মূর্তির সংস্কৃতি invades Saudi Arabia too!!!
Even there are mannequins in the Zumzum Mall near Masjid Al Haram i.e Kaba Sharif
which is just100 yards away:
--- On Sat, 5/4/13, lutful bari <lutfulb2000@yahoo.com> wrote:
From: lutful bari <lutfulb2000@yahoo.com>
Subject: [mukto-mona] Fw: ভাস্কর্যের নামে মূর্তির সংস্কৃতি----Amar Desh
To:
Date: Saturday, May 4, 2013, 3:09 AM
----- Forwarded Message -----
Subject: [mukto-mona] Fw: ভাস্কর্যের নামে মূর্তির সংস্কৃতি----Amar Desh
To:
Date: Saturday, May 4, 2013, 3:09 AM
----- Forwarded Message -----
In Bangladesh,in the name of sculpture idols of men or animals should not be made.There can be made many more beautiful sculpture without such idols as we see in history.
Shah Abdul Hannan
ভাস্কর্যের নামে মূর্তির সংস্কৃতি
ড. হা রু ন - অ র র শি দ স র কা র
« আগের সংবাদ | পরের সংবাদ» |
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার একটি হলো—'মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা'র দাবি। অনেকেই এই দাবিটিকে 'মধ্যযুগীয়' বলে নিন্দা করেছেন এই বলে যে, আলেম সমাজ ভাস্কর্য নির্মাণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু দাবিটিতে পরিষ্কার করেই বলা আছে, 'ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা'। আলেমরা পরিষ্কার করে বলেছেন, ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে তারা নন, বরং 'ভাস্কর্যের নামে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তি নির্মাণে'র বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। তারা ব্যাখ্যায় এটাও তুলে ধরেছেন যে ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। আসলেও তাই। একটি ভাস্কর্য 'বিমূর্ত' হলে অর্থাত্ প্রাণীদেহ বর্জিত হলে সেটি ইসলামে নিন্দনীয় নয়। সৌদি আরবের মক্কা নগরে প্রবেশের সময় বিখ্যাত 'মক্কা গেট' সবার নজর কাড়ে। এটি একটি বিখ্যাত ভাস্কর্য। তবে এটি বিমূর্ত, একটি কোরআন শরিফকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এতে। আরবের রিয়াদ ও জেদ্দা শহরের অনেক সড়কদ্বীপে ও সাগরের তীরে সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য আছে। সেগুলো বিমূর্ত, মনুষ্যমূর্তি তারা গড়েনি। কিন্তু বাংলাদেশে চলছে ঢালাওভাবে প্রাণিমূর্তি নির্মাণ। ভাস্কর্যে বিমূর্ত মোটিফ যে আরও বেশি নান্দনিক এবং সৃষ্টিশীল হয়—তা যেন ভুলতেই বসেছেন আমাদের ভাস্কররা! সুতরাং বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মানুষকে নাড়া দেবে—এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের দাবি কতখানি যৌক্তিক—তা বিবেচনা করতে গেলে এদেশে ভাস্কর্যের আদিগন্ত ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন। মনে রাখা উচিত, মূর্তির নির্মাণ পূজার নিমিত্তে আর ভাস্কর্যের নির্মাণ শিল্প-সৌন্দর্যের জন্য। ভাস্কর্যের বিষয় মূর্তি কিংবা বিমূর্ত হতে পারে। মূর্তি হলেই সেখানে আপত্তি আসতে পারে। কেননা, এটি সর্বজনীন নয়। মূর্তির আগমন পূজার উদ্দেশ্যেই। ভারতবর্ষে মূর্তি-ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত স্থান উত্তর ভারতের মথুরা। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও বেড়ে ওঠার স্থান মথুরা-বৃন্দাবন হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তীর্থস্থান। এখানে পূজা-অর্চণার জন্য ব্যাপকভাবে মূর্তি নির্মিত হতো। ফলে মথুরার শিল্পীরা মূর্তি-ভাস্কর্যের একটি ধারা তৈরি করে ফেলেন, যাকে বলা হয়ে থাকে 'কুষাণরীতি'। কুষাণরীতি বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ভাস্কর্যের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সর্বপ্রাচীন তিনটি মূর্তি রয়েছে, যার প্রথমটি সূর্য দেবতার। মূর্তিটি একটি উঁচু বেদির ওপর নির্মিত। সাতঘোড়ার রথের ওপর দু'পাশে দুজন পরিচারকের মাঝে দেবতা সূর্য দণ্ডায়মান। রথের চালক অরুণ দেবতা সূর্যের সামনে উবু হয়ে আসীন হয়ে আছেন। বাংলায় প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রাথমিক পর্যায়ের শিল্পকর্ম এটি।
