এদের আর সুযোগ দেয়া যায় না! -৩ (শেষাংশ)
সুমি খান
(শেষাংশ)
আল্লামা শফী বলেছেন, নবীজী দোজখে বেশিরভাগ নারী দেখেছেন। কী করে? শরিয়া মতে, বেহেশত-দোজখে তো আমরা যাব কেয়ামতের পরে-হাশরের বিচারের পরে। ওই মেয়েগুলো দোজখে চলে গেল তার মানে কেয়ামত হয়ে গেছে? কবে হলো? হয়ে গেছে রোজ হাশরের বিচার? কবে হলো? বলুন, মিষ্টার শফী?
কিছু ব্যতিক্রম সব সমাজেই আছে, আপনাদের অনেক মাদ্রাসাতেও আছে কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের নারীরা অত্যন্ত মেধাবী, সক্ষম, দক্ষ ও শালীন। অর্থনীতিসহ দেশের সর্বক্ষেত্রে তারা অসামান্য অবদান রাখছেন, তারা আপনাদের মতো যাকাতের টাকায় চলেন না বরং তাদের উপার্জনের ট্যাক্স ও যাকাত দিয়ে আপনাদের চলতে হয়। তারা আপনার চেয়ে কম মুসলমান নন। আল্লাহ ও তাদের মধ্যে কোন দালালের দরকারও নেই, ইসলামে সে সুযোগও নেই। আপনি তাদের যথেষ্ট অপমান করেছেন; আপনি অপমান করেছেন পুরুষদেরও। আপনি সব পুরুষকে কামুক জন্তু বানিয়ে ছেড়েছেন। এত সাহস, এত স্পর্ধা আপনার কি করে হলো? আপনার ইসলাম আপনাকে এই শিখিয়েছে? আপনি দুনিয়া দেখেননি, আপনি কিছুই জানেন না। আমরা নারী-পুরুষ একসাথে পড়াশোনা করেছি, একসাথে চাকরি করছি -আপনার মাথায় সব সময় যে নোংরা পোকাগুলো নড়াচড়া করে সেগুলো আমাদের মাথায় নেই। আমাদের কাছে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের দেয়া কোরান-হাদীসের নারীবান্ধব ব্যাখ্যা ও হাদিস আছে।
শ্রদ্ধেয় শরিয়া গবেষক হাসান মাহমুদ বিদগ্ধ জন। শফীকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, ইসলামের যে ব্যাখ্যা শফী এবং তার অনুসারীরা বয়ে বেড়ান সেটা যে কত নোংরা ও নিষ্ঠুর তা দলিল ধরে ধরে দশ-পনেরো বছর ধরে জাতিকে জানাতে চেষ্টা করছি। কাজটা কঠিন, সাফল্য বেশি নয় কিন্তু কাজ এগোচ্ছে। শফী এক লহমায় সেই সাফল্য এনে দিলেন। ইসলামের নামে শফী গংয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখা রাক্ষসের চেহারাটা দেখে আঁৎকে উঠছে জাতি। সমাজের এই রাক্ষসদের মুখোশ খুলে গেল। মানুষকে সচেতন করার কাজ সহজ হয়ে গেল কিছুটা হলেও।
হেফাজতের এই ধর্মান্ধ নেতা বলেন, 'বাড়ির বাইরে যেয়ো না। রাস্তায়, স্টেশনে, বাজারে, মাঠে নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করো না। সাবধান! কেনাকাটা করতে যাবে না। তোমার স্বামী বা ছেলেকে বলো বাজার করার জন্য। তোমাকে কেন যেতে হবে? তুমি শুধু বসে থাকো এবং ছেলেকে হুকুম করো। তোমাকে কেন এই ঝামেলা পোহাতে হবে?'
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের হিসাব মতে, দেশের চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ২০০২-০৩ সালে এটা ছিল এক কোটি। তবু পুরুষের তুলনায় তা অর্ধেক।
ওয়াজে নারীদের তিনি তুলনা করেছেন তেঁতুলের সঙ্গে। তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলে 'দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়' বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। আল্লামা শফির ওই বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকসহ নানান ব্লগে এখন সমালোচনার ঝড় বইছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ওই বক্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছেন। এ বিষয়ে এরই মধ্যে নারী নেত্রীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
শফীর মতে, নারীদের কাজ হলো আসবাবপত্রের যতœ নেয়া, সন্তান লালন-পালন করা, ঘরের মধ্যে থাকা।
চট্টগ্রামভিত্তিক হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ৯৩ বছর বয়সী শফী বলেন, 'শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে। স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যতœ করবা। এই হলো তোমাদের কাজ। তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?'
