বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য, বিএনপি নামক দলটি ক্ষমতায় থাকলেও রক্তপাত ঘটায়। বিরোধীদল হিসেবে থাকলেও রক্তপাত ঘটায়। রক্তপাত ঘটিয়ে এ দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন। এবং বন্দুকের ছায়ায় দল গঠন করেছিলেন। ফলে রক্তপাতের নেশা থেকে এ দল যেন আর মুক্ত হতে পারছে না। ব্রিটেনেও ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি নামে একটি বর্ণবাদী দল আছে। এই দল সম্পর্কে ২০০৪ সালে টোরি পার্টির তৎকালীন নেতা মাইকেল হাওয়ার্ড বলেছিলেন, "A bunch of thugs dressed up as a political party" (একদল দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক দলের পোশাক পরে আবির্ভূত হয়েছে)। বাংলাদেশের বিএনপি সম্পর্কে এতটা কড়া মন্তব্য করা সাজে কিনা জানি না।
বিএনপি এখন বিরোধী দলের ভূমিকায়। তবু তারা মিছিল মিটিং করলেই লোক মারা যায়। কখনও তাদের ক্যাডারদের হিংস্রতায়, কখনও পুলিশের গুলিতে। ২৯ জানুয়ারি বিএনপির মিছিলে চাঁদপুরে ও লক্ষীপুরে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে চার ব্যক্তি। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা এবং রাজশাহীতে বিএনপিও গণমিছিল করেছে। ঢাকায় কেউ আহত- নিহত হয়নি। কিন্তু রাজশাহীতে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে।
বিএনপি ও জামায়াত দাবি করছে, নিহত ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। পুলিশ বলছে, তারা রাজশাহীতে আদৌ গুলি চালায়নি। মিছিলের উচ্ছৃক্সখলতা নিয়ন্ত্রণে লাঠি এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করেছে। বরং জামায়াত-শিবিরের লোকেরা লাঠি-গুলি নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছিল। নিজেদের গোলাগুলিতেই ওই ব্যক্তি মারা গেছে। এবং সে জামায়াত-শিবিরের লোক।
মৃত্যু মাত্রই শোকাবহ। তা জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার মারা গেলেও শোকাবহ। রাজশাহীতেও এই মৃত্যুটি এড়ানো গেলে পুলিশ সকল বিতর্কের উর্ধে থাকতে পারত। অবশ্য ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় বিএনপির বিরাট গণমিছিল হওয়া সত্তে¡ও ছাত্রদল ও শিবিরের ক্যাডাররা সংযত ছিল এবং পুলিশকেও কোথাও শক্তি প্রয়োগ করতে হয়নি এবং শক্তি প্রয়োগের আগ্রহও তারা দেখায়নি। তাদের এই সাফল্য ও কৃতিত্বকে ক্ষুণœ করার জন্য রাজশাহীতে তারা অকারণে গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাবে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিছু একটা ঘটলেই আমরা পুলিশকে একতরফা নিন্দা করি। কিন্তু এবার রাজশাহীতে গুলিতে একজন শিবির কর্মীরও নির্মম মৃত্যু হয়ে থাকলে তার আসল কারণ কি তা দেশের নিরপেক্ষ মিডিয়ার খুঁজে বের করা উচিত।
লিখছি নিরপেক্ষ মিডিয়া। কিন্তু বাংলাদেশে কথাটি উচ্চারণ করতে ভয় হয়। ঢাকায় একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আছে, নিরপেক্ষতা হচ্ছে তার ঘোমটা ঘোমটার আড়ালে কুমতির অধিকারী গোয়েবলস-এর এক বকেয়া বাম শিষ্য হচ্ছে পত্রিকাটির সম্পাদক। অধিকাংশ সময় তিনি নিরপেক্ষতার ঘোমটা ধারণ করে থাকেন। কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে সেটি সরে যায়। তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। রাজশাহীতে গুলিতে নিহত ব্যক্তি যদি শিবির কর্মীও হয় এবং নিজেদের গোলাগুলিতেও যদি তার মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলেও এই মৃত্যু শোকাবহ এবং এ জন্য আমরা দুঃখিত ও শোক সন্তপ্ত এবং এমন দাবিও করি যে, এই মৃত্যুর আসল কারণ খুঁজে বের করা হোক এবং পুলিশ এ জন্য দায়ী হলে তাদের শাস্তি হোক।
