বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০১৩, ২৭ চৈত্র ১৪১৯
হেফাজতের নারীবিরোধী অবস্থানে ফুঁসে উঠছে নারী সমাজ
নাজনীন আখতার ॥ এত স্পর্ধা! পথ রুদ্ধ করার এত সাহস! -আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রাখা আর অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা নারী সমাজের কণ্ঠে আজ একই আওয়াজ। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতে চাওয়া ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে নারী সমাজের পক্ষ থেকে আসছে নানা কর্মসূচী। হেফাজতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে আাগামী ২০ এপ্রিল সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে ৩৮টি নারী সংগঠন ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। কর্মসূচীর সময়, স্থান ও পরিকল্পনা ঠিক করতে ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। প্রত্যেকটি সংগঠনকে ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, হয় বাঁচার মতো বাঁচো নয়ত লড়াই করে মরো- এমন উপলব্ধি আর লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশব্যাপী নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা করা হবে। একই সঙ্গে একাত্তরে নারী ধর্ষণ, নির্যাতনসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামের মদদে কিভাবে রাজনীতিতে 'উড়ে এসে জুড়ে বসা' সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিশাল সমাবেশ আয়োজন এবং জামায়াতের পরিকল্পনা অনুযায়ী নারী বিদ্বেষী দাবি পেশ করার খোলস উন্মোচন করবে নারী সমাজ। সব শ্রেণী-পেশার নারীরা যেন ওই সমাবেশে অংশ নেন এবং হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলো ভালভাবে জেনে নিয়ে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান জানান সে আহ্বান থাকবে। এছাড়া দেশব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচী থাকবে। নারী নেত্রীদের মতে, যে দেশ গড়তে আন্দোলন-লড়াইয়ে ছিল নারী সেই দেশের নারী মৌলবাদীদের কাছে কখনও মাথা নত করবে না। স্বাধীনতার ৪২ বছরের অর্জন নারী উন্নয়ন নীতিকে নিয়ে আরও কোন গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু বরদাশত করা হবে না।
হেফাজতে ইসলামের দাবি ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের জন্য নেয়া সমাবেশ কর্মসূচী প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে অনেক লড়াই করেছে এ দেশের নারী। ওই গোষ্ঠীকে কোনভাবেই আর বাড়তে দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে আগামী ২০ এপ্রিল একটি বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে এই সময় এবং সমাবেশ কর্মসূচীর অন্যান্য পরিকল্পনা নিয়ে ১১ এপ্রিল বৈঠক করা হবে প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ৩৮টি সংগঠনের সঙ্গে। কমিটির সচিবালয় হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে প্রত্যেকটি সংগঠনের কাছে বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে।
মালেকা বানু জানান, এই সমাবেশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বা মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে হতে পারে। সমাবেশ থেকে সংগঠনগুলোকে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হবে। হেফাজতে ইসলামের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করে তাদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন নারী নেত্রীরা। জনকণ্ঠের কাছে এ নিয়ে তাঁরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুকে এ দেশের নারীরা আর ভয় পায় না। দায়িত্বপালনরত অবস্থায় হেফাজতের কর্মীদের নির্মম হামলার শিকার একুশে টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন বলেন, এভাবে আমাকে আমার কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে না ওরা। আমি লড়াই করবই।
মালেকা বানু বলেন, হেফাজত এত স্পর্ধা কোথায় পায় তা আমরা জানতে চাই। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর তারা কোন সাহসে নারীর গতিরুদ্ধ করতে চায়? এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার হিসাব-নিকাষ করতে গিয়ে বার বার মৌলবাদী চক্রকে প্রশ্রয় দেয়। আজ হেফাজতের দাবির প্রতিও কয়েকটি দলের সমর্থন রয়েছে। অথচ দাবিগুলো মোটেও এ যুগের নয়। 'চাঁদে সাঈদীকে দেখতে পাওয়া'র অপপ্রচারের সঙ্গেই ওই অপমানজনক দাবির মিল রয়েছে। ওইসব অগ্রহণযোগ্য দাবি মেনে নিলে নারীর কণ্ঠই রুদ্ধ হয়ে যাবে। তারা আজ নারীকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলাচল যদি বন্ধ করতে হয় তবে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে হবে? দেশের নীতি-নির্ধারণই বা হবে কিভাবে? যে দেশের অর্ধেক সংখ্যক ভোটার নারী, যে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রেখেছে ৮০ শতাংশ নারী পোশাককর্মী, সে দেশের নারীর চলাচল ঘরের ভেতর আটকে রাখা কতখানি যৌক্তিক?