সম্প্রতি শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করেই উগ্রপন্থী ইসলামিক গোষ্ঠী হেফাজত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সংগঠনটির ১৩ দফা দাবি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এসব দাবির মধ্যে ছিল নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করা, বিদেশী সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করা, মোমবাতি প্রজ্বলন নিষিদ্ধ করা। ঢাকায় গত ৬ এপ্রিলের সমাবেশে এই দাবিগুলো পেশ করে হেফাজত। সমাবেশের দিন নারী সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় হেফাজতের লোকজন। হেফাজতের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন, মাথায় কাপড় নেই কেন- এ ধরনের অজুহাত তুলে তাদের হেনস্থা করা হয়। একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক নাদিয়া শারমিনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। নাদিয়া হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের খবর সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় সমাবেশ থেকে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, 'পুরুষের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন?' এক পর্যায়ে নাদিয়াকে মারতে মারতে সমাবেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। বাংলানিউজের জাকিয়াসহ প্রতিটি নারী সাংবাদিককেই হেনস্থা করেছে হেফাজতিরা। আমাকে মারবার জন্য তেড়ে এসেছিল যারা তাদের ছবি তুলে রেখেছি আমি। আমার ক্যামেরা ও মোবাইল কেড়ে রাখতে চেয়েছিল, পারেনি। আমি দৌড়েও আসিনি পালাইওনি। তাকিয়েছিলাম কী করে তারা। আমার দিকে আঘাত করতে আসে। এ সময় বাহ্যিক পোশাকে আধুনিক বাচনে আধুনিক সুস্পষ্ট বাংলা এবং ইংরেজী উচ্চারণে উচ্চশিক্ষিত তরুণের একটি দল আমাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে । বিনয়ের সাথে আমাকে বেরিয়ে আসতে বলে সমাবেশ থেকে। বলে, "এরা খুব খারাপ, আপনি প্লিজ চলে যান!" আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, "খারাপই যদি বুঝেন আপনাদের মতো উদ্যমী তরুণরা কেন এদের সমাবেশে এসে এদের মিথ্যাচার আর উগ্র ধর্র্মান্ধতার আফিমে নিজেদের আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিচ্ছেন?" না , এই পথভ্রষ্ট তরুণরা আমার কথা শুনবার মতো মানসিকতায় ছিলেন না।
আল জাজিরার প্রতি ভালবাসা থেকে তাদের সংবাদকর্মী হিসেবে আমাকে নিরাপদে সমাবেশের সীমানার বাইরে মূল সড়কে এনে দিল যারা- অসহায় করুণভাবে তাকিয়ে দেখলাম সেই নিরীহ সুন্দর মুখগুলোর দিকে, যারা যে কোনদিন অবলীলায় চাপাতি হাতে আমাকে কুপিয়ে যাবে। এদের সুপথে ফিরিয়ে আনবার জন্য সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত এবং সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরী।
নারীর প্রতি এত ঘৃণা আর অশ্রদ্ধা দিয়ে সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তুলে কোন্ সমাজ প্রতিষ্ঠা করবেন শফী এবং তার অনুসারীরা?
