প্রথমেই একটা প্রস্তাব দিতে চাই জামায়াতের সঙ্গে 'ইসলাম' শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য। কারণ এটি কোন ধর্মীয় বা ইসলামী সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান একটি পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল। সন্ত্রাসী শক্তি। পবিত্র ইসলাম শব্দটি ব্যবহার করে ইসলাম ধর্মেরই অবমাননা করছে। কেউ কেউ বলেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ করতেÑকথাটা এভাবে না বলে, বলা দরকার শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার কথা।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য যে যে কারণ দরকার তার সবই জাতির সামনে এসেছে। এই জামায়াত-শিবির রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যে রাষ্ট্র পুরোপুরি স্বাধীন সার্বভৌম এবং রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থাও গণতান্ত্রিক। বর্তমান যে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তারা পুরোপুরি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। এই সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর যখন জামায়াত-শিবির প্রকাশ্যে এবং চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে তখন আর কি কোন সন্দেহ আছে যে, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। গত ২-৩ মাস যেভাবে পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে তাতে করে আর ভাববার কিছু নেই, সরকারকে এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জামায়াত-শিবির বাঘ-ভল্লুক কিছুই নয়। এটি বড়জোর চোখ লাল করা বিড়াল। বলা হয়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এটিও একটি কাগুজে ভয়। হিজবুল মুজাহিদীন, হিযবুত তাহ্্রীর নিষিদ্ধ করার পর কি হয়েছে, ম্যানহোলের (আন্ডারগ্রাউন্ডে) ভেতরেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। জামায়াত-শিবিরের অবস্থাও তা-ই হবে। তাছাড়া হিজবুল মুজাহিদীন বা হিযবুত তাহ্রীরও ছিল জামায়াত-শিবিরেরই সংগঠন। বিগত নির্বাচনের সময় জামায়াত-শিবিরের ভোট বা সমর্থন ছিল চার শতাংশ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে এদের সমর্থন দুই শতাংশে নেমে এসেছে। সবচে বড় কথা হলো এরা পবিত্র ইসলাম ধর্মকে যেভাবে নোংরা ব্যবহার করেছে, যেভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে এবং এখনও কোথাও কোথাও চালাচ্ছে তাতে করে তাদের গণভিত্তি বলতে কিছুই নেই। এদের হিংস্ররূপ জনগণ দেখেছে।
সবচে বড় কথা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার করায় যে প্রজন্ম ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটকে চার-পঞ্চমাংশ আসন দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় পাঠিয়েছে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায় তাদের ক্ষুব্ধ করেছে এবং তারা ব্লগের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লাখো জনতার সমাবেশ ঘটিয়েছে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে বা শাহবাগ গণজারণ মঞ্চে। এখান থেকে তারা মাত্র ৩টি দাবি উত্থাপন করেছে :
১. মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন নয়, ফাঁসির সাজা দিতে হবে। সেই সকল যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দিতে হবে।
২. জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের এই দাবি কথার কথা বা রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি নয়। শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম আজ ১৬-১৭ দিন যাবত শীত এবং রোদ-বৃষ্টির মধ্যে তাদের দাবির পক্ষে সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে, এতটুকু ক্লান্ত হয়নি বা এতটুকু ক্লান্তি তাদের দুর্বল করতে পারেনি। লাকি আখতারসহ সেøাগানকন্যা তথা অগ্নিকন্যাদের দিন নেই রাত নেই সেøাগানে-গানে আবৃত্তিতে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আমরা যারা শিক্ষা আন্দোলন, বাঙালী মুক্তি সনদ ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে ৬+১১ দফাভিত্তিক ছাত্র-গণঅভ্যত্থান দেখেছি, অংশগ্রহণ করেছি, মিছিলে মিছিলে সেøাগান দিয়েছি, সর্বোপরি অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছি, '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার পর যেভাবে দেশটাকে মিলিটারি জিয়া ও তার অনুসারীরা মুক্তিযুদ্ধের ধারার বিপরীতে পাকিস্তানী ধারায় নিয়ে গিয়েছিল, তরুণ প্রজন্ম তা থেকে আবার মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। ঊনসত্তর, সত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেøাগানগুলোর দিকে তাকালে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন :-