একই রকমের প্রশ্ন রাখলেন মুক্তিযোদ্ধা ও নারী নেত্রী শিরিন বানু মিতিল। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন, কর্মসূচী, স্বাধীনতাযুদ্ধ সব কিছুতেই মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারীরা অংশ নিয়েছে। দেশ গড়ার ক্ষেত্রেও একইভাবে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছে নারী। সেই নারীর অবদানকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়। হেফাজতে ইসলাম কি দেশের নারীদের আফগানিস্তানের মতো বানাতে চান।
তিনি বলেন, নারীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল সমতার ভিত্তিতে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি। যে নীতি জামায়াতে ইসলাম বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতার শরিক থাকার সময় গোপনে পরিবর্তন করেছিল, সেই নীতিকে জামায়াতী আদর্শে বাতিল করতে চায় হেফাজতে ইসলাম। তারা নারীকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা লুটতে চাইছে। এখন নারীদের উপলব্ধি করতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কোন পথ বেছে নেব- নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়ার আদর্শ মেনে চলব নাকি হেফাজতের মধ্যযুগীয় দাবির প্রতি সমর্থন দেব।
ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশের দিন হেফাজত কর্মীদের হামলার শিকার সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন জনকণ্ঠের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মানতে হলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকেও রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে। নারীদের হেয় করার জন্য তারা যে দাবি তুলেছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, কর্মী নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা নারীদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমি আমার লড়াই থামাব না। আমি থেমে যাব না। কিন্তু আরও বহু সংখ্যক নারী আছেন যাঁরা কাজ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সেইসব নারী বাইরে বেরিয়ে আসবেন? সরকারকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
এদিকে হেফাজতের সমাবেশ, কর্মসূচী ও হরতালকে সমর্থন দেয়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার মতে, হেফাজতের ১৩ দফা দাবিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। একজন নারী জনপ্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতের দাবিকে তিনি সমর্থন করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সেদিন টেলিভিশনে সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার দেখেছি। তারা নারী-পুরুষের একই সঙ্গে চলাচল না করার বিষয়ে যে দাবি করেছে তা 'শাহবাগী'দের উল্লেখ করে করেছে। তাদের মতে, শাহবাগে ছেলেমেয়েদের ২৪ ঘণ্টা এভাবে অবস্থান নেয়া, স্লোগান দেয়া 'বেলেল্লাপনা।' তারা নারীর অধিকার বা কাজের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়ে আপত্তি করেননি। তিনি বলেন, আমরা ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করছি। নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মধ্যে বড় হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সন্ধ্যার আগেই প্রবেশের নিয়ম ছিল। সেক্ষেত্রে কমবয়সী মেয়েগুলোর রাতদিন শাহবাগে বসে থাকা আমার কাছেও নিরাপত্তাহীন বলে মনে হয়েছে। মেয়েগুলোর এখনও বিয়ে হয়নি। এ দেশের প্রেক্ষাপটে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।
