ঢাকা: গোলটেবিল আলোচনা সভার বক্তারা বলেছেন, "রাজনৈতিকভাবেই সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন। হামলাকারীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকেই এই নির্যাতন করছে। পাশাপাশি অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তা প্রকাশিত হচ্ছে না। জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় যাচ্ছেন না। এতে প্রশাসনের ব্যর্থতা আছে। প্রশাসনের কাছে কি কোনো আগাম কিছু ছিল না। তাহলে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিল। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকার একটি ভালো পদক্ষেপ নিক। তাহলে ভালো একটা ফলাফল আসতে পারে।"
শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়ায় সম্প্রীতি মঞ্চ আয়োজিত 'সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি অধ্যাপক অজয় রায় আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন।
রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো বলেন, "সংখ্যালঘু শব্দটিই আমার কাছে আপত্তিকর। বিএনপির মতো দল জামায়াতের পাশে থাকাতে তাদের শক্তি বেড়ে গেছে। এ ধরনের আক্রমণ আগেও হয়েছে। তখন সব রাজনৈতিক দল একত্রে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবরি মসজিদ ভাঙচুরের পর এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে এই ধরনের ঘটনায়র প্রতিকার হয়েছে। তবে এই বার এক মাসের বেশি সময় এই ধরসের ঘটনা ঘটলেও তা প্রতিহত করা হচ্ছে না। এই ঘটনা অবশ্যই রাজনৈতিক।"
তিনি বলেন, "জামায়াতে ইসলাম এতটা শক্তিশালী নয়। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচিতে বড় বড় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রশাসনের দুর্বলতা আছে। প্রশাসনে জামায়াতপন্থি লোক আছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপসকামী মনোভাব রয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম আন্দোলন শুরু করেছে, কেন এখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না। সরকারের শৈথিল্য রয়েছে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে। প্রতিরোধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এদের প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে নারীসহ সব ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধ করা যাবে না।"
ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, "খালেদা জিয়া ও তার ছেলেদের মামলা রয়েছে। যে দিনে তাদের মামলার তারিখ রয়েছে সেদিনই তারা হরতাল দিয়ে থাকে। বিএনপির উদ্দেশ্য হলো তারা আর বাংলাদেশে থাকতে চান না, তারা আবার পাকিস্তানে ফিরে যেতে চাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি থাকতে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যারা প্রশাসনে আছেন তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হয়ে থাকেন, কেন তাদের প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। আপসকামিতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে কি ভাবছে তা নিয়েও ভাবতে হবে।"
তিনি আরো বলেন, "সম্প্রীতি মঞ্চের মাধ্যমেও এই বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন নাগরিক সমাজ এ নিয়ে কাজ করতে পারেন। ভারতে এ ধরনের হামলা হলে তারা তা প্রতিরোধ করার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। এখন সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এইভাবে দেশ ছাড়ার ফলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, "আমাদের তরুণ সমাজ অনেক দিন এই নির্যাতনের পাশে দাঁড়ায়নি। তবে বর্তমানে তরুণ সমাজ শাহবাগে আন্দোলন করছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ফ্যাশন শো সব বিভিন্ন কিছু দেখানো হচ্ছে যা আমরা দেখতে চাই না। তাই এই ক্ষেত্রে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। গণ্যমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।"
তিনি আরো বলেন, "ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই তিন মাসের মধ্যে কয়েকটি রায় হয়ে যাবে। তাই পরবর্তী মামলার রায়ের পর কী ধরনের অবস্থা হতে পারে তার জন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে।"
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, "আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটোই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল। তা না হলে, রায়ের আগে কেন জামায়াতকে মতিঝিলে সমাবেশ করতে দেয়া হলো। 'আঁতাতের এই রায় মানি না' এ স্লোগানে নিয়ে শাহবাগে আন্দোলন শুরু হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্তে যদি না থাকে, তবে তা দিয়ে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।"
তিনি বলেন, "এরশাদকে গৃহপালিত বিরোধীদল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত শিবিরের নিষিদ্ধ করতে হবে। বিএনপিকে জামায়াত শিবিরকে ত্যাগ করে নির্বাচনী ইস্যুকে নিয়ে আসেন। সবাই নির্বাচনে অংশ না নিলে আসলে নির্বাচন হবে না।"
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিব মীর বলেন, "আক্রান্ত এলাকা গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, সরকার রাজনৈতিকভাবে সহিংসতা দমন করেতে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগও ব্যর্থ হয়েছে। যারা অপরাধ করছে তাদের বিচার করা হচ্ছে না। রামুর ঘটনায় যারা ঘটিয়েছে তাদের ছবি থাকা সত্ত্বেও তাদের বিচার হচ্ছে না। এই বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের গোয়েন্দারা কী করছে। তারা না পারলে আমাদের নিয়োগ দেয়া হোক। বাংলাদেশের প্রগতিশীল পত্রিকাগুলোও এটা নিয়ে কাজ করছে না। মিডিয়ার উচিত এই বিষয়ে বেশি কাজ করা।"
সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, "আমরা যে বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসেছি তা দুঃখজনক। এই ঘটনার মুখোমুখি যদি রাষ্ট্রকে দাঁড় করা উচিত।যারা রাষ্ট্রের চালক তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এটা কিভাবে করতে তা নতুন করে ভাবতে হবে।"
তিনি বলেন, "বিএনপির আমলে যে ঘটনা ঘটেছে তার বিচার বিএনপি করবে তা আমরা বিশ্বাস করি না। আওয়ামী লীগ তো চার বছর ক্ষমতায়। তবে তারা কেন বিচার করলো না। এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্ম কিভাবে সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে তা দেখা গেছে। জামায়াত আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করেছে, কিভাবে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় সেজন্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে আগামী দিনের ভোটের হিসাবের সঙ্গে মিলানো হয়েছে। বিএনপি অফিসে নেতাকর্মীদের ধরার ফলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক কারণেই ঘটছে। একটি স্কুলে হামলা করা হয়েছে। নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ নিয়ে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।"
সাংবাদিক শিশির মোড়ল বলেন, "১৫টি জেলায় ২০০১ ও ২০১১ সালে হিন্দু কমেছে। গোপালগঞ্জে সব সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তারপর কেন সেখানে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে।"
আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং বলেন, "এই চার বছরে আমাদের একটি হতাশার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা, আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না।"
সম্প্রীতি মঞ্চের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনে পাশে দাঁড়ানোসহ ছয়টি দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়াও সম্প্রীতি মঞ্চের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলায়-উপজেলায় জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে জানানো হয়। যে কমিটি পর্যবেক্ষণ সেলের মাধ্যমে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর রেভে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকাকে সহযোগিতা করবে।
নতুন বার্তা/এইচকেএ/জবা