We experienced same in 1971. (My source from twitter.)
Regards,
Asoke
মানুষ পচে গেলে
লিখেছেনঃ রীতু (তারিখঃ বুধবার, ০৮/০১/২০১৪ - ০৪:৫৩)
মায়ের কাছে শোনা মুক্তি যুদ্ধের গল্পের কথা মনে পড়ছে গতকাল থেকে। মুক্তি যুদ্ধের সময় জন্ম বলে, দেখলেও মনে নেই কিছু-ই। আমার মুক্তি যুদ্ধ দেখা বাবা, মা, দাদু, কাকু এদের চোখে, আমার মুক্তি যুদ্ধকে জানা এদের কাছে শোনা গল্পে গল্পে। মায়ের কাছে শুনেছি কেমন করে দিনের পর দিনে মিলিটারি আর রাজাকারদের হাতে থেকে পালিয়ে বেরিয়েছেন তারা।
আমরা তখন গ্রামে। বাবা একা একা চাকরীস্থলে থাকতেন। যুদ্ধ শুরু হলেও বাবা সহজে কর্মস্থল ছাড়তে পারেননি। মা আবার অন্তঃসত্ত্বাও, ছোট ভাইকে নিয়ে। মা বলতেন..., আমাদের ছোট ছোট তিন-ভাইবোনকে খেতে দেবার জন্য রান্না বসিয়েছেন মা। ভাতের পাতিল চুলো থেকে নামিয়েছেন, খবর আসত মিলিটারি আসছে। মা-ঠাম্মা ভাতের পাতিল ফেলে চুলোয় জল ঢেলে দিয়ে আমাদের কোলে, কাঁখে, পিঠে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছেন। আবার মিলিটারি চলে যাবার খবর পেলে বাড়িতে ফিরতেন, দেখতেন ভাঙ্গা বা উলটে ফেলা ভাতের হাড়ি, চুলো মুছে আবার ভাত চরাতেন। আমরা কান্না কাটি করতাম ক্ষিদায় । অনেক সময় ঘরে কিচ্ছু থাকত না রাঁধবার মত। মা বলতেন, কেমন করে তাকে আমাদের কান্না সহ্য করতে হত, দাঁতে দাঁত চেপে।
মায়ের কাছেই শুনেছি, গ্রামে হিন্দু পাড়াতে মিলিটারি বা রাজাকার আসার খবর এনে দিতেন সর্দার বাড়ীর লোকেরা। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন, মান্নান সর্দার। তিনি আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘদিন, বাবা-কাকারা তাকে 'জ্যাঠা' বলে ডাকতেন। আমার ঠাকুর্দার থেকে বয়সে কিছুটা বড় ছিলেন তিনি। আমরা তাকে 'দাদা' ডাকতাম। এই মান্নান সর্দার দাদাই গ্রামের হিন্দুদের আগলে রেখেছেন যতদিন পেরেছেন, বলেছেন,
- আমার গ্রামের মেয়ে-বউদের উপর কেউ হাত দিতে পারবা না। ওরা সবাই আমার মেয়ে, আমার ঘরের বউ।
যখন পাকিস্তানী বাহিনী আর রাজাকারদের অত্যাচার চরমে উঠল, যখন তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর কথায় আর কাজ নাও হতে পারে; শান্তি বাহিনী এবং অন্যরা গ্রামের হিন্দুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তখন তিনি আগে থেকে খবর দিয়ে এদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন। লুকিয়ে রাখতেন নিজের বাড়ীতেই অনেক সময়। এই সর্দার দাদার কারণেই আমাদের গ্রামে হিন্দুদের অন্য অনেক গ্রামের চেয়ে অনেক কম অত্যাচারিত হতে হয়েছে।
যুদ্ধের কিছুদিন পরেই আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে চলে আসি বাবার কর্মস্থলে। ঠাকুর্দা বেঁচেছিলেন যতদিন ততদিন আমরা বাড়ি যেতাম প্রতিবছর। যুদ্ধের পরে সর্দার দাদা বেঁচে ছিলেন আরো বেশ কয়েক বছর। আমি সেসময়ের অনেক কথা ভুলে গেলেও, সর্দার দাদার কথা আমার এখনো ঝাপসা মনে আছে; লম্বা দাড়ি ওয়ালা, হাল্কা-পাতলা মানুষ। হাঁটু অবধি লম্বা মওলানা পাঞ্জাবী পড়তেন সাদাটে লুঙ্গীর উপরে, মাথায় গোল টুপি। আমরা বাড়িতে পৌঁছেছি শোনামাত্রই, তিনি দেখা করতে আসতেন। মা আমাদের বাড়ির বড় বউ ছিলেন বলে গ্রামের সবাই তাকে 'বড় বউ' বলেই ডাকতেন। দাদা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ভরাট গলায় ডাকতেন,
-বড় বউ, ভাল আছোনি গো মা?
