কিছুদিন আগে পুলিশ কনস্টেবল শওকতের বিরুদ্ধে 'গুরুতর' অভিযোগ উত্থাপন করেন তার স্ত্রী। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শওকত স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেন। এর আগে বিভিন্ন সময় তিনি স্ত্রীর নামে বেশ কিছু জমি কিনে রেখেছিলেন। ছাড়াছাড়ির পর তিনি ওই জমি নিজের হেফাজতে নেওয়ার উপায় খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে দ্বারস্থ হন নান্নু মুন্সী নামে এক কবিরাজের।
কবিরাজ তাকে আশ্বস্ত করেন, পোষা জিন দিয়ে তিনি শওকত ও তার স্ত্রীর মধ্যে ফের সুসম্পর্ক গড়ে দেবেন। এর পর তিনি কৌশলে জমিগুলো নিজের নামে স্থানান্তর করে নিতে পারবেন। এর পর কয়েক দফায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা নেওয়ার পরও সমস্যার সমাধান করতে পারেননি কবিরাজ। একটি ঘটনার পর শওকত উপলব্ধি করেন, নান্নু প্রতারক। বিষয়টি বুঝতে পেরে নান্নু মুন্সীকে গলা কেটে হত্যা করেন শওকত।
রাজধানীর পল্টনে ট্রাফিক ভবনের ছাদে নান্নু মুন্সীর মস্তকবিহীন দেহ উদ্ধারের পর কনস্টেবল শওকতকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। পাশাপাশি গতকাল বুধবার সকালে নিহত ব্যক্তিকে কবিরাজ নান্নু মুন্সী (৪২) হিসেবে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। পরে শওকতের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল বিকেলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুকুর থেকে নিহতের খণ্ডিত মাথা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনারকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ব্যারাকের ভেতরে হওয়ায় এ হত্যাকাণ্ডে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত বলে প্রথমেই ধারণা করা হয়। এর সূত্র ধরে গতকাল হত্যায় জড়িত কনস্টেবল শওকতকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট শাখায় কর্মরত ছিলেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, এ হত্যাকাণ্ড থেকে বোঝা যাচ্ছে, পুলিশের আবাসিক স্থাপনাগুলোয় নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। তাই পুলিশের সব স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার ছাড়াও রয়েছেন মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার ও ডিবির একজন সহকারী কমিশনার।তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, শওকতকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে হত্যার নেপথ্যের চমকপ্রদ কাহিনী। প্রথমে তিনি হত্যার বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। জেরার এক পর্যায়ে তিনি পুরো ঘটনার বিবরণ দেন। শওকত ও তার স্ত্রীর দত্তক নেওয়া একটি মেয়ে রয়েছে। কিছুদিন আগে তার স্ত্রী পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন, শওকত তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন। ঘটনার সপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দেয় ওই মেয়ে। এর পরই শওকতকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
শওকত পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি এক সময় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন। এর সুবাদে একসঙ্গে বেশ কিছু অর্থ তার হাতে আসে। দেশে ফিরে তিনি ওই অর্থ দিয়ে স্ত্রীর নামে কিছু জমি কিনে রাখেন। ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর বন্ধুরা তাকে জমি উদ্ধার করে নিজের হেফাজতে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। শওকতও উপায় খুঁজতে থাকেন জমি উদ্ধারের। এক সময় তিনি যশোরের ঝিকরগাছার কবিরাজ নান্নু মুন্সীর সন্ধান পান। নানা রকম জটিল-কঠিন সমস্যা সমাধানে নান্নু মুন্সীর 'খ্যাতি' রয়েছে বলেও জানতে পারেন তিনি।