এর পরও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় দেশের সাম্প্রতিক ৫টি নির্বাচনে অবৈধ অর্থ বিলি এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জয়ী হয়েছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, 'এই বিংশ শতাব্দীকালে যৎকালে অন্যান্য জাতি নিজেদের প্রাচীন প্রথাকে নানা রকমে সংস্কৃত, সংশোধিত ও সুমার্জিত করে আঁকড়ে ধরে আছেন, ... ... ... ... তৎকালে আমরা নিজেদের অতিসুন্দর ধর্ম, অতিসুন্দর সামাজিক আচার-প্রথা বিসর্জন দিয়ে এক অদ্ভুত জানোয়ার সাজতে বসেছি।'
নারীরা পৈত্রিক সম্পত্তিতে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকেও ছিল বঞ্চিত। এর প্রতিবাদে বেগম রোকেয়া বলেন, 'হায় পিতা মোহাম্মদ (দ.)! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃসম্পত্তির অধিকারিনী করিয়াছ, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্বনাশ করিতেছে। আহা! মহম্মদীয় আইন পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাহারই। আইন আমাদের ন্যায় নীরব অবলাদের নহে।' [গৃহ, রোকেয়া রচনাবলী, পৃ:৭২]
বেগম রোকেয়া দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, 'এখন আমাদের আর ধর্র্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে। যেখানে ধর্র্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ-সতীদাহ। যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এস্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।'এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, 'কেহ বলিতে পারেন যে, 'তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?' তদুত্তরে বলিতে হইবে, 'ধর্ম' শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই 'ধর্ম' লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম। এ জন্য ধার্মিকগণ আমায় ক্ষমা করিতে পারেন।' [নবনূর, ২য় বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, পৃঃ ২১৮]। 'পর্দার দোহাই দিয়ে, অনেক ভাল জিনিসে আমাদের বঞ্চিত করে রেখেছে, আর তা আমরা থাকব না ... ... আমরা চাই আমাদের ইসলাম-দত্ত স্বাধীনতা, চাই ইসলাম-দত্ত অধিকার ... ... কে আমাদের পথ রোধ করবে? সমাজরূপী শয়তান? কখনই পারবে না।' [পর্দা বনাম প্রবঞ্চনা, সওগাত, ভাদ্র ১৩১৬, পৃ. ৬৯-৭১]
'প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি, সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে জানি: ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য 'কতল' [অর্থাৎ প্রাণদ-ের] বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি। [এবং ভাগ্নীদিগের ও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি।] কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি তো, কোন ভাল কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারা মুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হোক পৃথিবী ঘুরিতেছে । আমাদিগকেও এইরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে।''
তিনি পুরুষদের সাথে নিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্য নারী স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন! তিনি লিখেছেন, 'পরস্পরে একতা থাকাও একান্ত আবশ্যক। কিন্তু এই ঐক্য যেন সত্যের ওপর স্থাপিত হয়। একতার মূলে একটা মহৎ গুণ থাকা আবশ্যক' [সৌরজগৎ, রোকেয়া রচনাবলী, পৃ:১৩১-১৩২]
আমি একজন অতি ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী। আমি আহ্বান জানাই এসো বোন, এসো ভাই, আমাদের এ দেশ এবং সমাজকে রক্ষায় মিলিত হাতে প্রতিরোধ করি এই অন্ধকারের শক্তি- এখনি রুখে দাঁড়াতে হবে এই অপশক্তিদের।
sumikhan29bdj@gmail.com
আল্লামা শফী বলেছেন, নবীজী দোজখে বেশিরভাগ নারী দেখেছেন। কী করে? শরিয়া মতে, বেহেশত-দোজখে তো আমরা যাব কেয়ামতের পরে-হাশরের বিচারের পরে। ওই মেয়েগুলো দোজখে চলে গেল তার মানে কেয়ামত হয়ে গেছে? কবে হলো? হয়ে গেছে রোজ হাশরের বিচার? কবে হলো? বলুন, মিষ্টার শফী?
কিছু ব্যতিক্রম সব সমাজেই আছে, আপনাদের অনেক মাদ্রাসাতেও আছে কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের নারীরা অত্যন্ত মেধাবী, সক্ষম, দক্ষ ও শালীন। অর্থনীতিসহ দেশের সর্বক্ষেত্রে তারা অসামান্য অবদান রাখছেন, তারা আপনাদের মতো যাকাতের টাকায় চলেন না বরং তাদের উপার্জনের ট্যাক্স ও যাকাত দিয়ে আপনাদের চলতে হয়। তারা আপনার চেয়ে কম মুসলমান নন। আল্লাহ ও তাদের মধ্যে কোন দালালের দরকারও নেই, ইসলামে সে সুযোগও নেই। আপনি তাদের যথেষ্ট অপমান করেছেন; আপনি অপমান করেছেন পুরুষদেরও। আপনি সব পুরুষকে কামুক জন্তু বানিয়ে ছেড়েছেন। এত সাহস, এত স্পর্ধা আপনার কি করে হলো? আপনার ইসলাম আপনাকে এই শিখিয়েছে? আপনি দুনিয়া দেখেননি, আপনি কিছুই জানেন না। আমরা নারী-পুরুষ একসাথে পড়াশোনা করেছি, একসাথে চাকরি করছি -আপনার মাথায় সব সময় যে নোংরা পোকাগুলো নড়াচড়া করে সেগুলো আমাদের মাথায় নেই। আমাদের কাছে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের দেয়া কোরান-হাদীসের নারীবান্ধব ব্যাখ্যা ও হাদিস আছে।
