শনিবার, ৪ জানুয়ারী ২০১৪, ২১ পৌষ ১৪২০
ম্যাডাম, গণতন্ত্র যাত্রার সঙ্গী কিন্তু 'অন্তর্বর্তী সরকার', 'তত্ত্বাবধায়ক' নয়
মমতাজ লতিফ
বিএনপি নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনে 'গণতন্ত্রের জন্য যাত্রা'র কর্মসূচী ঘোষণায় তিনি আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের বিখ্যাত সংজ্ঞাটিকে সরকারবিরোধী মন্তব্যে রূপান্তরিত করেছেন যেটিকে আসলে দেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে সঠিকভাবে বলা যায়Ñ'দুর্বৃত্তের দ্বারা, দুর্বৃত্তের জন্য, দুর্বত্তের গণতন্ত্র,' যা জেনারেল জিয়া সূচিত পেশী, কালো টাকা ও অস্ত্রনির্ভর 'ডিফিকাল্ট পলিটিক্স', খালেদা-তারেক দ্বারা অনুসৃত ও বাস্তবায়িত অপগণতন্ত্র বা অপ-ক্র্যাসি'র নামান্তর। সরেজমিনে দৃশ্যমান এই অপগণতন্ত্র বিগত দু'বছর যাবত জামায়াত-বিএনপির প্রকৃত আমির খালেদা জিয়ার নির্দেশে আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী এবং হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর, সাধারণ-নিরীহ বাস-সিএনজি যাত্রী, চালকসহ সাধারণ নারী, পুরুষ-শিশুর ওপর একাত্তরে ব্যবহৃত সেই গানপাউডার দিয়ে ট্রাক-বাস প্রাইভেট গাড়ি সিএনজি, রিক্সা, মোটর সাইকেল চালক-যাত্রীদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তার সৃষ্ট নতুন প্রজন্মের আলবদরেরা চাপাতি-কিরিচ দিয়ে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের অনুসারীদের হত্যা করছে এবং আশ্চর্য হলেও সত্য এই আলবদরদের হাতে শাসক দলের নেতা-কর্মীই নিহত হয়েছে শতাধিক এবং এখনও তারাই খুন হচ্ছে যেমন খুন হচ্ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬-এ খালেদা-নিজামী-তারেকের শাসনকালে যখন পরিকল্পিত বোমা গ্রেনেড হামলায় আহসানউল্লাহ্ মাস্টার, শাহ্ এএমএস কিবরিয়া, আইভী রহমানসহ বিশ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন! তখনও বর্বর তা-ব হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিচালিত হয়েছিল! এই বর্বরতা ৭১-এ, ২০০১-এ হয়েছে এবং হচ্ছে ২০১৩ তেও! ফলে ব্যাপকভাবে চলছে হিন্দুর দেশত্যাগ। আমরা চাই, না চাই-এটিই বাস্তবতা। এমনকি, জিয়া কর্তৃক সূচিত মুক্তিযোদ্ধা হত্যার মতো ঘৃণ্য ঘটনাও খালেদা নেতৃত্বাধীন আজকের আলবদরদের হাতে সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সৌভাগ্য, বাঙালীর সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর মতো অতি বড় মাপের দূরদর্শী এক নেতা এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ্য যথার্থ সঙ্গী তাজউদ্দীন, তাঁদের দু'জনের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য নেতা মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, এমএ হান্নান, শামসুল হক, জহুর আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ উল্লা, আরও অনেক নক্ষত্রপ্রতিম অসাধারণ দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ যারা জাতীয় রাজনীতিতে যেমন তেমনি স্ব স্ব জেলার তৃণমূলে জনমানুষকে জাতীয় স্বার্থ ও কর্তব্যকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। '৬৯ থেকে ৭১ মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত দল, মত নির্বিশেষে সব বাঙালীকে এঁরা বজ্রকঠিন ঐক্যে একই লক্ষ্যে পরিচালিত করেছিলেন। এ ঘটনা সারা পৃথিবীতে বিরল।
একই সঙ্গে বলতে হয় বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, বাঙালীর দুর্ভাগ্য যে, '৭১ এ এই বাঙালীর বহু কঠিন ঐক্যে ফাটল ধরানোরও সূচনা ঘটেছিল চট্টগ্রামের বেতারে বঙ্গবন্ধুুু স্বাধীতার ঘোষণার পাঠকারী মেজর জিয়াউর রহমানের উত্থানের মধ্য দিয়ে! আজ মনে হয়, চট্টগ্রামে যুদ্ধরত ইপিআরের মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম কালুরঘাট থেকে বহুদূরে অবস্থান করার ফলে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ তাকে একটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছিল যা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। কেননা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ একজন রাজীতিকেরই তো করার কথা। কোন সেনা সদস্যের করার কথা নয়। সে হিসেবে এমএ হান্নান বা জহুর হোসেন চৌধুরী বা আতাউর রহমান কায়সার উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। যাই হোক, বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনদের সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা থাকার পরও জিয়াকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিয়োগ, 'বীর উত্তম' খেতাব প্রদান, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার পর কর্নেল তাহেরের সেনাবাহিনীর সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাকে আস্থায় গ্রহণ এবং ৭৭ এর ৩ ও ৭ নবেম্বর অসাধারণ রণকৌশলী বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও কর্নেল হায়দার এবং পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের হত্যার মাধ্যমে জিয়া ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। ক্ষমতা সংহত করতে জিয়া আরও প্রায় চার হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যুয়ের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেনাবাহিনীতে মুক্তি যোদ্ধার সংখ্যা হ্রাস করে। অপরিদিকে '৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি, ক্ষমতায় বসানো, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান করে তোলা, সবশেষে জামায়াতের পাকিস্তানী আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আধুনিক চেহারার বিএনপি দল গঠন ও মেধাবী ছাত্রদের অর্থ, অস্ত্র দিয়ে পেশী অস্ত্র অর্থভিত্তিক দুর্বৃত্তের অপরাজনীতি বা অপ-ক্র্যাসির সূচনা করেছিল। বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের হাতেই সৃষ্ট দুর্র্বৃত্তায়িত অপরাজনীতি দিয়ে জিয়াই গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এ সত্যকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এমনই একটি অলিখিত পাকিস্তান নির্দেশিত পথেই যে বাংলাদেশকে চলতে হবে বা পাকিস্তানপন্থী ক্ষমতাবানরা ঐ পথেই চলবে এবং বাংলাদেশকে আলাদা ভৌগোলিক অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মিত্র ভারত বিদ্বেষী ও মনে আদর্শে পাকিস্তানী মৌলবাদের পথেই পরিচালনা করা হবেÑএটিই যে সে সময়ে সিদ্ধান্ত ছিল, তা আজ স্পষ্ট।
জিয়া বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে বন্দী মৌলবাদের দৈত্যকে সেই নিষিদ্ধকরণ বাতিল করে বোতলের ছিপি খুলে দিয়ে মৃতপ্রায় মৌলবাদী জামায়াতকে পুনরুজ্জীবন দান করেছিল। আর জিয়া নিহত হলে পাকিস্তানী রীতিতে তদানীন্তন সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করে, জিয়ার অনুসরণে অন্তত দু'টি কাজ করে (১) 'রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম' সংবিধানে সংযুক্ত করে (২) জিয়া হত্যার পর পরই চট্টগ্রামের জিওসি বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার মনজুরকে হত্যা করে এবং তেরোজন সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদ- দেয়। শোনা গেছে, এদের মধ্যে কেউই প্রত্যক্ষভাবে জিয়া হত্যার জন্য দায়ী ছিল না। তরুণ মেজর ইয়াজদানী তো মাত্র আগের রাতে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে এসেছিল। অথচ জিয়া হত্যার বিচার হলে যে সত্য প্রকাশ পেত সে বিচার এরশাদও করেনি, পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে জিয়াপতœী খালেদা জিয়াও করেনি। জিয়া হত্যার বিচারের অন্তরালে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি 'মিসিং লিংক' রয়ে গেছে বলে ধারণা করা অমূলক হবে না। তবে, আজ পেছন ফিরে তাকালে বোঝা যায় পাকিস্তান বা আইএসআইএর প্রথম পছন্দ জিয়া পরিবার যারা সব সময় পাকিস্তানের ফরমায়েশ মতোই বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরের লক্ষ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র করার সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষপ গ্রহণ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে কোন নেত্রী/নেতা কি যুক্তিহীনভাবে বছরের পর বছর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদ বর্জন করেন? সংসদকে অকার্যকর করার জন্যই নয় কি? গণতন্ত্রের কথা তার মুখেই মানায় যে নেতা/নেত্রী আগুনে পোড়া নিরীহ নারী পুরুষ-শিশুদের দেখতে যেতেন, আর্থিক সহায়তা ও মৌখিক সমবেদনা জানাতেন। তিনি কি কুম্ভিরাশ্রুও বিসর্জন করেছেন?