ক. তুমি কে আমি কে - বাঙালী বাঙালী
খ. পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা
গ. জয় বাংলা
অবশ্য তখন আরও কতগুলো সেøাগান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ায় যেগুলোর প্রেক্ষিতে পাল্টে যাওয়ায় এখন আর বলা হয় না। তবে জয় বাংলার সঙ্গে জয় বঙ্গবন্ধু ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রণধ্বনি। এসব সেøাগান কোন দল বা গোষ্ঠীর সেøাগান নয়। বরং তরুণ প্রজন্ম আমাদের মতো বুড়োদের চোখে আঙুল দিয়ে এবং কানে ছিদ্রি করে বলে দিয়েছি, তোমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পর এই সব সেøাগান পরিত্যাগ করেছো, তোমরা ভুল করেছো, তোমরা জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছো। সবচে বড় কথা হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বামপন্থীদের মুখে একটা অভিযোগ সব সময় শোনা যায়, তা হলো আওয়ামী লীগ 'জয় বাংলা', 'জয় বঙ্গবন্ধু' সেøাগান দুটিকে দলীয়করণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো তোমরা পরিত্যাগ করেছো, আওয়ামী লীগ করেনি, এটা কি তোদের দোষ? এটা কি দলীয়করণ করা? শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম চত্বর আজ তা সবার মুখে তুলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে, যা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শাহবাগ থেকে বন্দর-নগর, গ্রাম-গ্রামান্তরে, জনপদে, মানুষের মনে। ইতিহাস না কি এভাবেই প্রতিশোধ নেয়। যারা স্বাধীনতার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল তারাই আজ ইতিহাসের কাঠগড়ায়, আস্তাকুঁড়ে।
তরুণ প্রজন্মের এই অবিস্মরণীয় উত্থানে বিএনপি ও তাদের বশংবদ বুদ্ধিজীবী-গলাজীবীদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। এতদিন গোলাপি মুখের কুলুপ আঁটা ছিল। কত কর্নার থেকে উচ্চারিত হয়েছে 'গোলাপি একটা কিছু কও' কিন্তু গোলাপি কোন কথা বলেন না। যেই প্রজন্ম চত্বর থেকে দুই মধ্যরাতের গলাজীবী ও এক নিজে নিজে বুদ্ধিজীবীকে অতিরিক্ত জামায়াত-শিবির প্রীতির কারণে বর্জনের আহ্বান জানানো হলো, তখনি গোলাপি মুখ খুললেন। এই দুই গলাজীবী আসিফ নজরুল এবং পিয়াস করিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হওয়ার সুবাদে অর্থাৎ পদাধিকার বলে বুদ্ধিজীবী, আরেকজন মাহমুদুর রহমান নিজে নিজে বুদ্ধিজীবী। এরা তিনজনই জামায়াত-শিবিরের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রবক্তা। জামায়াত-শিবির যখন পুলিশের ওপর হামলা করে, রাজপথে প্রকাশ্যে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়ে পেটায়, তখন গলাজীবীরা টক শোর নামে জামায়াতকে ডিফেন্ড করে, বলে ওদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করায় তারা এসব করছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করায় পুলিশ পেটানো তাদের মৌলিক-গণতান্ত্রিক অধিকার-দিনের পর দিন এরা টিভির পর্দায় জাতিকে এই জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেছে। নিজে নিজে বুদ্ধিজীবী মাহমুদুর রহমান তো তার কাগজে তরুণ প্রজন্ম উত্থানকে 'শাহবাগে ফ্যাসিবাদী সমাবেশ' এই শিরোনাম দিয়ে (৮ কলাম) প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অথচ তরুণ প্রজন্ম জামায়াতের মতো এই সব গলাজীবী পদাধিকার বলে বুদ্ধিজীবীদের বর্জনের ডাক দিয়েছে। কোন রকম উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রজন্ম চত্বর থেকে দেয়া হয়নি। কেবল এই তিনজন নয়, আরও আছেন, যেমন প্রবীণ হওয়ার যোগ্যতায় জাতির বিবেক এবিএম মূসা, ব্যারিস্টার রফিকুল হকও রয়েছেন। আরও রয়েছেন পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার সুবাদে মধ্যরাতের গলাজীবী নুরুল কবির বা মাহফুজুল্লাহ এবং তাদের প্রমোটার অঞ্জন রায়। প্রজন্ম চত্বর থেকে তাদের কারও বিরুদ্ধেই কোন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়নি। অঞ্জন রায় তো ভুল পাল্টে এখন প্রজন্ম চত্বরে প্রতিদিন চেহারা দেখাচ্ছে।