শ্রদ্ধেয় শরিয়া গবেষক হাসান মাহমুদ বিদগ্ধ জন। শফীকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, ইসলামের যে ব্যাখ্যা শফী এবং তার অনুসারীরা বয়ে বেড়ান সেটা যে কত নোংরা ও নিষ্ঠুর তা দলিল ধরে ধরে দশ-পনেরো বছর ধরে জাতিকে জানাতে চেষ্টা করছি। কাজটা কঠিন, সাফল্য বেশি নয় কিন্তু কাজ এগোচ্ছে। শফী এক লহমায় সেই সাফল্য এনে দিলেন। ইসলামের নামে শফী গংয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখা রাক্ষসের চেহারাটা দেখে আঁৎকে উঠছে জাতি। সমাজের এই রাক্ষসদের মুখোশ খুলে গেল। মানুষকে সচেতন করার কাজ সহজ হয়ে গেল কিছুটা হলেও।
হেফাজতের এই ধর্মান্ধ নেতা বলেন, 'বাড়ির বাইরে যেয়ো না। রাস্তায়, স্টেশনে, বাজারে, মাঠে নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করো না। সাবধান! কেনাকাটা করতে যাবে না। তোমার স্বামী বা ছেলেকে বলো বাজার করার জন্য। তোমাকে কেন যেতে হবে? তুমি শুধু বসে থাকো এবং ছেলেকে হুকুম করো। তোমাকে কেন এই ঝামেলা পোহাতে হবে?'
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের হিসাব মতে, দেশের চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ২০০২-০৩ সালে এটা ছিল এক কোটি। তবু পুরুষের তুলনায় তা অর্ধেক।
ওয়াজে নারীদের তিনি তুলনা করেছেন তেঁতুলের সঙ্গে। তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলে 'দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়' বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। আল্লামা শফির ওই বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকসহ নানান ব্লগে এখন সমালোচনার ঝড় বইছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ওই বক্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছেন। এ বিষয়ে এরই মধ্যে নারী নেত্রীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
শফীর মতে, নারীদের কাজ হলো আসবাবপত্রের যতœ নেয়া, সন্তান লালন-পালন করা, ঘরের মধ্যে থাকা।
চট্টগ্রামভিত্তিক হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ৯৩ বছর বয়সী শফী বলেন, 'শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে। স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যতœ করবা। এই হলো তোমাদের কাজ। তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?'
সম্প্রতি শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করেই উগ্রপন্থী ইসলামিক গোষ্ঠী হেফাজত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সংগঠনটির ১৩ দফা দাবি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এসব দাবির মধ্যে ছিল নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করা, বিদেশী সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করা, মোমবাতি প্রজ্বলন নিষিদ্ধ করা। ঢাকায় গত ৬ এপ্রিলের সমাবেশে এই দাবিগুলো পেশ করে হেফাজত। সমাবেশের দিন নারী সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় হেফাজতের লোকজন। হেফাজতের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন, মাথায় কাপড় নেই কেন- এ ধরনের অজুহাত তুলে তাদের হেনস্থা করা হয়। একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক নাদিয়া শারমিনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। নাদিয়া হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের খবর সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় সমাবেশ থেকে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, 'পুরুষের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন?' এক পর্যায়ে নাদিয়াকে মারতে মারতে সমাবেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। বাংলানিউজের জাকিয়াসহ প্রতিটি নারী সাংবাদিককেই হেনস্থা করেছে হেফাজতিরা। আমাকে মারবার জন্য তেড়ে এসেছিল যারা তাদের ছবি তুলে রেখেছি আমি। আমার ক্যামেরা ও মোবাইল কেড়ে রাখতে চেয়েছিল, পারেনি। আমি দৌড়েও আসিনি পালাইওনি। তাকিয়েছিলাম কী করে তারা। আমার দিকে আঘাত করতে আসে। এ সময় বাহ্যিক পোশাকে আধুনিক বাচনে আধুনিক সুস্পষ্ট বাংলা এবং ইংরেজী উচ্চারণে উচ্চশিক্ষিত তরুণের একটি দল আমাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে । বিনয়ের সাথে আমাকে বেরিয়ে আসতে বলে সমাবেশ থেকে। বলে, "এরা খুব খারাপ, আপনি প্লিজ চলে যান!" আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, "খারাপই যদি বুঝেন আপনাদের মতো উদ্যমী তরুণরা কেন এদের সমাবেশে এসে এদের মিথ্যাচার আর উগ্র ধর্র্মান্ধতার আফিমে নিজেদের আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিচ্ছেন?" না , এই পথভ্রষ্ট তরুণরা আমার কথা শুনবার মতো মানসিকতায় ছিলেন না।
আল জাজিরার প্রতি ভালবাসা থেকে তাদের সংবাদকর্মী হিসেবে আমাকে নিরাপদে সমাবেশের সীমানার বাইরে মূল সড়কে এনে দিল যারা- অসহায় করুণভাবে তাকিয়ে দেখলাম সেই নিরীহ সুন্দর মুখগুলোর দিকে, যারা যে কোনদিন অবলীলায় চাপাতি হাতে আমাকে কুপিয়ে যাবে। এদের সুপথে ফিরিয়ে আনবার জন্য সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত এবং সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরী।
নারীর প্রতি এত ঘৃণা আর অশ্রদ্ধা দিয়ে সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তুলে কোন্ সমাজ প্রতিষ্ঠা করবেন শফী এবং তার অনুসারীরা?