কিন্তু রাজশাহীর এই একটি মৃত্যুর খবরে নিরপেক্ষ দৈনিকটির বুক একেবারে শোকাশ্রæতে ভিজে গেছে। ৩১ জানুয়ারি তারিখে তাদের প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজের হেডিং হচ্ছে "ঝরে গেল আরও একটি প্রাণ।" তারপর গোটা খবরটিই হলো, একটি শোক মর্সিয়া। দৈনিকটির খবরের এই হেডিং দেখে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু মন্তব্য করেছেন, রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের লোক বলে কথিত এক ব্যক্তির মৃত্যু যতই দুঃখজনক হোক, সেই মৃত্যুতে নিরপেক্ষ দৈনিকটি যেভাবে শোকাশ্রæ ফেলছে (অন্য চারটি মৃত্যুতে তেমন শোকাশ্রæ ফেলতে দেখা যায়নি), তাতে পত্রিকাটির সম্পাদক একাত্তরের যে যুদ্ধাপরাধী ঘাতককে মিতা সম্বোধন করেন, আল্লাহ না করুন জেলবন্দী থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হলে (আমরা অবশ্যই তা কামনা করি না) এই সম্পাদক তো মাতম শুরু করবেন।
তা এই মিতা অথবা তওবা সম্পাদকের কথা আজ থাক। যারা তার পবিত্র চরিত্র সম্পর্কে আমার চাইতে বেশি অবহিত, তার হাতে লাঞ্ছিত এবং তার দ্বারা বিতাড়িত, তার এককালের বন্ধু সাংবাদিকরা তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে 'কুমতি মানস চরিত' নামে একটি বই লিখলে ভাল করবেন। আমি বিএনপির রক্তনেশার রাজনীতির কথা ফিরে যাই।
আগেই বলেছি, ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপি রক্তপাত ঘটায়। ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ঘটায়। এটাই তাদের রাজনীতি। সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা তারা ভাবতে পারে না। আর গোড়া থেকেই তারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, হত্যার রাজনীতিতে দক্ষ জামায়াতীদের সঙ্গে পেয়েছে। আবার জামায়াতীদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে হিযবুত তাহ্রীর থেকে শুরু করে অসংখ্য বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে। ফলে দেশে সন্ত্রাস, কিডন্যাপিং, গুপ্ত হত্যা ও নারী নির্যাতনরোধে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে হিমশিম খেতে হবে তা আর বিচিত্র কি?
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে একজনের পর একজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী নেতা, সম্পাদক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার পেছনে বিএনপির বহু শীর্ষ নেতা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। বিএনপি- জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে এর একটি হত্যাকাণ্ড ও হত্যাচেষ্টার কিনারা করেনি, কারও বিচার ও দণ্ড হয়নি।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেই সরকারের কাছে সার ও কৃষিবীজ চাইতে এসে ১৮ জন কৃষককে পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হয়। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে আইযুব-মোনেম খাঁর আমল থেকে এরশাদের আমলেও কোন কারণেই কখনও পুলিশ ঢোকেনি। কিন্তু খালেদা জিয়ার আমলে এই প্রেসক্লাবে পুলিশ ঢুকে সাংবাদিকদের নির্মমভাবে প্রহার করেছে। পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরে তো জানা গেছে কার নির্দেশে পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকেছে এবং সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করেছে। ঢাকার শামসুন্নাহার হলে মধ্যরাতে ছাত্রী নির্যাতন তো এক দারুণ কলঙ্কের কাহিনী।
বিরোধীদল হিসেবে থাকাকালেই বা বিএনপি কি করেছে এবং এখনও করছে? যতবারই বিএনপি হরতাল, মিটিং, মিছিল ডেকেছে ততবারই হত্যা রক্তপাত ঘটেছে। বাস, গাড়ি, দোকানপাটে আগুন লাগানো তো সামান্য ব্যাপার, বিএনপির ডাকা হরতালের দিনে এক গরিব রিক্সাচালক তার রিক্সা নিয়ে পথে বের হওয়াতে তাকে গাড়ি সমেত পুড়িয়ে মারা হয়। এক তরুণ ব্যবসায়ী গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তার গাড়িতে বোমা মেরে তাকে হত্যা করা হয়। বিএনপির স্যাঙাৎ জামায়াত- শিবিরের ক্যাডারদের হাতকাটা, রগকাটা, শিক্ষক হত্যা, প্রতিপক্ষের কর্মীদের অপহরণ করে হত্যার পর ড্রেনে লাশ লুকিয়ে রাখার ঘটনা তো বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কালাপাহাড়ী অধ্যায়। তখনও পুলিশ যদি নিরীহ মানুষের জানমাল রক্ষায় কঠোরভাবে এগিয়ে যেত, তাহলে অবশ্যই রক্তপাত হতো।