পাপিয়া বলেন, হেফাজতের সমাবেশে যদি বলা হতো- নারী নেতৃত্ব মানি না। তবে তাতে আমি অবশ্যই আপত্তি জানাতাম। কারণ এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এদিকে নারী সাংবাদিকদের ওপর হেফাজত কর্মীদের হামলার ঘটনাকে সত্যি হয়ে থাকলে অবশ্যই নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাপিয়া বলেন, তাকে (সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন) যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মারধর করা হয় তাহলে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। এটা অপরাধ। যদি হুলস্থ'ূলের মধ্যে তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে মার খেয়ে থাকেন তবে তা দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, অনেক সময় সরকারের লোকজনও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এ ধরনের কাজ করে থাকে। সরকার গণমাধ্যমকে বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে বিএনপির সমাবেশ, কর্মসূচীর সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ঘটনা সেরকমও হতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পক্ষ-বিপক্ষের মত যতই থাক, নারীদের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুললে তা আত্মসম্মান রক্ষার জন্য প্রতিহত করতে হবে। তাদের প্রত্যাশা- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বাণী সব মতের মানুষের কানে পৌঁছাবে এবং নারীদের সম্মান প্রদর্শনের মর্ম উপলব্ধি করতে শেখাবে। কবি কবিতায় মাধ্যমে গেয়েছেন নারীর জয়গান-'বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি, অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। নরককু- বলিয়া কে তোমা' করে নারী হেয়-জ্ঞান? তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান। অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে, ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে। এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।'
হেফাজতে ইসলামের দাবি ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের জন্য নেয়া সমাবেশ কর্মসূচী প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে অনেক লড়াই করেছে এ দেশের নারী। ওই গোষ্ঠীকে কোনভাবেই আর বাড়তে দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে আগামী ২০ এপ্রিল একটি বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে এই সময় এবং সমাবেশ কর্মসূচীর অন্যান্য পরিকল্পনা নিয়ে ১১ এপ্রিল বৈঠক করা হবে প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ৩৮টি সংগঠনের সঙ্গে। কমিটির সচিবালয় হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে প্রত্যেকটি সংগঠনের কাছে বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে।
মালেকা বানু জানান, এই সমাবেশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বা মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে হতে পারে। সমাবেশ থেকে সংগঠনগুলোকে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হবে। হেফাজতে ইসলামের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করে তাদের প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন নারী নেত্রীরা। জনকণ্ঠের কাছে এ নিয়ে তাঁরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুকে এ দেশের নারীরা আর ভয় পায় না। দায়িত্বপালনরত অবস্থায় হেফাজতের কর্মীদের নির্মম হামলার শিকার একুশে টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন বলেন, এভাবে আমাকে আমার কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে না ওরা। আমি লড়াই করবই।
মালেকা বানু বলেন, হেফাজত এত স্পর্ধা কোথায় পায় তা আমরা জানতে চাই। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর তারা কোন সাহসে নারীর গতিরুদ্ধ করতে চায়? এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার হিসাব-নিকাষ করতে গিয়ে বার বার মৌলবাদী চক্রকে প্রশ্রয় দেয়। আজ হেফাজতের দাবির প্রতিও কয়েকটি দলের সমর্থন রয়েছে। অথচ দাবিগুলো মোটেও এ যুগের নয়। 'চাঁদে সাঈদীকে দেখতে পাওয়া'র অপপ্রচারের সঙ্গেই ওই অপমানজনক দাবির মিল রয়েছে। ওইসব অগ্রহণযোগ্য দাবি মেনে নিলে নারীর কণ্ঠই রুদ্ধ হয়ে যাবে। তারা আজ নারীকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলাচল যদি বন্ধ করতে হয় তবে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে হবে? দেশের নীতি-নির্ধারণই বা হবে কিভাবে? যে দেশের অর্ধেক সংখ্যক ভোটার নারী, যে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রেখেছে ৮০ শতাংশ নারী পোশাককর্মী, সে দেশের নারীর চলাচল ঘরের ভেতর আটকে রাখা কতখানি যৌক্তিক?