এমনকি রাজীব হত্যার পরও প্রজন্ম চত্বর থেকে কারও বিরুদ্ধে কোন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়নি, বিষোদ্গার করা হয়নি। অথচ তাদের নাম তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মের রক্ত একটু গরম থাকার কথা। কিন্তু তারা শান্ত এবং সবকিছুই করছে ধীর স্থির এবং শান্ত মস্তিষ্কে। এ এক অবিশ্বাস্য বিশ্বাস তারা জাতির কাছে প্রমাণ করেছেন বা করতে পেরেছেন এ জন্য যে তাদের সামনে একটা আদর্শ আছে এবং তা হলো আমাদের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, যে আদর্শ সৃষ্টিতে ৩০ লাখ শহীদ এবং ৬ লাখ মা-বোন নির্যাতিত ও ধর্ষিত হয়েছিলেন, এভাবে বেশির ভাগই শহীদ হন। এর ওপর কোন আদর্শ কি বাঙালী জাতির আছে? তরুণরা সে আদর্শ ধারণ করেছে বলেই কোন বাড়াবাড়ি করছে না। এই যে ১৬টি দিন (বুধবার পর্যন্ত) চলে গেল আজ পর্যন্ত একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, এমনকি একটি পকেটমার বা মোবাইল চুরির ঘটনাও ঘটেনি, এসবই সম্ভব হয়েছে সেই আদর্শের কারণেই। নইলে এই যে জামায়াত-শিবির বানানোর কারখানা ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল ও ল্যাব, ফার ইস্ট ইসলামী লাইফ, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, আল-আমীন একাডেমী, ইকরা, নূরানী এমনি শত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোর বার্ষিক মুনাফা হাজারো কোটি টাকা এবং যে টাকা দিয়ে জামায়াতীরা জঙ্গী-স্কোয়াড বানায়-প্রজন্ম চত্বর থেকে এগুলোও বর্জন করতে বলা হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে কোন রকম আত্মীয়তা না করতেও বলা হয়েছে-অর্থাৎ সামাজিকভাবে বয়কট। এই পর্যন্তই। এ রকম একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন আমরা করেছিলাম ৬ দফা পরবর্তী বাংলাদেশে। এসব আন্দোলন সুশৃঙ্খল হবার পেছনে কারণ হলো এও এক রকম যুদ্ধ এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে একে অপরের বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহযাত্রী এবং পরম আপনজন।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার পক্ষে আগেই বলেছি এটি ধর্মীয় কোন সংগঠন না, এটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক শক্তি, এরা ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের নষ্ট কর্মকা-ের বাস্তবায়ন করতে চায়। বাধা দিলে হিংস্র হয়ে ওঠে। আগেই বলেছিল, এদের ভয় পাবার কিছু নেই। নষ্টরা সব সময় মানসিকভাবে দুর্বলই থাকে। ধর্মপ্রাণ মানুষ ওদের দলের নামে ইসলাম শব্দটি থাকায় অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়। তবে ওদের রিক্রুটমেন্ট বা তরুণদের ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলে দলে ভেড়ানোর হার অনেক কমেছে, এখন কেবল জামায়াত-শিবির পরিবারের সন্তানরাই ওই নষ্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয় বা এখনও হচ্ছে। তবে বাতি নিভে যাবার আগ মুহূর্তের মতো নিভু নিভু। অর্থ দিয়ে নষ্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায় না, সে যত অঢেলই অর্থ হোক। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর ওই নষ্টদের সামাজিক ভিত আরও নাড়িয়ে দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বা তার নেতারা যত আস্ফালনই করুন, যত মিথ্যা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুন, কোন কিছুতেই কাজ হবে না। সরকারের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার যে আলোচনা চলছে, খালেদা জিয়া বরং তা সমর্থন করলেই ভাল করবেন, রাজনীতিতে বেঁচে থাকবেন। নয়তো জামায়াত-শিবিরের মতোই নষ্টদের কাতারে চলে যাবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রজন্ম চত্বরের অভূতপূর্ব জাগরণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ক'দিন আগে সংসদে যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছেন, তা জাতির জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তিনি বলেছেন, 'এখন শান্তিতে মরতে পারব, আমরা না থাকলেও তরুণ জন্ম দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় অর্থাৎ সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।'
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
লেখক : ফিল্যান্স সাংবাদিক