৩০০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেছে গুপ্ত বংশের রাজারা, যারা ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তারা বিষ্ণুর পূজা করতেন। রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, খুলনা প্রভৃতি স্থান থেকে অনেক মূল্যবান বিষ্ণুমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলো বরেন্দ্র জাদুঘরসহ দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এগুলো গুপ্তযুগের ধর্মীর সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। বৈষ্ণব কালচারের প্রতিনিধি এই ভাস্কর্যগুলোতে দেখা যায় বিষ্ণুর চার হাতে চারটি অস্ত্র; যথা—শঙ্খ, চর্ক, গদা ও পদ্ম। তত্কালীন পুরোহিতরা দেবতার যে চারিত্রিক বর্ণনা দিয়েছিলেন, শিল্পীরাও নিজ নিজ কল্পনায় তাই-ই নির্মাণ করেছেন।
পাল বংশের শাসকরা বাংলা শাসন করেছেন ১০৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। পাল শাসক ধর্মপাল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধবিহার, মঠ ও মন্দিরে বুদ্ধ ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল ব্যাপকভাবে। সেসব বুদ্ধ ভাস্কর্যের বিপুল সংগ্রহ রয়েছে আমাদের দেশের ছোট-বড় সব জাদুঘরে। পালদের সময়কার দুটি বিখ্যাত স্থাপনা পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ও কুমিল্লার ময়নামতি বিহার। এ দুটি স্থাপনা থেকে প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলো বরেন্দ্র জাদুঘর ও ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দেখলে বোঝা যায় যে, সেগুলো নিছক ধর্মীয় আবেগে ও পূজার প্রয়োজনে নির্মিত। সে সময়কার একটি মূল্যবান ভাস্কর্য হলো মঞ্জুশ্রী ভাস্কর্য। এই মূর্তিতে দেখা যায়, দেবী তার ডান হাতে ভক্তদের আশীর্বাদ দিচ্ছেন আর বাম হাত দিয়ে বরাভয় প্রদান করছেন।
পালদের পর সেন রাজারা বাংলার শাসন ক্ষমতায় আসেন এবং ১২০৪ পর্যন্ত বাংলার পশ্চিমাংশ এবং ১২৩০ পর্যন্ত পূর্ববাংলা (বর্তমান ঢাকা অঞ্চলসহ) শাসন করেন। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, যারা হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। সেন শাসকরা তাদের মন্দিরে ও গৃহে বিষ্ণু, শিব, সূর্য, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী, মনষা, গঙ্গা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করান। সেন যুগের সেসব ভাস্কর্যও বাংলাদেশের জাদুঘরগুলোতে আছে। কোনো না কোনো মন্দির থেকে সেগুলো সংগৃহীত।
সেনদের পর বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুসলিম শাসকরা। মুসলিম শাসনামলে এসে ভাস্কর্য শিল্পের ধারায় পরিবর্তন আসে। দেব-দেবীর মূর্তির পরিবর্তে বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে ফুল, লতা-পাতা, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি অঙ্কিত হতে থাকে। কেননা, মুসলিম সংস্কৃতিতে প্রাণীর মূর্তি গড়ার ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। মুসলিম শাসকরা এটি অনুসরণ করেই শিল্পস্থাপনা নির্মাণ করে গেছেন। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের নানা স্থানে মুসলিম শাসনকে আজও অম্লান করে রেখেছে মুসলিম স্থাপত্যকর্ম। অনেক বিখ্যাত শহর গড়ে তুলেছেন তারা কিন্তু কোনো স্থাপত্যেই প্রাণীর কোনো মূর্তি তারা নির্মাণ করেননি। ভারতের দিল্লি, আগ্রা, বিজাপুর, গুজরাটসহ পুরো ভারতবর্ষজুড়ে অসংখ্য শহর, নগর, মসজিদ, খানকাহ্, দরগাহ্, মিনার, স্মৃতিসৌধ মুসলিম শাসকরা নির্মাণ করেছেন; কিন্তু কোথাও প্রাণীর কোনো প্রতিকৃতি চোখে পড়ে না। ভাস্কর্য ছাড়াই মধ্যযুগের স্থাপনা বিখ্যাত হয়ে আছে।
বাংলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্যগুলো আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অতীত ঐতিহ্যকে স্পষ্টভাবে আজও তুলে ধরছে। পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ কমপ্লেক্স, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং তত্সংলগ্ন মাজার, খানকাহ্ ও অন্যান্য স্থাপত্য কমপ্লেক্স, নওগাঁর বিখ্যাত মাহিসন্তোষ মসজিদ, গৌড়ের বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র দরসবাড়ি মাদরাসা কমপ্লেক্স মুসলিম স্থাপত্য নকশার জন্য বিখ্যাত। এগুলোর কোথাও প্রাণিমূর্তি নেই। রাজধানী শহর গৌড়-লক্ষেষ্টৗ, ফিরোজাবাদ (পাণ্ডুয়া), সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী কিংবা মোগল আমলে নির্মিত লালবাগের কেল্লা, নবাবদের স্থাপনা আহসান মঞ্জিলসহ কোনো স্থাপত্যের সঙ্গে কিংবা রাস্তাঘাটে প্রাণীর চিত্র সংবলিত কোনো শিল্পকর্ম নির্মিত হয়নি। যদিও স্থাপত্যশিল্পীরা অন্য যে কোনো আমলের চেয়ে মুসলিম আমলে বেশি কর্মব্যস্ত ও সৃষ্টিশীল ছিলেন। পাথরে খোদাই করার কাজে নিয়োজিত শিল্পীদের আলাদা পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল সে সময়। কিন্তু তারা মূর্তি-ভাস্কর্য নির্মাণ করেননি। মুসলিম স্থাপত্য সব যুগেই প্রাণিচিত্র বিবর্জিত। ইংরেজ আমলেও বাংলার প্রকাশ্য কোনো স্থানে মূর্তির ভাস্কর্য নির্মিত হয়নি। তবে আধুনিক যুগে এসে অনেক সৌখিন জমিদার নিজ উদ্যোগে প্রাসাদে-বাগানে নিজেদের আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা ছিল সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তবে তারা ছিলেন আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
সুতরাং প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়কালের ভাস্কর্য শিল্পের পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো যুগেই প্রাণিমূর্তি পূজা-অর্চণা ব্যতীত নির্মিত হয়নি। দেবতা কিংবা দেবীরা যেহেতু কেউই সব সময় সর্বজনীন-সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন না, সেজন্য বোধ হয় জনসম্মুখে পূজনীয়দের কেউ আনতে চাননি। নিজ গৃহে-মন্দিরে নিভৃতে তাদের গড়েছেন।
স্বাধীনতার পর সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাই মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিয়ে গান বাঁধা, নাটক নির্মাণ, গল্প-কবিতা রচনা করা হয়ে ওঠে খুবই সৃষ্টিশীল ও আনন্দদায়ক বিষয় হিসেবে। এদেশের ভাস্কর্যশিল্পীরাও শিল্পকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে থাকেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এভাবে প্রকাশ্য জনসম্মুখে প্রাণীর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। বিষয়টি মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসীদের কাছে আপত্তিকর হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হওয়ার কারণে সম্ভবত এদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামারা তীব্র আপত্তি তোলেননি। যারা আপত্তি তুলেছেন, তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবে এমনভাবে মিডিয়ায় চিহ্নিত করা হয়েছে যে— ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একের পর এক মূল্যবান ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়, যেগুলোতে মোটিফ হিসেবে মনুষ্যমূর্তিকে তুলে ধরা হয়। তবে আলেম-ওলামারা মৃদু আপত্তি তোলা ছাড়া বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেননি। কেননা, ভাস্কর্যের সমর্থকরা বিষয়টিকে এমনভাবে প্রচার করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতারই নামান্তর।