কেন তিনি আইএসআই বা অন্য জঙ্গী উৎস থেকে অর্থ নিয়ে তা ব্যবহার করে বাস-ট্রাক পোড়ানোর জন্য পুরস্কার, বোমা-ককটেল গানপাউডার ছুঁড়ে মানুষ মারার জন্য আর্থিক পুরস্কার দিয়ে তরুণ প্রজন্মের একটি দলকে নব্য আলবদরে পরিণত করলেন?
তিনি কি বাঙালী তরুণদের উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবী না হয়ে দুর্বৃত্ত, খুনী, মৌলবাদী, জঙ্গী, বোমাবাজ, গ্রেনেডবাজ, বিবেকহীন মানুষ হন্তারকে পরিণত করতে পারলে খুশি হন? আলামত তো প্রমাণ করছে তিনি বাঙালী তরুণদের হন্তারক, দেশ ধ্বংসকারীতে পরিণত করতে যথেচ্ছ অর্থ বিলাচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন।
তিনি কি সত্যিই নির্বাচন চান? তিনি কি শুধুমাত্র ক্ষমতায় যেতেই নির্বাচন চান? তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারকে আজ্ঞাবহ করা সহজ ভেবে সেটি চান নাকি এটি 'আসলে দেশ ধ্বংসের আন্দোলন করার উসিলা মাত্র?
নির্বাচনে জিতে তিনি কি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিতে পারবেন? এটা তো '৭৬ সাল নয়, এটা ২০১৩, এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে কোটি কোটি তরুণ-তরুণী দেশে বিদেশে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে রাজপথে নেমেছে। তাই তিনি নির্বাচনে জিততেও চান না। প্রকৃত পক্ষে নির্বাচনই চান না, তাই কি জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়নি? তিনি তত্ত্ব¡াবধায়কের নামে আসলে দেশের উন্নতির পথে অগ্রসররত সব ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দিয়ে বড় কোন নাশকতার দ্বারা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে আইএসআই প্রদত্ত 'কর্তব্যকাজ' সম্পন্ন করতেই আগ্রহী নন কি?
তিনি ২০০৬-এ কথিত ২৫০টি ডলার পূর্ণ স্যুটকেস বিদেশের কোন নিরাপদ স্থানে রেখে এসেছিলেন কেন? এ রকম দিন আসতে পারে ভেবে কি? ডেইলি স্টার কি জনগণকে জানাবেন সত্যি কি ঘটেছিল? তাদের সব মন্তব্য প্রতিবেদন এক নেত্রীর বিরুদ্ধে কেন? তিনি ধর্মের নামে রাজনীতি করা জামায়াত-হেফাজতের নেত্রী, তাহলে নারী গোয়েবলসের মতো এত মিথ্যা তিনি বলেন কেন? ২০০৪-এর আগস্টে গ্রেনেড হামলাকে তিনি অস্বাভাবিক জেনে বুঝেও এখনও বলেনÑওটি আওয়ামী লীগই করেছে কেন? সংবাদ সম্মেলনেও বললেন জ্বলন্ত মিথ্যা-'আওয়মী লীগ সরকার গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করছে' কেন এই অসত্য বক্তব্য? এই মানুষবিরোধী, বৃক্ষ, রাস্তা-ব্রিজ, খাদ্যপণ্য, কৃষি-শিল্প বিরোধী খুনী-দুর্বৃত্তদের জননী কি গণতন্ত্রপ্রেমী?
তিনি যদি গণতন্ত্রপ্রেমী হতেন তাহলে তিনি অবশ্যই জাতির স্বার্থকে তারেক-আইএসআইয়ের ধ্বংসাত্মক প্রস্তাবের ওপরে স্থান দিতেন এবং শেখ হাসিনার আহ্বানে সর্বদলীয় ইলেকশনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতেন না কি? এতে কি তার দলের কোন ক্ষতি হতো? বরং ইমেজের উন্নতি হতো নয় কি? আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আন্দোলন বন্ধ হতে পারে একমাত্র জাতি যদি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে শাসক দল কর্তৃক গঠিত নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচন পরিচালনা করার ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন হচ্ছে-খালেদা জিয়া কর্তৃক গণতন্ত্র যাত্রা ঘোষণা করে অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করা কি আর যৌক্তিক থাকে? থাকে না। যেহেতু তিনি গণতন্ত্র উদ্ধারে নেমেছেন, সুতরাং তাঁকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মান্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার বহুল প্রচলিত আন্তর্জাতিক প্রথাটিই মানতে হবে। নয় কি?
