|
রাজিব হত্যাকাণ্ডে আটক নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ শিক্ষার্থী। ছবি: মুজিবুর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম |
ঢাকা: ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা করেন ছাত্র শিবিরের এক বড় ভাই।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিবি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
গত শুক্রবার রাতে রাজীব হত্যাকাণ্ডে জড়িত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচ ছাত্রকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন ফয়সাল বিন নাইম (২২), মাকসুদুল হাসান অনিক (২৬), এহসানুর রেজা রোমান (২৩), নাঈম সিকদার (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ (২২)।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সবাই রাজীব হত্যার কথা স্বীকার করেছেন বলেই জানান মনিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "আটক ছাত্ররা জানিয়েছেন রাজীবকে হত্যা করা তাদের ইমানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলেই তারা এটা করেছে।"
মূল পরিকল্পনাকারী শিবিরের সেই বড় ভাইকে গ্রেফতার করা হয়নি জানিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, "তাকে গ্রেফতারে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনিও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র।"
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম (পশ্চিম), ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান, এডিসি মশিউর রহমান, অতিরিক্ত উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার, সিনিয়র সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম।
তার নেতৃত্বে একাধিক টিম ঢাকা মহানগরীর কাঁকরাইল, বারিধারা বসুন্ধরা, পান্থপথ এবং খিলগাঁও এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম কর্মী এবং ব্লগার রাজীব হায়দাদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের আটক করে। এ সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ২টি চাপাতি, ৪ টি ছোরা, ১টি বাই সাইকেল, ১ জোড়া কেডস, ৭টি বিভিন্ন মডেলের মোবাইল ফোন সেট ও ১টি স্কুল ব্যাগ উদ্ধার করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবী পলাশ নগরে নিজ বাসার সামনে ব্লগার রাজীব হায়দার অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন এবং এই হত্যাকাণ্ডের পর পল্লবী থানায় নিয়মিত মামলা দায়ের হয়। পরে পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (পশ্চিম) বিভাগ ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ৫ জনকে।
আটক আসামিদের মধ্যে ফয়সাল বিন নাঈমের বাড়ি মাতুয়াইল, ঢাকা এবং অনিকের বাড়ি- কেরাণীগঞ্জ এবং তারা দু'জনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।
নাঈম কোডা কলেজ, ঢাকা থেকে এইচ এস সি পাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, অনিক ম্যাপল লিফ থেকে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। রুম্মানের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায় ও ইরাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তারা দু'জনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামি নাফিস ইমতিয়াজ সান সাইন গ্রামার স্কুল থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল পাশ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ'তে ভর্তি হয় এবং বর্তমানে সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি সন্দ্বীপে।
গ্রেফতার হওয়া আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, তারা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাজ কক্ষে নামাজ পড়তে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হয়। সেই সূত্রে তারা ইসলামিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করত এবং ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করত। তাদের গ্রুপের এক বন্ধু একসময় বাংলাদেশ ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। সেই বন্ধুটি তাদের ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগের ঠিকানা দেয় এবং সেইসব ব্লগ থেকে ডাউনলোড করা তথ্য তাদের মধ্যে সরবরাহ করে। এই বন্ধু গ্রুপের সদস্যরা এইভাবে থাবা বাবাসহ বিভিন্ন ব্লগারের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং একপর্যায়ে 'থাবা বাবা' সম্পর্কে রটানো বিভিন্ন গুজবে বিশ্বাস করে থাবা বাবা নামধারী ব্লগারকে সনাক্ত করে তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন রাতে পল্লবীর পলাশ নগর এলাকার নিজ বাসার সামনের রাস্তায় এই উগ্রপন্থী ও ধর্মান্ধ আসামিদের হাতে থাবা বাবা নামধারী ব্লগার রাজীব হায়দার নিহত হন।