সুতরাং বড় বড় শহরের দর্শনীয় স্থানে ভাস্কর্যের নামে প্রাণিমূর্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে বিষয়টির ঐতিহাসিকতা বিবেচনা করা উচিত। এ দেশের সংস্কৃতির ইতিহাস বলে যে, প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ ও তার প্রদর্শন বিশেষ কোনো ধর্মের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সব ধর্মের জন্য এটি গ্রহণযোগ্য হবে—এমন নয়। তাই ভাস্কর্যের নির্মাণে 'মূর্তি'কে বর্জন করলেই কিন্তু বিষয়টির সুরাহা হয়। কয়েক বছর আগে ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে লালনের মূর্তি স্থাপন করার পর এটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতিবাদের পর সেখানে বিমূর্ত ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। খেয়াল রাখা উচিত, সৌন্দর্য বা সংস্কৃতির নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া কখনই ইতিবাচক হতে পারে না। হেফাজতে ইসলামের দাবিটিকে তাই 'মধ্যযুগীয়' বলে আখ্যায়িত করার সুযোগ নেই, দাবিটির যৌক্তিকতা রয়েছে।
লেখক : গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী
harunsarkar2005@yahoo.com
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের দাবি কতখানি যৌক্তিক—তা বিবেচনা করতে গেলে এদেশে ভাস্কর্যের আদিগন্ত ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন। মনে রাখা উচিত, মূর্তির নির্মাণ পূজার নিমিত্তে আর ভাস্কর্যের নির্মাণ শিল্প-সৌন্দর্যের জন্য। ভাস্কর্যের বিষয় মূর্তি কিংবা বিমূর্ত হতে পারে। মূর্তি হলেই সেখানে আপত্তি আসতে পারে। কেননা, এটি সর্বজনীন নয়। মূর্তির আগমন পূজার উদ্দেশ্যেই। ভারতবর্ষে মূর্তি-ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত স্থান উত্তর ভারতের মথুরা। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও বেড়ে ওঠার স্থান মথুরা-বৃন্দাবন হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তীর্থস্থান। এখানে পূজা-অর্চণার জন্য ব্যাপকভাবে মূর্তি নির্মিত হতো। ফলে মথুরার শিল্পীরা মূর্তি-ভাস্কর্যের একটি ধারা তৈরি করে ফেলেন, যাকে বলা হয়ে থাকে 'কুষাণরীতি'। কুষাণরীতি বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ভাস্কর্যের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সর্বপ্রাচীন তিনটি মূর্তি রয়েছে, যার প্রথমটি সূর্য দেবতার। মূর্তিটি একটি উঁচু বেদির ওপর নির্মিত। সাতঘোড়ার রথের ওপর দু'পাশে দুজন পরিচারকের মাঝে দেবতা সূর্য দণ্ডায়মান। রথের চালক অরুণ দেবতা সূর্যের সামনে উবু হয়ে আসীন হয়ে আছেন। বাংলায় প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রাথমিক পর্যায়ের শিল্পকর্ম এটি।
৩০০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেছে গুপ্ত বংশের রাজারা, যারা ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তারা বিষ্ণুর পূজা করতেন। রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, খুলনা প্রভৃতি স্থান থেকে অনেক মূল্যবান বিষ্ণুমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলো বরেন্দ্র জাদুঘরসহ দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এগুলো গুপ্তযুগের ধর্মীর সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। বৈষ্ণব কালচারের প্রতিনিধি এই ভাস্কর্যগুলোতে দেখা যায় বিষ্ণুর চার হাতে চারটি অস্ত্র; যথা—শঙ্খ, চর্ক, গদা ও পদ্ম। তত্কালীন পুরোহিতরা দেবতার যে চারিত্রিক বর্ণনা দিয়েছিলেন, শিল্পীরাও নিজ নিজ কল্পনায় তাই-ই নির্মাণ করেছেন।