'গণতন্ত্রের অভিযাত্রা' আর 'অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা' পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক তিনি জানেন নিশ্চয়। গণতন্ত্র দাবি করলে অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে, ম্যাডাম, এর আর কোন বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা দয়া করে শাসক দলের দ্বারা গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে 'সর্বদলীয় করেছেন, আপনাকেও সুযোগ দিয়েছিলেন, আপনিই সেটি গ্রহণ করেননি। আসলে নির্বাচন আপনি চান না। তাই তো? ম্যাডাম, অপরের কথায় চললে শেষে কিন্তু নিজেরই ক্ষতি হয়।
গোপালগঞ্জ, পুলিশ, আওয়ামী সরকারের ওপর যে ক্রোধ প্রকাশ করেছেন, আশা করছি 'ডেইলি স্টার' এর ওপর মন্তব্য প্রতিবেদন লিখবে। সেটি পড়ার অপেক্ষা করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ।
বাংলাদেশের সৌভাগ্য, বাঙালীর সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর মতো অতি বড় মাপের দূরদর্শী এক নেতা এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ্য যথার্থ সঙ্গী তাজউদ্দীন, তাঁদের দু'জনের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য নেতা মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, এমএ হান্নান, শামসুল হক, জহুর আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ উল্লা, আরও অনেক নক্ষত্রপ্রতিম অসাধারণ দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ যারা জাতীয় রাজনীতিতে যেমন তেমনি স্ব স্ব জেলার তৃণমূলে জনমানুষকে জাতীয় স্বার্থ ও কর্তব্যকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। '৬৯ থেকে ৭১ মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত দল, মত নির্বিশেষে সব বাঙালীকে এঁরা বজ্রকঠিন ঐক্যে একই লক্ষ্যে পরিচালিত করেছিলেন। এ ঘটনা সারা পৃথিবীতে বিরল।
একই সঙ্গে বলতে হয় বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, বাঙালীর দুর্ভাগ্য যে, '৭১ এ এই বাঙালীর বহু কঠিন ঐক্যে ফাটল ধরানোরও সূচনা ঘটেছিল চট্টগ্রামের বেতারে বঙ্গবন্ধুুু স্বাধীতার ঘোষণার পাঠকারী মেজর জিয়াউর রহমানের উত্থানের মধ্য দিয়ে! আজ মনে হয়, চট্টগ্রামে যুদ্ধরত ইপিআরের মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম কালুরঘাট থেকে বহুদূরে অবস্থান করার ফলে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ তাকে একটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছিল যা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। কেননা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ একজন রাজীতিকেরই তো করার কথা। কোন সেনা সদস্যের করার কথা নয়। সে হিসেবে এমএ হান্নান বা জহুর হোসেন চৌধুরী বা আতাউর রহমান কায়সার উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। যাই হোক, বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনদের সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা থাকার পরও জিয়াকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিয়োগ, 'বীর উত্তম' খেতাব প্রদান, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার পর কর্নেল তাহেরের সেনাবাহিনীর সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাকে আস্থায় গ্রহণ এবং ৭৭ এর ৩ ও ৭ নবেম্বর অসাধারণ রণকৌশলী বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও কর্নেল হায়দার এবং পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের হত্যার মাধ্যমে জিয়া ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। ক্ষমতা সংহত করতে জিয়া আরও প্রায় চার হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যুয়ের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেনাবাহিনীতে মুক্তি যোদ্ধার সংখ্যা হ্রাস করে। অপরিদিকে '৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি, ক্ষমতায় বসানো, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান করে তোলা, সবশেষে জামায়াতের পাকিস্তানী আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আধুনিক চেহারার বিএনপি দল গঠন ও মেধাবী ছাত্রদের অর্থ, অস্ত্র দিয়ে পেশী অস্ত্র অর্থভিত্তিক দুর্বৃত্তের অপরাজনীতি বা অপ-ক্র্যাসির সূচনা করেছিল। বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের হাতেই সৃষ্ট দুর্র্বৃত্তায়িত অপরাজনীতি দিয়ে জিয়াই গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এ সত্যকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এমনই একটি অলিখিত পাকিস্তান নির্দেশিত পথেই যে বাংলাদেশকে চলতে হবে বা পাকিস্তানপন্থী ক্ষমতাবানরা ঐ পথেই চলবে এবং বাংলাদেশকে আলাদা ভৌগোলিক অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মিত্র ভারত বিদ্বেষী ও মনে আদর্শে পাকিস্তানী মৌলবাদের পথেই পরিচালনা করা হবেÑএটিই যে সে সময়ে সিদ্ধান্ত ছিল, তা আজ স্পষ্ট।
জিয়া বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে বন্দী মৌলবাদের দৈত্যকে সেই নিষিদ্ধকরণ বাতিল করে বোতলের ছিপি খুলে দিয়ে মৃতপ্রায় মৌলবাদী জামায়াতকে পুনরুজ্জীবন দান করেছিল। আর জিয়া নিহত হলে পাকিস্তানী রীতিতে তদানীন্তন সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করে, জিয়ার অনুসরণে অন্তত দু'টি কাজ করে (১) 'রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম' সংবিধানে সংযুক্ত করে (২) জিয়া হত্যার পর পরই চট্টগ্রামের জিওসি বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার মনজুরকে হত্যা করে এবং তেরোজন সেনা মুক্তিযোদ্ধাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদ- দেয়। শোনা গেছে, এদের মধ্যে কেউই প্রত্যক্ষভাবে জিয়া হত্যার জন্য দায়ী ছিল না। তরুণ মেজর ইয়াজদানী তো মাত্র আগের রাতে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে এসেছিল। অথচ জিয়া হত্যার বিচার হলে যে সত্য প্রকাশ পেত সে বিচার এরশাদও করেনি, পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে জিয়াপতœী খালেদা জিয়াও করেনি। জিয়া হত্যার বিচারের অন্তরালে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি 'মিসিং লিংক' রয়ে গেছে বলে ধারণা করা অমূলক হবে না। তবে, আজ পেছন ফিরে তাকালে বোঝা যায় পাকিস্তান বা আইএসআইএর প্রথম পছন্দ জিয়া পরিবার যারা সব সময় পাকিস্তানের ফরমায়েশ মতোই বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরের লক্ষ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র করার সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষপ গ্রহণ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে কোন নেত্রী/নেতা কি যুক্তিহীনভাবে বছরের পর বছর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদ বর্জন করেন? সংসদকে অকার্যকর করার জন্যই নয় কি? গণতন্ত্রের কথা তার মুখেই মানায় যে নেতা/নেত্রী আগুনে পোড়া নিরীহ নারী পুরুষ-শিশুদের দেখতে যেতেন, আর্থিক সহায়তা ও মৌখিক সমবেদনা জানাতেন। তিনি কি কুম্ভিরাশ্রুও বিসর্জন করেছেন?
কেন তিনি আইএসআই বা অন্য জঙ্গী উৎস থেকে অর্থ নিয়ে তা ব্যবহার করে বাস-ট্রাক পোড়ানোর জন্য পুরস্কার, বোমা-ককটেল গানপাউডার ছুঁড়ে মানুষ মারার জন্য আর্থিক পুরস্কার দিয়ে তরুণ প্রজন্মের একটি দলকে নব্য আলবদরে পরিণত করলেন?
তিনি কি বাঙালী তরুণদের উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবী না হয়ে দুর্বৃত্ত, খুনী, মৌলবাদী, জঙ্গী, বোমাবাজ, গ্রেনেডবাজ, বিবেকহীন মানুষ হন্তারকে পরিণত করতে পারলে খুশি হন? আলামত তো প্রমাণ করছে তিনি বাঙালী তরুণদের হন্তারক, দেশ ধ্বংসকারীতে পরিণত করতে যথেচ্ছ অর্থ বিলাচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন।
তিনি কি সত্যিই নির্বাচন চান? তিনি কি শুধুমাত্র ক্ষমতায় যেতেই নির্বাচন চান? তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারকে আজ্ঞাবহ করা সহজ ভেবে সেটি চান নাকি এটি 'আসলে দেশ ধ্বংসের আন্দোলন করার উসিলা মাত্র?