মনিরুল বলেন, "আটক ব্যক্তিরা সবাই আলোচনা সাপেক্ষে ব্লগার রাজীবকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। তারা রাজীবের ব্লগে এবং ফেসবুকে ঢুকে রাজীব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে এবং রাজিবের বন্ধুদের পরিচয় ও ছবি দেখে রাজীবকে ফেসবুকে শনাক্ত করে। তারা নিয়মিতভাবে রাজিবের ফেসবুক একাউন্ট সার্চ করে এবং শাহবাগ গণজাগরণ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তারা রাজীবের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারে রাজিব শাহবাগে আসবে।
তখন তারা তাকে শনাক্ত করার জন্য একটি গ্রুপ যার নাম 'ইনটেল গ্রুপ'এবং শনাক্ত করে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য অপর গ্রুপ যার নাম 'এক্সিকিউশন গ্রুপ' গঠন করে। ইনটেল গ্রুপের সদস্য হচ্ছে- এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম সিকদার ইরাদ সহ আরও দু'জন। এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্য হচ্ছে- ফয়সাল বিন নাঈম, মাকসুদুল হাসান অনিকসহ আরও একজন। ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তথ্য সংগ্রহ ও রেকি করবে।
ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ যায় এবং থাবা বাবা নামধারী ব্লগার রাজীবকে খোঁজা শুরু করে। এর ২/১ দিনের মধ্যেই 'থাবা বাবা'র বন্ধুদেরকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে ব্লগার রাজীবকে চিনতে পারে তারা। রাজীবকে চেনার পর ইনটেল গ্রুপের সদস্য মো. এহসান রেজা রুম্মান শাহবাগ থেকে সাইকেলযোগে বাসে ওঠা রাজীবকে অনুসরণ করে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত যায়। প্রথম দিন রাজীবের বাসা চিহ্নিত করতে পারে নি। এর পরে পুনরায় তাকে একইভাবে অনুসরণ করে রাজীবের পল্লবীস্থ পলাশনগরের বাসা চিহ্নিত করে।
রাজীবের বাসা চিহ্নিত করার পর কয়েকদিন ধরে ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা তাকে রেকি করা শুরু করে। এসময় বিভিন্ন তথ্যও সংগ্রহ করে। তারা রাজীব কখন বাসায় আসে, কখন বের হয়, কার সঙ্গে ঘোরাফেরা করে এবং কি ধরনের কাজ করে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। ইনটেল গ্রুপের সদস্য মাকসুদুল হাসান অনিক হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অস্ত্র কেনা ও অন্যান্য খরচ বাবদ টাকা দিয়ে সাহায্যে করে।
অনিক নিজেই বাড্ডা নতুন বাজারের একটি দোকান থেকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে চাপাতি ও ছোরা কেনে। তথ্য সংগ্রহ ও যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে ঘটনার দিন সবাই মিলে সাইকেলে ও বাসে চড়ে বিকাল ৪টার দিকে পল্লবীর পলাশ নগরে অবস্থিত রাজীবদের বাসার গলিতে অবস্থান নেয় এবং স্কুল ব্যাগ, ক্রিকেটের ব্যাট ও বল ইত্যাদি সঙ্গে রাখে। আসামিরা সবাই মিলে গলিতে ক্রিকেট খেলে এবং রাজীবের বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকে।
সন্ধ্যার দিকে রাজীব যখন পল্লবীর বাইশটেকি হয়ে তার বাসার দিকে যাচ্ছিলেন তখন ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা তাকে অনুসরণ করে এবং বাসার গেইটের কাছাকাছি পৌঁছার পর এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্যদের একজন ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। এতে আহত হয়ে রাজীব চিৎকার করে দেয়ালের ওপর পড়ে যান। তারপর ফয়সাল রাজীবকে চাপাতি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। আসামি অনিকও তার হাতে থাকা ছোরা দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।
এসময় কেউ একজন খুন খুন বলে চিৎকার করলে আসামিরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
মনিরুল আরও জানান, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘটনাস্থল ছাড়ার আগে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি চাপাতি রাস্তার মোড়ের পানের দোকানের সামনে ফেলে যায় তারা। রাজীবকে হত্যা করার সময় আসামি নাঈমের এলোপাথাড়ি কোপের একটি কোপ অনিকের পায়ের জুতোয় লাগে। এতে তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের কিছু অংশ কেটে যায়।
পরে অনিক রুম্মানের সঙ্গে কাঁকরাইল এলাকায় জুতাজোড়া খুলে জাতীয় চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের পুকুর পাড়ে ফেলে যায়।
অনিক গ্রেফতার হওয়ার পর তার সহায়তায় জুতাজোড়াও উদ্ধার করা হয় জানিয়ে মনিরুল আরও জানান, গ্রেফতার হওয়া আসামিরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আরও একটি চাপাতি ও চারটি ছোরা শেরে বাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের রাস্তার পাশে ড্রেনের মধ্যে ফেলে যায়। তাদেরই দেওয়া তথ্য ধরে সেগুলো উদ্ধার করে মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয় বলে জানান তিনি।
এ হত্যাকাণ্ডে আসামিরা একটি সাইকেল ও দু'টি স্কুল ব্যাগ ব্যবহার করেছে। সেগুলোও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান মনিরুল।
প্রাথমিক তদন্তে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মোট ৭ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "গ্রেফতার করা ৫জন ছাড়া পলাতক অপর ২ জন আসামিকে গ্রেফতারে তৎপরতা অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১৩
আইএ/আরআর