প্রকাশ : ০৫ মে, ২০১৩ ১৯:৩৬:১৫আপডেট : ০৬ মে, ২০১৩ ০৮:১০:৪৩ |
হেফাজতি তাণ্ডব, নিহত ১১
মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি রোববার রাতেও সংলগ্ন এলাকায় তাণ্ডব চালায় আহমদ শফীর হেফাজতে ইসলাম।
অনলাইন ডেস্ক
'ঢাকা অবরোধ' ও মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র্র করে রোববার তাণ্ডব চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
বায়তুল মোকাররমের উত্তর পাশে মুক্তি ভবনে আগুন দিয়েছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। এই ভবনেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয়। ভবন সংলগ্ন ফুটপাথের কিছু বইয়ের দোকানেও আগুন দেয় তারা। ছবি: সমকাল
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হেফাজতকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে পল্টন, গুলিস্তান, বিজয়নগর, তোপখানা রোড, বায়তুল মোকাররমের উত্তর-দক্ষিণ গেট ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
পল্টনে দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিরামহীন সংঘর্ষ চলে। বিভীষিকাময় এ সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়েছেন।
তবে নিহতের এ সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। হেফাজতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা ১৬।
বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। তাদের মধ্যে ৭ জন প্রাইভেট ক্লিনিকে মারা যান। আহত হন অন্তত দেড় শতাধিক। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত ১২ জন সাংবাদিকও আহত হয়েছেন। আগুন দেওয়া হয় শতাধিক দোকানে।
রাতে হাউস বিল্ডিং, বায়তুল মোকাররম মার্কেটের তিন দিকে অগি্নসংযোগ করে হেফাজত কর্মীরা। আগুন নেভাতে গেলে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের বাধা দেওয়া হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাত ৮টায় রাজধানীতে মোতায়েন করা হয় বিজিবি। শাপলা চত্বরে সমাবেশ শেষে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা অবস্থান গ্রহণ করে।
রাত ১০টার পর সংঘর্ষ কিছুটা থেমে আসে। তবে রাত ১২টায় মতিঝিলের কাছে নয়া পল্টন ও ফকিরাপুলে পুলিশের সাথে আবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ শেষ করে সংগঠনপ্রধান আল্লামা আহমদ শফীর নির্দেশে তারা তখন সেখানেই অবস্থান করছিলেন।
এর আগে দুপুরে গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অন্তত ১০টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় হেফাজতকর্মীরা। সেখানে হেফাজতকর্মীদের সাথে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ বলছে, হেফাজতের ব্যানারে সংগঠনটির কর্মী-সমর্থক ছাড়াও জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সমর্থকরা জড়িত ছিল।
তবে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বলেন, 'সংঘর্ষ-ভাংচুরের সঙ্গে হেফাজতের কর্মীরা জড়িত নয়। পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন হেফাজত কর্মীদের ওপর হামলা করে। অনুপ্রবেশকারী ও সরকারি লোকজনই ভাংচুর-হামলা করেছে।'
'নাস্তিক ব্লগারদের' শাস্তি ও নারী নীতি বাতিলসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলামের অবরোধে ভোরেই সারাদেশ থেকে 'বিচ্ছিন্ন' হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। রাজধানীর ছয়টি প্রবেশপথে দুপুর পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচির পর সমাবেশে অংশ নিতে যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, উত্তরা, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে যাত্রা করেন হেফাজতকর্মীরা।
বাস শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীসহ নিহত ১১
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় ১১ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে সিদ্দিকুর রহমান নামে এক বাস শ্রমিকও রয়েছেন। এছাড়া দৈনিক বাংলার মোড়ে নাহিদ নামে এক দোকান কর্মচারী ও অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি নিহত হন। অন্যদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার দুপুর দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় হানিফ পরিবহনের একটি বাসের হেলপার সিদ্দিকুর গুলিবিদ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে বিকেল ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিদ্দিকুর।
বাসটির চালক জুয়েল জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে তাদের বাসটি চলাচল করে। তবে তিন দিন আগে বাসটি পুলিশ রিকুইজিশনে নেয়। পুলিশ ডিউটি করার সময় দুপুরে তিনি ও হেলপার সিদ্দিকুর আওয়ামী লীগ অফিসের অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন তার সহকর্মী।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ বক্সের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল হক জানান, সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে নাহিদ (২২) নামে এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই যুবক টিকাটুলী এলাকায় এক দোকানের কর্মচারী ছিলেন। বিকেল ৫টার দিকে গুলিবিদ্ধ ও মাথায় জখম নাহিদকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
নাহিদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ২৭৪ নম্বর জয়কালী মন্দির এলাকায় থাকতেন। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাটে।
ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল জানান, ওই দু'জন ছাড়াও সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি আহত অবস্থায় মারা যান। আনুমানিক ৪০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির পরনে চেক লুঙ্গি ও আকাশি রঙের ফুলহাতা জামা রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের কাকরাইল শাখার সহকারী কর্মকর্তা এসএম জাবেদ রাতে ফোনে সমকালকে জানান, বিকেলে তাদের হাসপাতালে দুই হেফাজতকর্মী মারা যান। সঙ্গে সঙ্গে হেফাজতকর্মীরা তাদের নিয়ে যায়।
আল-বারাকা হাসপাতালে টেলিফোন করা হলে ফোন অপারেটর পরিচয় দিয়ে বলা হয়, সংঘর্ষের ঘটনায় তাদের হাসপাতালে ছয়জন মারা যায়। তাদের মধ্যে চারজন হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান।
রাজধানীতে দফায় দফায় সংঘর্ষ
সকাল ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ি থেকে আসা হেফাজতকর্মীদের একটি দল বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড সরিয়ে এগুতে চাইলে শুরু হয় সংঘর্ষ। হেফাজতকর্মীদের ইট-পাটকেলের জবাবে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়লেও দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে।
একপর্যায়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট ও বিজয়নগরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা এ সময় কমপক্ষে ২০টি গাড়িও ভাংচুর করে। একপর্যায়ে স্টেডিয়াম, রাজউক ভবন, গুলিস্তান ও গোলাপ শাহ মাজার এলাকাতেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে জড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরাও।
এরপর সংঘর্ঘ ছড়িয়ে পড়ে নয়াপল্টন ও কাকরাইল এলাকাতেও। পুলিশের রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ঠেকাতে পাল্টা ঢিল ছুড়তে দেখা যায় হামলাকারীদের।
মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে সমকাল প্রতিবেদক জানান, সংঘর্ষে আহত ৩০ জনকে মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই গুলিতে আহত হয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
সমাবেশ সংলগ্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ
সকাল থেকে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়া হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা দুপুরের পর রাজধানীর পল্টনের কয়েকটি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন।
প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানায়, দুপুর থেকেই পল্টনের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর চালায় ও আগুন দেন হেফাজতকর্মীরা। সহিংসতার একপর্যায়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কার্যালয়, সংলগ্ন মুক্তি ভবন ও ফুটপাথের বইয়ের দোকান, উল্টো দিকের র্যাংগস ভবন এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ভবনে আগুন দেওয়া হয়।
র্যাংগস ভবনের আটতলা ও নয়তলায় 'সকালের খবর' পত্রিকার কার্যালয় রয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেখানে যেতে চাইলে হেফাজতকর্মীরা বাধা দেয়। এ সময় র্যাংগসের ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদেরকে মারধরও করা হয়।
পরে পুলিশের পাহারায় আগুন নেভান ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
এরপর সন্ধ্যায় পুরানা পল্টনের হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ও জিপিও ভবন এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের দোতলায় আগুন দেন হেফাজতকর্মীরা। আগুন নেভাতে পুলিশ মার্কেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে হেফাজতের কর্মীরা তাদেরকে বাধা দেন। এ সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেলও ছোড়েন।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, পল্টন এলাকার বেশকিছু স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে। জিপিওতে আগুন নেভাতে যাওয়ার সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আটকে দিয়েছেন হেফাজতকর্মীরা। তবে পুলিশ পাহারায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কাজ করেন।
উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলরত শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাদের 'নাস্তিক' আখ্যা দেওয়া চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলাম রোববার 'ঢাকা অবরোধ' কর্মসূচি পালন করে। বিকেলে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তারা সমাবেশও করে।
এর আগে গত ৬ এপ্রিল ঢাকামুখি লংমার্চ কর্মসূচি পালন করেছিল হেফাজত। সেদিনও তারা মতিঝিলে সমাবেশ করে। ওইদিন সমাবেশের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় হেফাজতকর্মীরা। এছাড়া সমাবেশ শেষে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চেও হামলার চেষ্টা চালায় তারা।
http://www.samakal.net/lead-news/2013/05/05/2748
Also Read:
হেফাজতের তাণ্ডব: মতিঝিলের সর্বত্র ধ্বংসের স্বাক্ষর
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
মতিঝিলে চলছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান
বাংলানিউজ টিম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
মতিঝিল এখন হেফাজত শূন্য
বাংলানিউজ টিম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
মুহূর্তেই ফাঁকা শাপলা চত্বর
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে প্রস্থান
কো-অর্ডিনেশন এডিটর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
হেফাজতের নিরাপত্তা ব্যুহ টিকলনা
ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
হেফাজতের পাশে থাকার আহবান খালেদার
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
http://www.amaderorthoneeti.com/content/2013/05/06/news0335.htm
__._,_.___