থাকে কিন্তু দেশবাসী বিভক্তÑ স্বাধীনতার সপক্ষে এবং স্বাধীনতার বিপক্ষে। কারও কাছে দেশটা মা আর কারও কাছে দেশটা একটা ঘাঁটি মাত্র, যেটাকে দখল কিংবা ধ্বংস করতেই এই সহাবস্থান! এখনকার সার্বিক পরিস্থিতি খুব ভয়ঙ্কর লাগছে এবং কষ্ট পাচ্ছি। '৭১ কেমন ছিল। মুক্তিযুদ্ধ কেমন ছিল? আমার বাবা-মা, দাদি, নানা-নানু, মামা-চাচা, খালা-ফুপুরা কতটা অনিশ্চিত, অসহায়, ভয়ঙ্কর দিন কাটিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে একবার ভেবে দেখুন। ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ বীরাঙ্গনা এবং তাদের পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার কেমন সময় কাটিয়েছেন। কেমন ছিল তাদের অবস্থা। তখন এই রাজাকার আলবদর যুদ্ধাপরাধীরা উল্লাস করত। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজযের কত ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং প্রতীক্ষা করতে হযেছে। '৭১ সালের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে পাকিদের হাত থেকে দেশের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল মুক্তিকামী মানুষ। আজ ২০১৩ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত শিবির ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলমুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিয়েছে। আমাদের অহিংস আন্দোলন কি সহিংস হতে চলেছে? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কেউ তো আর ঘরে বসে থাকবে না। সবাই যুদ্ধ করবে... এবার বিভীষণের সঙ্গে সহিংসতা চলবে। দেশে কিছু মানুষ কেন খুনের রাজনীতি ছাড়তে পারে না? আমি যুদ্ধ করতে ভয় পাই না, আমি ভাঙ্গি না, মচকাই না কিন্তু কষ্ট পাই/ভয় পাই না, হতাশ হই না কিন্তু কষ্ট পাই/মানব জাতির জন্য কষ্ট পাই/ মানবতা লঙ্ঘনে কষ্ট পাইÑ সহিংসতা দেখে কষ্ট পাইÑ জয় বাংলা।
সাইবার যোদ্ধারা রবিবার আন্দোলনের কর্মসূচীর আপগ্রেড দিয়েছে। তারা স্ট্যাটাস দিয়েছে, সকালের বিক্ষোভ মিছিল সফল হয়েছে। এই প্রথম আমরা শাহবাগের বাইরে একটা মিছিল নিয়ে বের হলাম। মিছিলের দৈর্ঘ্য ছিল শিশুপার্ক থেকে শুরু করে মৎস্য ভবন পর্যন্ত, সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত ছিল পুরো সময়। শাহবাগ হয়ে বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে পল্টন মোড় হয়ে মিছিল আবার ফেরত আসে প্রজন্ম চত্ব¡রে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিলে সাইবার যোদ্ধাদের সহযোগীরাও উপস্থিত ছিলেন। সবচাইতে লক্ষণীয় উপস্থিতি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের। তাঁরা মনে হয় হল-ক্লাস-ক্যাম্পাস খালি করেই চলে এসেছেন। সাধারণ মানুষ রাত থেকেই ছিল, অনেকে ফজরের নামাজের পর পরই প্রজন্ম চত্বরে চলে আসেন। ১০টা পর্যন্ত তাঁরাই জমজমাট করে রেখেছিলেন প্রজন্ম চত্ব¡র।
সাইবার যোদ্ধারার আরেকটি পোস্ট দিয়েছে, তোমরা পুলিশরে ডরাও নাই, ডরাইছ আমাদের, তাই সামনে আসো নাই।
কাপুরুষের দল সব সময়েই পেছন থেকে আক্রমণ করো। তাও আবার একা পেলে। তোমাদের দলের বড় শুয়োরেরা একাত্তরে যেমন অসহায় মানুষরে হত্যা করেছে, তোমরা ছোট শুয়োরেরা এখনও তাই করতেছ এবং খোঁয়াড়ে বসে মানুষের মাথা গুনছ, আর আজকে তোমাদের সবার পরনের পাজামাটার রং হচ্ছে হলুদ।
এদিকে সাইবার যোদ্ধারা শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা পোস্ট দিয়েছেনÑ এসো ভাই/এসো বোনÑ গড়ে তুলি আন্দোলন/এসো ভাই, এসো বোনÑ সফল করি আন্দোলন/
জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালোÑ রাজাকারের গদিতে আগুন জ্বালো/জয় বাংলা। একই সঙ্গে রবিবার রাত ১২টার মধ্যে নব্য রাজাকার আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। সে আমার মায়ের শাড়ি ছেঁড়ার (জাতীয় পতাকা), আমার আবাস (মসজিদ), আমার পূর্বপুরুষের স্মৃতি (শহীদ মিনার) ভাঙ্গার নীল নকশা করে দিয়েছে এবং হুকুম দিয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা সাইবার যোদ্ধা আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন সম্পর্কে জানিয়েছেন, তিনি কখনই নাস্তিক ছিলেন না। দুটি পত্রিকা তাঁর নামে যে কুরুচিপূর্ণ তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরেছে তার কোন সত্যতা নেই। তিনি ফেসবুক ও ব্লগে লেখালেখি করতেন এটা ঠিক আছে। পত্রিকা দুটি যে সময়ের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন ছাপিযেছেÑ সেই সময়েও তিনি কোন ইসলামবিরোধী লেখা লেখেননি। পত্রিকা দুটি রাজীবের ইসলামবিরোধী লেখার উল্লেখ করেছে গত বছরের জুন ও আগস্ট মাসে। সামান্য একটি ঘটনার কারণে কক্সবাজারের রামুতে যে সহিংসতা চলেছে। রাজীবের লেখায় যদি এমন কিছু থাকত তাহলে সারাদেশ তোলপাড় হয়ে যেত গত বছরের জুন ও আগস্টে। রাজীবকে খুন করার পর তার নামে 'ফেক আইডি' খুলে ইসলামবিরোধী নানা মন্তব্য পোস্ট করেছে। দীর্ঘ তদন্তের পর এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থাটি জানিয়েছে, সাইবার যোদ্ধা রাজীব হায়দার থাবা বাবা হওয়ার কারণ হচ্ছে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল। থাবা বাবার নামে মহানবী (স) বিষয়ে উল্টাপাল্টা পোস্ট দিয়ে সাধারণ সকল মানুষকেই বোকা বানানো যাবে। যে কোন মুসলিমের কাছে মহানবী (স) প্রাণের ব্যক্তিত্ব। তাঁকে নিয়ে কোন বাজে কথা মানুষ সহ্য করবে না। এই চিন্তা থেকে জামায়াত শিবির মৃত রাজীবের নামে এমন অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ পোস্ট দিয়েছে। ধর্মকে পুঁজি করে জামায়াত শিবির ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। রাজীবকে জামায়াত শিবির মেরে ফেলার কারণ হলো ১১ ফেব্রুয়ারি জামায়াত শিবিরের ব্লগে 'সোনার বাংলায়' গণজাগরণে পেছনের মানুষদের পরিচয় দেয়া হয়েছে শুধু থাবা বাবার। সেই সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্মের নিন্দাকারী ব্লগের প্রধান হিসেবে যে ব্লগ আমাদের মহানবীকে (স) নিয়ে অত্যন্ত নোংরা কথাবার্তার জন্য সরকারীভাবে আগেই নিষিদ্ধ করা হয়। এটা বোঝা খুব সহজ যে, থাবা বাবা কেন গণজাগরণের প্রধান হিসেবে পরিচয় করে দেয়া হলো। রাজীব হায়দার শাহবাগে নিয়মিত আসতেন, কোন বক্তৃতা বা কোন টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখা যায়নি। তাঁকে খুন করার জন্যই ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে এমন পোস্ট পাঠানো হয়েছিল।
সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজীবকে নৃশংসভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্য হলো, জামায়াত চেয়েছে রাজীবের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা বাড়ুক। এই ঘৃণা ও ক্ষোভ থেকে আন্দোলনকারী থাবা বাবাকে আপন করে নেবে, থাবা বাবার জন্য সেøøাগান দেবে। সাধারণ মানুষের সিমপ্যাথি তৈরি হবে, সঙ্গে আগ্রহ। এর মধ্যে জামায়াত-শিবির থাবা বাবার নামে অনেক পেজ তৈরি করে রেখেছে, যেখানে মহানবী (স), দেবী দুর্গাসহ অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত বাজে কথা লেখা আছে। থাবা বাবা নামে সার্চ করলে সেগুলো আগে আসবে। মানুষ সেগুলো পড়বে। মানুষ মহানবীকে (স) প্রাণের চেয়ে ভালবাসে। তাই এসব কথা পড়ে তাদের ক্ষোভ ও রাগ তৈরি হবে। এই সুযোগে জামায়াত শিবিরের অনলাইন এ্যাকটিভিস্টরা আন্দোলনকারী সেজে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দেবে। শাহবাগে যারা আন্দোলন করছে তাদের নেতৃত্বে আছে মহানবী (স) সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারীরা। এতে সাধারণ মানুষ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে জামায়াত। জনগণকে জানাবে শাহবাগে আন্দোলন আসলে রাজাকারদের বিরদ্ধে না, ধর্মের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মানুষ আর যা-ই হোক, ধর্ম নিয়ে বাজে কথা সহ্য করে না। আর এই ফাঁকে রাজাকারের ফাঁসি ও জামায়াত শিবিরের নিষিদ্ধের দাবি থেমে যাবে। ফলে আন্দোলনের রোষানল থেকে জামায়াত শিবির রক্ষা পাবে।
জামায়াতের শিবির আরও ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। জামায়াতের এই পরিকল্পনার কথা তাদের নিয়ন্ত্রিত ব্লগ পেজে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যাতে আন্দোলনকারীরা ভয় পেয়ে আন্দোলনকে বানচালের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি।
আন্দোলনকারীরা শুক্রবারের জামায়াত শিবিরের তা-বের পর আবার তারা শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে হাজির হয়েছে।