শওকতের ঘটনা শুনে নান্নু মুন্সী জানান, তার পোষা অনেক জিন রয়েছে। ওই জিনদের দিয়ে তিনি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করিয়ে দিতে পারেন। শওকত ও তার স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে দিতেও কাজ করবে তার জিনেরা। এ জন্য কিছু নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে। কিছু টাকাও খরচ হবে। শওকত তার শর্তে রাজি হয়ে যান। এর পর নানা অজুহাতে তার কাছ থেকে টাকা নিতে শুরু করেন নান্নু মুন্সী। বেশ কিছুদিন পার হলেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক আর গড়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত সোমবার এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করার ঘোষণা দেন নান্নু। বেঁধে দেন কঠিন শর্ত। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর জন্য নির্জন স্থানে দুটি কবর খুঁড়ে রাতে সেখানে শওকতকে অবস্থান করতে হবে। এ সময় ২৩০ বার সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে ভারত থেকে জিন এসে দু'জনের সম্পর্ক গড়ে দিয়ে যাবে।
শওকত বলেন, 'ঢাকা শহরে নির্জন স্থানে কবর পাব কীভাবে? তবে আমাদের ট্রাফিক ভবনের ছাদ নিরিবিলি। রাতে ছাদে তেমন কেউ ওঠে না।' তখন নান্নু তাকে ছাদে বসেই শুধু সূরা পাঠের পরামর্শ দেন। তিনি নিজেও সেখানে থেকে জিনকে নিয়ে এসে সমস্যার সমাধান করবেন বলে জানান।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সোমবার মধ্যরাতে পল্টন থানার পেছনে ট্রাফিক ভবনের ছাদে ওঠেন শওকত ও নান্নু। নির্দেশ অনুযায়ী শওকত সূরা পাঠ করতে থাকেন। নান্নু জিনকে সেখানে উপস্থিত করার জন্য সূরা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে একটি দড়িতে গিঁট দিয়ে যাচ্ছিলেন। গভীর রাত পর্যন্ত জিন আসার কোনো লক্ষণ না দেখে শওকত ক্ষিপ্ত হন। নান্নু তখনও আশ্বাস দিয়ে বলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই জিন আসবে। ভারত থেকে আসছে তো। তাই একটু দেরি হচ্ছে। এভাবে কয়েক দফা সময় নেওয়ার পরও জিন না এলে শওকত বুঝতে পারেন, নান্নু তার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। শওকত আগে থেকেই একটি কমান্ডো ছুরি তার সঙ্গে রেখেছিলেন। সেই ছুরি তিনি নান্নুর পেটে ঢুকিয়ে দেন। তখন নান্নু যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকায় তার গলা কেটে ফেলেন শওকত। ততক্ষণে রক্তে ভেসে গেছে ছাদ। কী করবেন বুঝতে না পেরে নান্নুর মাথাটি কেটে আলাদা করে খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে পলিথিনের একটি শপিং ব্যাগে ভরে সেটি নিয়ে বেরিয়ে যান। পরে তিনি মাথাটি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুকুরে ফেলেন। নিহত ব্যক্তির পরিচয় লুকাতেই মাথা সরিয়ে ফেলেন বলে জানান শওকত।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর সমকালকে বলেন, হত্যাকাণ্ডে শওকতের সঙ্গে অন্যরা জড়িত ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।পল্টন থানার ওসি মোরশেদ আলম সমকালকে জানান, শওকতের দেওয়া তথ্যে এবং তার দেখানো মতে গতকাল বিকেল ৪টার দিকে রাজারবাগের পুকুর থেকে খণ্ডিত মাথাটি উদ্ধার করা হয়।গতকাল সকালে নিহতের ভগি্নপতি জয়নাল আবেদীন ও ভাবী সাবিরা নাজমুল হক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে নান্নুর লাশ শনাক্ত করেন। তারা জানান, নান্নুর গ্রামের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। একজন পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি ১৯ জানুয়ারি রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। গতকাল সকালে একজন মোবাইল ফোনে কল করে পরিবারের সদস্যদের তার মৃত্যুর খবরটি জানান। নান্নুর স্ত্রীর নাম বিউটি বেগম। তার বড় মেয়ে টুম্পার বয়স ২১ বছর। রাব্বী (১৮) ও রাজ (৬) নামে তার আরও দুই ছেলে রয়েছে।
http://www.samakal.net/2014/01/23/34647
__._,_.___