ভারতের রাজনীতি
নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই
কুলদীপ নায়ার | আপডেট: ০২:১৩, আগস্ট ১৩, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির পর ৬৬ বছর পূর্ণ হতে চলল। বিভক্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে তারা আজও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থিতু হতে পারেনি, বন্ধু হিসেবে তো নয়ই। দুই দেশে সীমান্তে গিজগিজ করছে সেনা, অনিবার্যভাবে ঘটছে সংঘর্ষ। এই তো কদিন আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যকে হত্যা করা হলো। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হয়তো সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু এভাবে জিহাদি গ্রুপগুলো, এমনকি তালেবানও ভারতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে আপস-সমঝোতার ব্যাপারে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আগ্রহী নয়। যখনই দুই দেশের মধ্যে সংলাপ শুরু হতে যায়, তখনই একটা না একটা ঘটনা ঘটানো হয়।
হিন্দু ও মুসলমান এই দুটি সম্প্রদায়ের মানুষ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একত্রে বসবাস করার পর কেন বিভক্ত হয়ে গেল—এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা আমি কারোর কাছেই পাইনি; না কোনো সামনের সারির রাজনীতিবিদ, না কোনো ইতিহাসবিদ, না অন্য কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভক্তির কারণটা ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন।
কট্টরপন্থীরা দাবি করতে পারেন যে তাঁরা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন, কারণ তাঁরাই ছিলেন শাসক। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এই যে হিন্দু ও মুসলমানেরা মিলিতভাবে এমন এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, যেখানে দুই সভ্যতার সম্মিলনের প্রতি স্বীকৃতি ছিল, যেখানে বিভক্তির মেরুকরণের ঝোঁক পরাস্ত হয়েছিল। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ছিল নিয়মিত ব্যাপার, উভয় সম্প্রদায়ের উৎসবগুলো উদ্যাপন করা হতো যৌথভাবে। কিন্তু গত শতকের তিরিশের দশকে সেই বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে দিতে ধর্মীয় পরিচয়ের প্রবক্তাদের বেগ পেতে হয়নি। ভারতবর্ষীয় সমাজের বহুবৈচিত্র্যময়তা কি তাহলে ছিল বিভেদ-পার্থক্য ঢেকে রাখার একটা বাতাবরণ মাত্র? বাস্তবে কি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কখনোই এক আঙিনায় বাস করেনি, পরস্পর থেকে দূরে সরে থেকেছে?
এটাই যদি সত্য হবে, তাহলে যখন দেশভাগের কথা ভাবা হচ্ছিল, তখন কেন সব মুসলমানকে পাকিস্তানে আর সব হিন্দুকে ভারতে পাঠানোর কথা ভাবা হলো না? এমনকি মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তানে যত মুসলমান গেছে, তার চেয়ে বেশি মুসলমান ভারতেই রয়ে গেলেও মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি তোলা হয়নি। হিন্দুরা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে এসেছে, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের কয়েকটি শহরের মুসলমানদের অনেকে পাকিস্তানে চলে গেছে। কিন্তু এগুলো স্বতঃস্ফূর্ত দেশত্যাগ ছিল না, ছিল জবরদস্তিমূলক উচ্ছেদ। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
দেশভাগের দাবি আড়ালে-আবডালে ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু তিরিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্ব উচ্চারিত হওয়ার আগে পর্যন্ত সেই দাবির প্রতি মুসলমানেরা তেমন কর্ণপাত করেনি। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে মুসলিম লীগের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন, সেই দলটি অনায়াসে বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ১১টি রাজ্যে ৫৭টি মুসলমান আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ জয়ী হয় ৪৮টিতে। এক দশক পর ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিজয় ঘটে ভারতজুড়ে। বাংলায় ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৬টি, বিহারে ৫০টির মধ্যে ৪৩টি, উত্তর প্রদেশে ৬১টি আসনের মধ্যে ৫৪টি, সিন্ধু প্রদেশে ৩৪টি আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় দলটি। মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল শুধু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে, যেখানে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস দল (লাল কুর্তা পার্টি)।
পাকিস্তানের জন্ম নিয়ে বিতর্ক করে কোনো লাভ হবে না। দেশটি এখন ক্রমেই আরও উগ্রপন্থার দিকে চলে যাচ্ছে, আরও বেশি তালেবানীকরণ ঘটছে সেখানে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক উদারপন্থী নেতা আছেন। পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও উদারপন্থী মানুষ আছেন, যাঁদের প্রশ্ন এই দুটি সম্প্রদায়ের মানুষ শত শত বছর ধরে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার পরও কেন আলাদা হয়ে গেল, বিভক্ত হয়ে গেল।
কংগ্রেস দলের অন্যতম শীর্ষনেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও মাদ্রাজের মুসলমানেরা এক সকালে উঠে আবিষ্কার করবে যে নিজ নিজ জন্মভূমিতেই তারা রাতারাতি বিদেশি আগন্তুকে পরিণত হয়েছে। শিল্প, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠীগুলো বিশুদ্ধ হিন্দু রাজের কৃপার পাত্রে পরিণত হবে।
জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ভারত ভাঙলে 'দুই জাতি'র সমস্যার সমাধান হবে না; কারণ হিন্দু ও মুসলমানেরা ছড়িয়ে আছে ভারতের সর্বত্র। মাওলানা আজাদের ব্যক্তিগত সচিব হুমায়ুন কবির আমাকে বলেছিলেন, মাওলানা মনে করতেন কংগ্রেসের নেতারা (নেহরুর বয়স তখন ৫৮ বছর, আর সরদার প্যাটেলের ৭২) দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন এ জন্য যে তাঁরা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য আর তাঁদের ছিল না এবং তাঁরা বাকি জীবনটা ব্যয় করতে চেয়েছিলেন স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার কাজে। মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা মাওলানা আজাদের নাম দিয়েছিলেন 'হিন্দুদের পুতুল'।
দেশত্যাগের ঢল নেমেছিল। দুই দিক থেকেই। কেউ ভাবতেও পারেনি, কেউ চায়নি, কিন্তু আর কিছু করার ছিল না। দেশ বিভাগের পরপর বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগের ফলে উদ্ভূত সমস্যাসহ অন্য অনেক বিশৃঙ্খলাময় সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করতে গিয়ে দুই দেশ পরস্পরকে দোষারোপ করেছে। জন্মভূমি ছেড়ে যাঁরা অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা শুধু মনভর্তি তিক্ততা আর প্রতিহিংসা নিয়েই নতুন দেশটিতে যাননি, সঙ্গে আরও নিয়ে গেছেন তাঁদের পরিত্যক্ত গ্রামগুলোতে নৃশংস হামলার অজস্র কাহিনিও, যেসব গ্রামে তাঁরা অন্য সম্প্রদায়গুলোর মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করেছেন শত শত বছর ধরে। দেশভাগ যদি হয়ে থাকে ধর্মের ভিত্তিতে, এই ঘটনাগুলোর কারণে সেই ধর্মীয় বিষয়গুলো ঢুকে গেছে আরও গভীরে।
দেশভাগের ফলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কী ক্ষতির শিকার হয়েছি, তা অনুভব করি যখন আমাকে সীমান্ত পাড়ি দিতে হয় কপর্দকশূন্য অবস্থায়। আমি একা ছিলাম না। অধিকাংশ হিন্দু ও মুসলমানের মনেই নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে গোলমাল থেমে গেলে সবাই নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাব। কিন্তু তা আর কখনো ঘটেনি। আমাদের আর নিজ গৃহে ফিরে যাওয়া হয়নি।
মুসলিম লীগের ঘাঁটি ছিল উত্তর প্রদেশ আর বিহার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ওই দুটি রাজ্যের মুসলমানেরা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ঘৃণার চোখে দেখত। আজ তারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে কসম খায়। সন্তানসন্ততিদের কাছে তারা তাদের এই দুই বিপরীত অবস্থানের কী ব্যাখ্যা দেয়? কীভাবে এটাকে জায়েজ করে?
দেশভাগের পাল্টা জবাব হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এটা যদি মানুষের বিশ্বাস না হয়ে থাকে, তবে তারা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পারে। আজকে অনেক হিন্দুও একই ধরনের জাতীয়তাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হচ্ছে।
আমি ভেবেছিলাম, ব্রিটিশরা চলে গেলে এবং পাকিস্তান গঠন করা হলে ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা থেমে যাবে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরেও যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সক্রিয় ছিল, তাদেরকে হিসাবে নেওয়া হয়নি আমার। আজকের বিজেপি হচ্ছে বিভাগপূর্ব মুসলিম লীগের মতো। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হয়ে উঠেছেন হিন্দুত্বের সবচেয়ে বড় ধ্বজা!
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে গেছে। আজ সেই একই তত্ত্ব আওড়াচ্ছে বিজেপি, ধ্বংস করে দিচ্ছে জাতীয় ঐক্য। যে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওই রাজ্যের মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন দিয়েছিলেন, একবার কল্পনা করে দেখুন, সেই লোকটি ভারতে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছে। তার মানে, একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ও সমাজ গড়ে তোলার লড়াইটা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠের আগ্রাসী মনোভাব ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হতে পারে। যাঁরা গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদী সমাজের কথা চিন্তা করেন, এই সন্ধিক্ষণে তাঁদের হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
The partition story
August 7, 2013Kuldeep Nayar
http://www.kuldipnayar.com/btl/the_partition_story.html
__._,_.___
****************************************************
Mukto Mona plans for a Grand Darwin Day Celebration:
Call For Articles:
http://mukto-mona.com/wordpress/?p=68
http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=585
****************************************************
VISIT MUKTO-MONA WEB-SITE : http://www.mukto-mona.com/
****************************************************
"I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it".
-Beatrice Hall [pseudonym: S.G. Tallentyre], 190
Change settings via the Web (Yahoo! ID required)
Change settings via email: Switch delivery to Daily Digest | Switch to Fully Featured
Visit Your Group | Yahoo! Groups Terms of Use | Unsubscribe
__,_._,___