একটি সত্য গল্প
তখন আমি পড়ি ক্লাস এইটে। ঐ বছর আমাদেরকে ঘরের গরু দিয়েই কোরবানীর ঈদ করতে হয়েছিল। মনে পড়ছে না ঠিক কি কারণে কোরবাণী দেয়ার জন্যে হাট থেকে গরু কিনতে পারি নি। তাই নিরুপায় হয়েই ঘরের গরু দিয়ে ঈদ করার সিদ্ধান্ত হয়।
গরু ছিল আমার বাবার ধ্যান জ্ঞান। স্কুল থেকে ফিরে তাঁর প্রথম কাজ ছিল গরুকে কুড়া খাওয়ানো। কাপড়-চোপড় পর্যন্ত ছাড়তো না। বাড়িতে গরুর দেখাশোনার জন্য রাখাল থাকলেও তার উপর ভরসা করতো না। আপন পুত্রের মতন যত্ন নিত। আর গরুটা যেন প্রতিদিন আব্বার স্কুল থেকে ফেরার অপেক্ষায় থাকত। সাইকেলের বেলের আওয়াজ পেলে সে হাম্বা হাম্বা করা শুরু করত। যেন নালিশ করছে- তোমার রাখাল আমাকে আজ ঠিক ভাবে খাওয়াই নি।
চোখে ভাসছে- উঠোনে সাইকেল। খড়ের গাদার পাশে খুঁটিতে বাঁধা গরু। গরু খুড়া খাচ্ছে। আব্বা শার্ট-প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় তাকে খাওয়াচ্ছে। আর মুখে হাত ঠেস এক দৃষ্টে চেয়ে আছে তার পানে। আর আমিও পড়ার টেবিলে বসে তাদের ভালোবাসার কাণ্ড দেখি। কিছু সময়ের জন্য মনে হয় গরুটি আমারই মতন আমার বাবার পুত্র।
ঈদের দিন সকাল বেলা। বাড়ীর উত্তর ভিটায় সবাই প্রস্তুত। হুজুর সবাইকে দোয়া দরুদ পড়াচ্ছেন। আর সবাই সবলে গরুটিকে ঠেলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে মাটিতে পা গেঁথে রেখে প্রবল ভাবে না যাওয়ার চেষ্টা করছিল। লক্ষ্য করলাম, বাবা গরুটিকে ঠেললেও, সেরকম ভাবে জোড় দিচ্ছেল না। শেষ পর্যন্ত আমার বাবা গাছের একটি ঢাল নিয়ে তাকে মারতে শুরু করল। আর ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। লক্ষ্য করলাম বাবার চোখে জল। বাবা কাঁদছে। গরুর চোখ দিয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আর সে উচ্চ স্বরে ডাকছে। যেন সে বাবাকে বলছে- তুমি প্রতারক, তুমি নিষ্ঠুর। তুমি আমার কেউ নও।
তার জায়গায় কেন জানি নিজেকে কল্পনায় এল। বাবা আমাকে মেরে মেরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে উত্তর ভিটায়। সেখানে হুজুর সাহেব ধাঁরালো কিরিছ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
অনেক বছর ধরে আমি গরু কোরবানীর দৃশ্য দেখি না।
__._,_.___