একই রকমের প্রশ্ন রাখলেন মুক্তিযোদ্ধা ও নারী নেত্রী শিরিন বানু মিতিল। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন, কর্মসূচী, স্বাধীনতাযুদ্ধ সব কিছুতেই মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারীরা অংশ নিয়েছে। দেশ গড়ার ক্ষেত্রেও একইভাবে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছে নারী। সেই নারীর অবদানকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়। হেফাজতে ইসলাম কি দেশের নারীদের আফগানিস্তানের মতো বানাতে চান।
তিনি বলেন, নারীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল সমতার ভিত্তিতে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি। যে নীতি জামায়াতে ইসলাম বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতার শরিক থাকার সময় গোপনে পরিবর্তন করেছিল, সেই নীতিকে জামায়াতী আদর্শে বাতিল করতে চায় হেফাজতে ইসলাম। তারা নারীকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা লুটতে চাইছে। এখন নারীদের উপলব্ধি করতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কোন পথ বেছে নেব- নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়ার আদর্শ মেনে চলব নাকি হেফাজতের মধ্যযুগীয় দাবির প্রতি সমর্থন দেব।
ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশের দিন হেফাজত কর্মীদের হামলার শিকার সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন জনকণ্ঠের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মানতে হলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকেও রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে। নারীদের হেয় করার জন্য তারা যে দাবি তুলেছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, কর্মী নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা নারীদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমি আমার লড়াই থামাব না। আমি থেমে যাব না। কিন্তু আরও বহু সংখ্যক নারী আছেন যাঁরা কাজ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সেইসব নারী বাইরে বেরিয়ে আসবেন? সরকারকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
এদিকে হেফাজতের সমাবেশ, কর্মসূচী ও হরতালকে সমর্থন দেয়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার মতে, হেফাজতের ১৩ দফা দাবিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। একজন নারী জনপ্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতের দাবিকে তিনি সমর্থন করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সেদিন টেলিভিশনে সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার দেখেছি। তারা নারী-পুরুষের একই সঙ্গে চলাচল না করার বিষয়ে যে দাবি করেছে তা 'শাহবাগী'দের উল্লেখ করে করেছে। তাদের মতে, শাহবাগে ছেলেমেয়েদের ২৪ ঘণ্টা এভাবে অবস্থান নেয়া, স্লোগান দেয়া 'বেলেল্লাপনা।' তারা নারীর অধিকার বা কাজের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়ে আপত্তি করেননি। তিনি বলেন, আমরা ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করছি। নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মধ্যে বড় হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সন্ধ্যার আগেই প্রবেশের নিয়ম ছিল। সেক্ষেত্রে কমবয়সী মেয়েগুলোর রাতদিন শাহবাগে বসে থাকা আমার কাছেও নিরাপত্তাহীন বলে মনে হয়েছে। মেয়েগুলোর এখনও বিয়ে হয়নি। এ দেশের প্রেক্ষাপটে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।
পাপিয়া বলেন, হেফাজতের সমাবেশে যদি বলা হতো- নারী নেতৃত্ব মানি না। তবে তাতে আমি অবশ্যই আপত্তি জানাতাম। কারণ এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এদিকে নারী সাংবাদিকদের ওপর হেফাজত কর্মীদের হামলার ঘটনাকে সত্যি হয়ে থাকলে অবশ্যই নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাপিয়া বলেন, তাকে (সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন) যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মারধর করা হয় তাহলে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। এটা অপরাধ। যদি হুলস্থ'ূলের মধ্যে তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে মার খেয়ে থাকেন তবে তা দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, অনেক সময় সরকারের লোকজনও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এ ধরনের কাজ করে থাকে। সরকার গণমাধ্যমকে বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে বিএনপির সমাবেশ, কর্মসূচীর সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ঘটনা সেরকমও হতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পক্ষ-বিপক্ষের মত যতই থাক, নারীদের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুললে তা আত্মসম্মান রক্ষার জন্য প্রতিহত করতে হবে। তাদের প্রত্যাশা- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বাণী সব মতের মানুষের কানে পৌঁছাবে এবং নারীদের সম্মান প্রদর্শনের মর্ম উপলব্ধি করতে শেখাবে। কবি কবিতায় মাধ্যমে গেয়েছেন নারীর জয়গান-'বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি, অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। নরককু- বলিয়া কে তোমা' করে নারী হেয়-জ্ঞান? তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান। অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে, ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে। এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।'
বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০১৩, ২৭ চৈত্র ১৪১৯
Also read:
হেফাজতের হুমকির পর ॥ নারী কি বন্দী হবে?
০ হেফাজতের নেতারা এক যুগ ধরে জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করছে
০ অপরাজেয় বাংলা ভেঙ্গে ফেলা হবে- নেজামী
০ হেফাজতের অধিকাংশ দাবি সংবিধান পরিপন্থী ও রাষ্ট্রবিরোধী- ড. কামাল
০ অপরাজেয় বাংলা ভেঙ্গে ফেলা হবে- নেজামী
০ হেফাজতের অধিকাংশ দাবি সংবিধান পরিপন্থী ও রাষ্ট্রবিরোধী- ড. কামাল
জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥
__._,_.___