এর পরও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় দেশের সাম্প্রতিক ৫টি নির্বাচনে অবৈধ অর্থ বিলি এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জয়ী হয়েছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, 'এই বিংশ শতাব্দীকালে যৎকালে অন্যান্য জাতি নিজেদের প্রাচীন প্রথাকে নানা রকমে সংস্কৃত, সংশোধিত ও সুমার্জিত করে আঁকড়ে ধরে আছেন, ... ... ... ... তৎকালে আমরা নিজেদের অতিসুন্দর ধর্ম, অতিসুন্দর সামাজিক আচার-প্রথা বিসর্জন দিয়ে এক অদ্ভুত জানোয়ার সাজতে বসেছি।'
নারীরা পৈত্রিক সম্পত্তিতে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকেও ছিল বঞ্চিত। এর প্রতিবাদে বেগম রোকেয়া বলেন, 'হায় পিতা মোহাম্মদ (দ.)! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃসম্পত্তির অধিকারিনী করিয়াছ, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্বনাশ করিতেছে। আহা! মহম্মদীয় আইন পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাহারই। আইন আমাদের ন্যায় নীরব অবলাদের নহে।' [গৃহ, রোকেয়া রচনাবলী, পৃ:৭২]
বেগম রোকেয়া দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, 'এখন আমাদের আর ধর্র্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে। যেখানে ধর্র্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ-সতীদাহ। যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এস্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।'এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, 'কেহ বলিতে পারেন যে, 'তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?' তদুত্তরে বলিতে হইবে, 'ধর্ম' শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই 'ধর্ম' লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম। এ জন্য ধার্মিকগণ আমায় ক্ষমা করিতে পারেন।' [নবনূর, ২য় বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, পৃঃ ২১৮]। 'পর্দার দোহাই দিয়ে, অনেক ভাল জিনিসে আমাদের বঞ্চিত করে রেখেছে, আর তা আমরা থাকব না ... ... আমরা চাই আমাদের ইসলাম-দত্ত স্বাধীনতা, চাই ইসলাম-দত্ত অধিকার ... ... কে আমাদের পথ রোধ করবে? সমাজরূপী শয়তান? কখনই পারবে না।' [পর্দা বনাম প্রবঞ্চনা, সওগাত, ভাদ্র ১৩১৬, পৃ. ৬৯-৭১]
'প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি, সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে জানি: ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য 'কতল' [অর্থাৎ প্রাণদ-ের] বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি। [এবং ভাগ্নীদিগের ও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি।] কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি তো, কোন ভাল কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারা মুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হোক পৃথিবী ঘুরিতেছে । আমাদিগকেও এইরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে।''
তিনি পুরুষদের সাথে নিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্য নারী স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন! তিনি লিখেছেন, 'পরস্পরে একতা থাকাও একান্ত আবশ্যক। কিন্তু এই ঐক্য যেন সত্যের ওপর স্থাপিত হয়। একতার মূলে একটা মহৎ গুণ থাকা আবশ্যক' [সৌরজগৎ, রোকেয়া রচনাবলী, পৃ:১৩১-১৩২]
আমি একজন অতি ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী। আমি আহ্বান জানাই এসো বোন, এসো ভাই, আমাদের এ দেশ এবং সমাজকে রক্ষায় মিলিত হাতে প্রতিরোধ করি এই অন্ধকারের শক্তি- এখনি রুখে দাঁড়াতে হবে এই অপশক্তিদের।
sumikhan29bdj@gmail.com
এদের আর সুযোগ দেয়া যায় না! - ২
সুমি খান
__._,_.___