পাল বংশের শাসকরা বাংলা শাসন করেছেন ১০৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। পাল শাসক ধর্মপাল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধবিহার, মঠ ও মন্দিরে বুদ্ধ ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল ব্যাপকভাবে। সেসব বুদ্ধ ভাস্কর্যের বিপুল সংগ্রহ রয়েছে আমাদের দেশের ছোট-বড় সব জাদুঘরে। পালদের সময়কার দুটি বিখ্যাত স্থাপনা পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ও কুমিল্লার ময়নামতি বিহার। এ দুটি স্থাপনা থেকে প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলো বরেন্দ্র জাদুঘর ও ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দেখলে বোঝা যায় যে, সেগুলো নিছক ধর্মীয় আবেগে ও পূজার প্রয়োজনে নির্মিত। সে সময়কার একটি মূল্যবান ভাস্কর্য হলো মঞ্জুশ্রী ভাস্কর্য। এই মূর্তিতে দেখা যায়, দেবী তার ডান হাতে ভক্তদের আশীর্বাদ দিচ্ছেন আর বাম হাত দিয়ে বরাভয় প্রদান করছেন।
পালদের পর সেন রাজারা বাংলার শাসন ক্ষমতায় আসেন এবং ১২০৪ পর্যন্ত বাংলার পশ্চিমাংশ এবং ১২৩০ পর্যন্ত পূর্ববাংলা (বর্তমান ঢাকা অঞ্চলসহ) শাসন করেন। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, যারা হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। সেন শাসকরা তাদের মন্দিরে ও গৃহে বিষ্ণু, শিব, সূর্য, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী, মনষা, গঙ্গা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করান। সেন যুগের সেসব ভাস্কর্যও বাংলাদেশের জাদুঘরগুলোতে আছে। কোনো না কোনো মন্দির থেকে সেগুলো সংগৃহীত।
সেনদের পর বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুসলিম শাসকরা। মুসলিম শাসনামলে এসে ভাস্কর্য শিল্পের ধারায় পরিবর্তন আসে। দেব-দেবীর মূর্তির পরিবর্তে বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে ফুল, লতা-পাতা, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি অঙ্কিত হতে থাকে। কেননা, মুসলিম সংস্কৃতিতে প্রাণীর মূর্তি গড়ার ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। মুসলিম শাসকরা এটি অনুসরণ করেই শিল্পস্থাপনা নির্মাণ করে গেছেন। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের নানা স্থানে মুসলিম শাসনকে আজও অম্লান করে রেখেছে মুসলিম স্থাপত্যকর্ম। অনেক বিখ্যাত শহর গড়ে তুলেছেন তারা কিন্তু কোনো স্থাপত্যেই প্রাণীর কোনো মূর্তি তারা নির্মাণ করেননি। ভারতের দিল্লি, আগ্রা, বিজাপুর, গুজরাটসহ পুরো ভারতবর্ষজুড়ে অসংখ্য শহর, নগর, মসজিদ, খানকাহ্, দরগাহ্, মিনার, স্মৃতিসৌধ মুসলিম শাসকরা নির্মাণ করেছেন; কিন্তু কোথাও প্রাণীর কোনো প্রতিকৃতি চোখে পড়ে না। ভাস্কর্য ছাড়াই মধ্যযুগের স্থাপনা বিখ্যাত হয়ে আছে।
বাংলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্যগুলো আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অতীত ঐতিহ্যকে স্পষ্টভাবে আজও তুলে ধরছে। পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ কমপ্লেক্স, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং তত্সংলগ্ন মাজার, খানকাহ্ ও অন্যান্য স্থাপত্য কমপ্লেক্স, নওগাঁর বিখ্যাত মাহিসন্তোষ মসজিদ, গৌড়ের বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র দরসবাড়ি মাদরাসা কমপ্লেক্স মুসলিম স্থাপত্য নকশার জন্য বিখ্যাত। এগুলোর কোথাও প্রাণিমূর্তি নেই। রাজধানী শহর গৌড়-লক্ষেষ্টৗ, ফিরোজাবাদ (পাণ্ডুয়া), সোনারগাঁয়ের পানাম নগরী কিংবা মোগল আমলে নির্মিত লালবাগের কেল্লা, নবাবদের স্থাপনা আহসান মঞ্জিলসহ কোনো স্থাপত্যের সঙ্গে কিংবা রাস্তাঘাটে প্রাণীর চিত্র সংবলিত কোনো শিল্পকর্ম নির্মিত হয়নি। যদিও স্থাপত্যশিল্পীরা অন্য যে কোনো আমলের চেয়ে মুসলিম আমলে বেশি কর্মব্যস্ত ও সৃষ্টিশীল ছিলেন। পাথরে খোদাই করার কাজে