নির্বাচনে জিতে তিনি কি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিতে পারবেন? এটা তো '৭৬ সাল নয়, এটা ২০১৩, এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে কোটি কোটি তরুণ-তরুণী দেশে বিদেশে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে রাজপথে নেমেছে। তাই তিনি নির্বাচনে জিততেও চান না। প্রকৃত পক্ষে নির্বাচনই চান না, তাই কি জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়নি? তিনি তত্ত্ব¡াবধায়কের নামে আসলে দেশের উন্নতির পথে অগ্রসররত সব ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দিয়ে বড় কোন নাশকতার দ্বারা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে আইএসআই প্রদত্ত 'কর্তব্যকাজ' সম্পন্ন করতেই আগ্রহী নন কি?
তিনি ২০০৬-এ কথিত ২৫০টি ডলার পূর্ণ স্যুটকেস বিদেশের কোন নিরাপদ স্থানে রেখে এসেছিলেন কেন? এ রকম দিন আসতে পারে ভেবে কি? ডেইলি স্টার কি জনগণকে জানাবেন সত্যি কি ঘটেছিল? তাদের সব মন্তব্য প্রতিবেদন এক নেত্রীর বিরুদ্ধে কেন? তিনি ধর্মের নামে রাজনীতি করা জামায়াত-হেফাজতের নেত্রী, তাহলে নারী গোয়েবলসের মতো এত মিথ্যা তিনি বলেন কেন? ২০০৪-এর আগস্টে গ্রেনেড হামলাকে তিনি অস্বাভাবিক জেনে বুঝেও এখনও বলেনÑওটি আওয়ামী লীগই করেছে কেন? সংবাদ সম্মেলনেও বললেন জ্বলন্ত মিথ্যা-'আওয়মী লীগ সরকার গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করছে' কেন এই অসত্য বক্তব্য? এই মানুষবিরোধী, বৃক্ষ, রাস্তা-ব্রিজ, খাদ্যপণ্য, কৃষি-শিল্প বিরোধী খুনী-দুর্বৃত্তদের জননী কি গণতন্ত্রপ্রেমী?
তিনি যদি গণতন্ত্রপ্রেমী হতেন তাহলে তিনি অবশ্যই জাতির স্বার্থকে তারেক-আইএসআইয়ের ধ্বংসাত্মক প্রস্তাবের ওপরে স্থান দিতেন এবং শেখ হাসিনার আহ্বানে সর্বদলীয় ইলেকশনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতেন না কি? এতে কি তার দলের কোন ক্ষতি হতো? বরং ইমেজের উন্নতি হতো নয় কি? আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আন্দোলন বন্ধ হতে পারে একমাত্র জাতি যদি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে শাসক দল কর্তৃক গঠিত নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচন পরিচালনা করার ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন হচ্ছে-খালেদা জিয়া কর্তৃক গণতন্ত্র যাত্রা ঘোষণা করে অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করা কি আর যৌক্তিক থাকে? থাকে না। যেহেতু তিনি গণতন্ত্র উদ্ধারে নেমেছেন, সুতরাং তাঁকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মান্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার বহুল প্রচলিত আন্তর্জাতিক প্রথাটিই মানতে হবে। নয় কি?
'গণতন্ত্রের অভিযাত্রা' আর 'অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা' পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক তিনি জানেন নিশ্চয়। গণতন্ত্র দাবি করলে অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে, ম্যাডাম, এর আর কোন বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা দয়া করে শাসক দলের দ্বারা গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে 'সর্বদলীয় করেছেন, আপনাকেও সুযোগ দিয়েছিলেন, আপনিই সেটি গ্রহণ করেননি। আসলে নির্বাচন আপনি চান না। তাই তো? ম্যাডাম, অপরের কথায় চললে শেষে কিন্তু নিজেরই ক্ষতি হয়।
গোপালগঞ্জ, পুলিশ, আওয়ামী সরকারের ওপর যে ক্রোধ প্রকাশ করেছেন, আশা করছি 'ডেইলি স্টার' এর ওপর মন্তব্য প্রতিবেদন লিখবে। সেটি পড়ার অপেক্ষা করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ।
প্রকাশ : শনিবার, ৪ জানুয়ারী ২০১৪, ২১ পৌষ ১৪২০
__._,_.___