-হ, জ্যাঠা। মা ঘোমটা মাথায় টেনে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেন, সালাম করতেন।
দাদা বাবার কাজ কর্ম, আমাদের পড়াশুনা, মায়ের বাপের বাড়ি সব কিছুর খোঁজ খবর নিতেন। আমাদের সাথেও হালকা রসিকতা করতেন নাতনি বলে। মা দাদীর খবরাখবর নিতেন। যেদিন বাড়ি পৌঁছতাম সেদিন নাহলেও পরের দিন সকালেই মা ছুটতেন তাঁদের বাড়ি, দাদীকে সালাম করতে, আমাদের নিয়ে। দাদা মারা যাবার পর দাদি যতদিন বেঁচে ছিলেন আমরা দাদীকে সালাম করতে গেছি। দাদার ছেলেদের আমার কাকা বলেই ডেকেছি। দাদি মারা গেলে কাকা-কাকীদের সাথে দেখা করতে গেছি তাঁদের বাড়ি। গত জুলাইতে দেশে গিয়েও আমি সে বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি, আমার কাকা-কাকীদের কেউ-ই এখন আর বেঁচে নেই। যারা আছেন তারাও আমাকে চেনেন না তেমন করে। তবু 'দাদা বাড়ি' না গিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসা যায় না।
সর্দার দাদার কথা মনে পড়ছে খুব গতকাল রাত থেকে.........। কি অসীম ভালবাসায় আগলে রেখেছিলেন তিনি তার গ্রামের সব বাসিন্দাদের। প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নিজের সহায়-সম্পত্তি-জীবন বাজী রেখে তিনি তার অমুসলিম ছেলে-মেয়ে-বউ-নাতি-নাতনি দের বাঁচিয়েছেন। তিনি হিন্দু ছিলেন না, কিন্তু তিনি আমাদের 'দাদা' ছিলেন। তিনি মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তিনি গ্রামের হিন্দু বউটির 'জ্যাঠা শ্বশুর' ছিলেন।
গতকাল থেকে অভয়নগরের জ্বালিয়ে দেয়া আগুনের ছবি দেখছি। আগুন পুড়ছে সব, আগুনের ভয়াবহতা দেখছি। আর বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছি। না, আগুনের ভয়ে নয়। আগুন সামান্য,
'আগুনে আর কতটুকু পুড়ে সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ'। আগুন ভয় পাইয়ে দেয় না, ভয় পাইয়ে দেয়; মানুষ। '
স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এই যে এত মানুষ সর্বস্ব হারায়, এত ঘর-বাড়ি-মন্দির পোড়ে, এদের কি অহিন্দু কোন প্রতিবেশী নেই, এদের কি একজনও অহিন্দু বন্ধু নেই, এই গ্রাম গুলোতে কি কোন চেয়ারম্যান নেই...।
"মানবানল"এ পোড়া আমাদের কি আছে? কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু নেই..., 'খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই'। পুড়ছি আমরা......। 'মানুষ পোড়ালে আর কিছুই রাখে না, কিচ্ছু থাকে না'।
তবু মানুষ, মানুষ খুঁজছি আমি......। সংবাদপত্র পড়ি, বন্ধুদের মেসেজ পড়ি, নিউজ ফিড দেখি। দেখি; -- দাস, --ইসলাম, ---বড়ুয়া, ---গঞ্জালভেস, --সরকার, --ধর, --হক, --রহমান, ---গোমেজ, ---দেওয়ান। আমি হিন্দু পাই, মুসলিম পাই, বৌদ্ধ পাই, খ্রিষ্টান পাই...। তবুও খুঁজি, খোজা শেষ হয়না......। মানুষ দেখি না..., মানুষ পাই না...।
মা বলতেন, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। মানুষের পচনও কি শুরু হয় মাথা থেকে; যে মাথা অধিকার করে নিয়েছে ধর্মানুভুতি আর রাজনীতি। যে রাজনীতি শেখায়, ওরা ভোট দিতে গেছে ওদের পুড়ানো রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ, এভাবেই বিরোধীদের উপযুক্ত রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। সে রাজনীতি কি মানুষকে মানুষ বানায়, না আওয়ামী লীগ-বিএনপি বানায়? যে ধর্ম শেখায় হিন্দু পোড়ালে পাপ হয় না কোন, হিন্দু'র ভগবানকে হেয় করলে, হিন্দুর উপাসনালয় ভাঙলে, হিন্দুর নারীকে ধর্ষণ করলে বেহেশতে যাবার পথটাই শুধু সুগম হয়; সেই ধর্ম মানুষকে মানুষ করে, না হিন্দু-মুসলমান করে? যে রাজনীতি, যে ধর্মানুভুতি প্রতিবেশীকে, বন্ধুকে সর্বস্ব পুড়ে যাওয়া থেকে, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচাতে প্রতিবেশী বা বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে শেখায় না সে রাজনীতি, সে ধর্মানুভুতি যেসব মাথা অধিকার করে নিয়েছে, তাদের কি পচন শুরু হয়নি???
আমি পত্রিকার পাতায় পাতায়, ছবিতে ছবিতে মানুষ খুঁজি...।
খুঁজে পাই শুধু হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান। খুঁজে পাই আওয়ামী লীগ, বিনপি, জামায়াত, সিপিবি...।
আমি বদলে যাচ্ছি..., আমি সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছি..., আমি পচে যাচ্ছি......।
মানুষ পচে গেলে কি হয়, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান......!!!!
__._,_.___