সোমবার, ৪ মার্চ ২০১৩, ২০ ফাল্গুন ১৪১৯
রাজধানীতে হরতাল প্রত্যাখ্যান, রাস্তায় প্রতিরোধ মিছিল
জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জামায়াত আহূত টানা দুইদিনব্যাপী হরতালের প্রথমদিনেই সমুচিত জবাব দিয়েছে রাজধানীবাসী। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এই সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের ডাকা বিগত হরতালগুলোর ন্যায় এবারও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল নগরবাসী। শুধু প্রত্যাখ্যানই নয়, রাজধানীতে রবিবারের হরতাল প্রতিরোধে রাজপথে জনতা দিনভর প্রতিরোধ কর্মসূচীও পালন করে। একদিকে স্বতঃস্ফূর্ত জনতার প্রতিরোধ, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ও সতর্ক অবস্থানের পাশাপাশি হরতালবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গ-সংগঠনের বিক্ষোভ মিছিল ও উত্তপ্ত সেøাগানে হরতাল সমর্থক জামায়াত-শিবির রবিবারে রাস্তায়ই নামতে পারেনি।
এছাড়া হরতাল প্রতিরোধের আগে থেকেই যার যার অবস্থান থেকে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে নিরুত্তাপ হরতালের কারণে এদিন রাজধানীর জনজীবন ছিল সপ্তাহের অন্যান্য দিনের মতোই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। রাজধানীর প্রতিটি এলাকার সরকারী-বেসরকারী অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমাসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই খোলা রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী মানুষ যথাসময়ে কর্মস্থলে এসে হাজির হয়। দাফতরিক কর্মকা-ও চলে স্বাভাবিক নিয়মেই। সব ধরনের যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। এদিন নগরীর ফার্মগেট, পুরানা পল্টন, মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক, সায়েদাবাদ, মহাখালী, নিউমার্কেট ও ধানম-ি এলাকায় প্রায় সময়ই চিরাচরিত জ্যামের দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে তুলনামূলক প্রাইভেটকারের চলাচল ছিল কিছুটা কম।
এছাড়া সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে জামায়াত-শিবির কোথাও সংগঠিত হতে না পারলেও লাগাতার দুই দিনের হরতালের প্রথমদিনে রবিবার কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল ও বিক্ষিপ্ত বোমাবাজির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। পুলিশ এসব ঘটনায় প্রায় ২০ জনকে আটক করেছে। রাজধানীর কয়েকটি জায়গায় চোরাগোপ্তার মতোই ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। আবার দু'একটি জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করে। তবে পুলিশ আসা মাত্রই ওরা পালাতে প্রাণান্ত ছোটাছুটি করে। অবশ্য এ সময় কয়েকটি বাসও ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে।
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে নির্ধারিত সময়েই সব ট্রেন যাওয়া আসা করেছে বলে স্টেশন মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন। তিনি জানান, লাইনের ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনগুলোতে 'লাইন পাহারা' বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি গাড়িতে রেল পুলিশের সংখ্যা ১২ জন থেকে বাড়িয়ে ১৫ জন করা হয়েছে। সকালে কমলাপুর থেকে নির্ধারিত সব ট্রেনই সময়মতো ছেড়ে গেছে বলে স্টেশন মাস্টার জানান।
সায়েদাবাদ থেকেও দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে বলে টিকেট কাউন্টার থেকে জানানো হয়। এদিকে রাজধানীর সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ ছেড়ে গেছে বলে জানান দায়িত্বরতরা। তবে হরতালের কারণে যাত্রী কম হওয়ায় অন্যদিনের তুলনায় কম লঞ্চ ছাড়া হয় বলে জানান তারা। সরেজমিন নগরীর যাত্রবাড়ী, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, গুলিস্তান, সদরঘাট এলাকায় যানচলাচল ছিল স্বাভাবিক। ফার্মগেট, মহাখালী, মগবাজার, মৎস্যভবন, শাহজাহানপুর, রামপুরা, মালিবাগ এলাকায়ও যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল পরিলক্ষিত হয়েছে। স্থানীয়, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হরতালবিরোধী মিছিল বের করে এসব এলাকায়। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব এলাকায় পুলিশ র্যাব, ও বিজিবি সদস্যদের অব্যাহত টহল দিতে দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাও ছিল শান্ত। কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ একাডেমিক কার্যক্রম চলে।
ভোরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিল করে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এছাড়া সকাল ৮টার দিকে বাড্ডা এলাকায় কয়েক হরতাল সমর্থক কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসার আগেই পালিয়ে যায় জামায়াত-শিবির। এছাড়া যাত্রাবাড়ীতেও হরতালকারীরা সকালে বাস ভাংচুর করেছে বলে জানা গেছে। এ সময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করেছে। সকাল ৭টায় রায়েরবাগ সাদ্দাম মার্কেটের সামনে জামায়াত-শিবির মিছিল বের করে রাস্তায় টায়ারে আগুন দেয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে আরও চারজনকে পুলিশ আটক করে।
রাজধানীর শ্যামলীতেও ভোরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সামনে হরতাল সমর্থকরা টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় জামায়াত-শিবির কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রতিরোধে পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে। পুলিশ জানায়, হরতাল সমর্থকরা আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য সড়কের মাঝখানে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধের চেষ্টা চালায়।
শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে ৩-৪টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায় জামায়াত-শিবির। এছাড়া সকাল ৮টায় আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুহূর্তে কোয়ার্টারের ভেতর ঢুকে হাওয়া হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জামায়াত-শিবিরের আড়ালে বিএনপি নেতাকর্মীরা এই বিস্ফোরণ ঘটায়।
ওদিকে জামায়াত-শিবিরের হরতাল প্রতিহতের আহ্বান জানিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির সারাদেশে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এজন্য তিনি দেশের বিবেকবান ও সচেতন মানুষকে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি করে ওদের হরতাল আর সকল নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান। রবিবারের হরতাল প্রতিরোধে সকাল সাড়ে ৮টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ চত্বর থেকে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ একটি হরতালবিরোধী মিছিল বের করে। মিছিলটি ফার্মগেট, হোটেল সোনারগাঁও মোড় হয়ে মানিক মিঞা এ্যাভিনিউ এসে শেষ হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মহাসচিব মোবারক আলী, যুগ্ম মহাসচিব ও কৃষিবিদ সমীর চন্দ্র, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের ঢাকা মহানগর সভাপতি কৃষিবিদ মজিবুর রহমান। এছাড়া রাজধানীর অন্য কোথাও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি।
হরতাল পালন ও কর্মস্থলে উপস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক এএফএম আসাদুজ্জামান জানান, অন্যান্য দিনের মতো রবিবারও যথাসময়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ই নয়, আমাদের শাখা অফিসগুলোরও কার্যক্রমও ছিল স্বাভাবিক। সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, হরতাল সত্ত্বেও সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল শতভাগ।
সরজমিনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকা-ে হরতালের কোন প্রভাবই পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থনীতির প্রাণ এই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম অন্যান্য দিনের মতো যথাসময়েই শুরু হয়েছে এবং স্বাভাবিক নিয়মেই চলেছে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিও ছিল শতভাগ। তবে ব্যাংকগুলোতে নারী গ্রাহকের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম।
তবে রাস্তায় পাবলিক পরিবহনের ঘাটতি না থাকলেও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রাইভেটকারের উপস্থিতি ছিল কম। এ বিষয়ে একজন ব্যাংকার জানান, তিনি নিজে গাড়ি ব্যবহার করলেও সোমবার গাড়ি বের করেননি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অফিসে এসেছেন। তাঁর মতো অনেকেই যারা প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করেন তাঁরা গাড়ি বের করেননি।