আর তা হলে বিএনপির নেতা ও মিডিয়া চিৎকার শুরু করত 'পুলিশের বর্বর নির্যাতন', 'ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বর্বরতা।' আর নিরপেক্ষ দৈনিকটি নিরপেক্ষতার ঘোমটা সরিয়ে শোকাশ্রæতে গণ্ড ভাসিয়ে দিত।
এবারেও কি ঘটেছে? ২৯ ও ৩০ জানুয়ারির ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে কি দেখা যাবে? ২৯ তারিখে বিএনপির পূর্বঘোষিত গণমিছিল করার কথা ছিল। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করায় তা হয়নি। বিএনপি নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে মিটিং মিছিল করতে যায়নি। কোন গণ্ডগোল ও রক্তপাতও হয়নি। কিন্তু চাঁদপুর ও ল²ীপুরে গণ্ডগোল হয়েছে এবং চার ব্যক্তি মারা গেছে। দিনাজপুর ও কিশোরগঞ্জে রক্তপাত হয়নি, কিন্তু গণ্ডগোল হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় বিএনপির এত বিরাট মিছিল হয়েছে, কিন্তু রক্তপাত দূরের কথা, একটি গাছের পাতাও নড়েনি। ঢাকায় আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি আছে, এখানে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা উচ্ছৃক্সখল ও মারমুখী হতে সাহস পায়নি। কিন্তু একই দিনে রাজশাহীতে তারা মারমুখী হয়েছে, পুলিশের ওপর হামলা করেছে এবং জীবনহানি ঘটেছে।
একই দিনে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে বিপরীত ঘটনা ঘটার কারণ কি? নিরপেক্ষ (নিরপেক্ষ দৈনিকটির মতো নিরপেক্ষ নয়) সাংবাদিক বন্ধুরা বলেছেন, ল²ীপুর ও চাঁদপুর দু'স্থানেই জামায়াতীদের ঘাঁটি শক্ত। রাজশাহীতে বটেই। দিনাজপুর ও কিশোরগঞ্জে হিযবুত তাহ্রীর গোপন ঘাঁটি গেড়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই পাঁচটি শহরেই গণ্ডগোল হয়েছে, তিনটিতে প্রাণহানি ঘটেছে। রাজধানীসহ আর কোথাও নয়।
সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না, রক্তপাত ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কারা এই মারদাঙ্গা করেছে, পুলিশের ওপর হামলা করেছে এবং পুলিশকে আত্মরক্ষায় গুলি করতে হয়েছে। বিএনপিও আন্দোলনের নামে এই মারদাঙ্গা চায়। কিন্তু নিজেদের শক্তিতে তা করতে পারে না। বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলে তাদের যুবদল, ছাত্রদলের ক্যাডাররা ভীতু মূষিক হয়ে যায়। মারদাঙ্গায় নেতৃত্ব দিতে চায় না। নেতৃত্ব দেয় জামায়াত-শিবিরের ঘাতক বৃত্তিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডাররা। আর এখন তো তারা দেশে রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও অরাজকতা সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর। কারণ, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই হবে এবং সেই লক্ষ্যে এই সরকারকে যে কোনভাবে এখনই ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। তাতে দেশে আবার রক্তগঙ্গা যদি বহে, বহুক। বিএনপির 'তারেক বাঁচাও' আর জামায়াতীদের গোলাম আযম তথা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাও'-এর লক্ষ্য ও কর্মসূচী তাই এক হয়ে গেছে।
প্রাচীনকালে হিন্দু রাজারা অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো নরমেধ যজ্ঞও করতেন। তান্ত্রিকেরা নরবলি দানের প্রথাও অনুসরণ করতেন। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যা করছে, তাকে আধুনিক নরমেধ যজ্ঞ বলা হলে কি অন্যায় করা হয়? আওয়ামী লীগকে অবশ্যই আন্দোলনের নামে এই নরমেধ যজ্ঞ বন্ধ করার জন্য দৃঢ় ভ‚মিকা নিতে হবে। গণতন্ত্র অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রথায় মিটিং, মিছিল, আন্দোলন করার পথ খোলা রাখবে। কিন্তু গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে কেউ যদি গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই আঘাত করতে চায় তাহলে গণতন্ত্রকে অবশ্যই তার রুদ্র ও কঠোর মনোভাবটিও দেখাতে হবে। জন¯^ার্থ ও জনঅধিকার রক্ষায় শক্ত ভ‚মিকা ও কঠোর নীতির বিকল্প কিছু নেই।
লন্ডন, ৩১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১২
ভারতের মাস্তানির বিরুদ্ধে একদিন জেগে উঠবে বাংলাদেশের জনতা।