নিয়োজিত শিল্পীদের আলাদা পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল সে সময়। কিন্তু তারা মূর্তি-ভাস্কর্য নির্মাণ করেননি। মুসলিম স্থাপত্য সব যুগেই প্রাণিচিত্র বিবর্জিত। ইংরেজ আমলেও বাংলার প্রকাশ্য কোনো স্থানে মূর্তির ভাস্কর্য নির্মিত হয়নি। তবে আধুনিক যুগে এসে অনেক সৌখিন জমিদার নিজ উদ্যোগে প্রাসাদে-বাগানে নিজেদের আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা ছিল সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তবে তারা ছিলেন আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
সুতরাং প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়কালের ভাস্কর্য শিল্পের পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো যুগেই প্রাণিমূর্তি পূজা-অর্চণা ব্যতীত নির্মিত হয়নি। দেবতা কিংবা দেবীরা যেহেতু কেউই সব সময় সর্বজনীন-সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন না, সেজন্য বোধ হয় জনসম্মুখে পূজনীয়দের কেউ আনতে চাননি। নিজ গৃহে-মন্দিরে নিভৃতে তাদের গড়েছেন।
স্বাধীনতার পর সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাই মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিয়ে গান বাঁধা, নাটক নির্মাণ, গল্প-কবিতা রচনা করা হয়ে ওঠে খুবই সৃষ্টিশীল ও আনন্দদায়ক বিষয় হিসেবে। এদেশের ভাস্কর্যশিল্পীরাও শিল্পকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে থাকেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এভাবে প্রকাশ্য জনসম্মুখে প্রাণীর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। বিষয়টি মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসীদের কাছে আপত্তিকর হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হওয়ার কারণে সম্ভবত এদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামারা তীব্র আপত্তি তোলেননি। যারা আপত্তি তুলেছেন, তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবে এমনভাবে মিডিয়ায় চিহ্নিত করা হয়েছে যে— ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একের পর এক মূল্যবান ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়, যেগুলোতে মোটিফ হিসেবে মনুষ্যমূর্তিকে তুলে ধরা হয়। তবে আলেম-ওলামারা মৃদু আপত্তি তোলা ছাড়া বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেননি। কেননা, ভাস্কর্যের সমর্থকরা বিষয়টিকে এমনভাবে প্রচার করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতারই নামান্তর।
সুতরাং বড় বড় শহরের দর্শনীয় স্থানে ভাস্কর্যের নামে প্রাণিমূর্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে বিষয়টির ঐতিহাসিকতা বিবেচনা করা উচিত। এ দেশের সংস্কৃতির ইতিহাস বলে যে, প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ ও তার প্রদর্শন বিশেষ কোনো ধর্মের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সব ধর্মের জন্য এটি গ্রহণযোগ্য হবে—এমন নয়। তাই ভাস্কর্যের নির্মাণে 'মূর্তি'কে বর্জন করলেই কিন্তু বিষয়টির সুরাহা হয়। কয়েক বছর আগে ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে লালনের মূর্তি স্থাপন করার পর এটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতিবাদের পর সেখানে বিমূর্ত ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। খেয়াল রাখা উচিত, সৌন্দর্য বা সংস্কৃতির নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া কখনই ইতিবাচক হতে পারে না। হেফাজতে ইসলামের দাবিটিকে তাই 'মধ্যযুগীয়' বলে আখ্যায়িত করার সুযোগ নেই, দাবিটির যৌক্তিকতা রয়েছে।
লেখক : গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী
harunsarkar2005@yahoo.com
__._,_.___