দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি গ্যারি এন লাইয়ের ষড়যন্ত্রমূলক সফর এবং গোপন বৈঠকের ঘটনায় গত ইয়াওমুছ ছুলাছা বা মঙ্গলবার ক্ষুব্ধ জনতা ফুলবাড়ীর এশিয়া এনার্জি অফিস এবং তাদের তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। গত পরশু পত্রিকায় তা ফলাও করে ছাপা হয়েছে। ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এশিয়া এনার্জি। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করে ওই এলাকায় আন্দোলন গড়ে উঠে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট খনিবিরোধী আন্দোলনকারীদের মিছিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালালে তিন কিশোর নিহত হয়। আহত হয় হাজারেরও বেশি লোক। প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে রক্তাক্ত ওই ঘটনার পর খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সে সময়ই ফুলবাড়ী থেকে এশিয়া এনার্জির কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। তবে আট বছর পর গ্যারি এন লাইয়ের গোপন সফরে আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠে স্থানীয় জনতা। কারণ এশিয়া এনার্জির তৎকালীন স্বীকৃত তথ্য অনুযায়ীই খনি বাস্তবায়ন করলে পাঁচ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ চার হাজার ৭৬২ হেক্টর। খনির মেয়াদকালে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ও প্রায় ২০ হাজার স্থাপনা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি হবে আরো অনেক বেশি। ওই ঘটনার পর এলাকায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে। আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে এশিয়া এনার্জি এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এশিয়া এনার্জির একটি সূত্র জানায়, গ্যারি লাই গত ইয়াওমুছ ছুলাছা বা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সস্ত্রীক ফুলবাড়ীতে আসে। শহরের এশিয়া এনার্জির গেস্ট হাউসে উঠে। সে তার লোকজনকে নিয়ে রাতে তিনটি সভা করে। গ্যারি লাইয়ের সভা করার খবর গত পরশু সকালে ফুলবাড়ী পৌর বাজারে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে ভেতরে ভেতরে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকারের নতুন চুক্তি সম্পাদনের কাজও এ লক্ষ্যে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খবর বেরিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে এশিয়া এনার্জির ফাইল; বাকি সব কাজ শেষ। কিছুদিন আগে জানা গেছে, ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়নে এশিয়া এনার্জি সরকারকে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন এ প্রস্তাবে ৬ শতাংশ রয়্যালটি ছাড়াও ১০ শতাংশ 'ইকুইটি শেয়ার' প্রদান এবং নিজস্ব বিনিয়োগে খনিমুখে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা বিবেচনা করে নতুন প্রস্তাবে সরকারকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার টোপ দিয়েছে এশিয়া এনার্জি। সরকার এখনো সম্মতি না জানালেও কোনো বিরোধিতাও করেনি। সরকার এমনিতেই এশিয়া এনার্জিকে দীর্ঘদিন ধরে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের পক্ষ থেকেই এশিয়া এনার্জিকে জনমত গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই পরামর্শ অনুযায়ী এশিয়াটিকের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। এশিয়াটিক বাংলাদেশে কাজ করছে ৪৬ বছর ধরে। এরা অনেক সাম্রাজ্যবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেকগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এবার তারা যুক্ত হলো বহুজাতিক কোম্পানি গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট (জিসিএম), এদেশে এশিয়া এনার্জি নামে পরিচিত বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। এশিয়াটিকের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছে কুখ্যাত পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিদ্বেষী ও তথাকথিত সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বরা। তাদের ৪৬ বছরের অভিজ্ঞতাই প্রচারণামূলক মার্কেটিংয়ের। যার মাধ্যমে জনগণকে দিয়ে পণ্য গলাধঃকরণ করানো হয়। এশিয়াটিকের এসব কুযোগ্যতাকে এখন কাজে লাগাচ্ছে এশিয়া এনার্জি। তথাকথিত সুশীল সমাজের অনেকেই এখানে অপরাধের কিছু দেখে না। তারা মনে করে, একটি কোম্পানি তার নিজের বিনিয়োগে লাভবান হতে নিজের পক্ষে প্রচার চালাতেই পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন বলে আমরা মনে করি। এজেন্সি যখন গণমাধ্যমকে ম্যানেজ করে, যখন গণমাধ্যমে কোনো ধ্বংসাত্মক প্রকল্পকে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে চালানোর জন্য সাক্ষাৎকার, মতামত, বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রকাশ করে কিংবা অন্য কোনোভাবে, পরোক্ষ প্রচারণা চালায়- তখন সেগুলোকে বিশেষজ্ঞ মতামত, বিশ্লেষণ, ওপিনিয়ন হিসেবে চালায়। আবার তথাকথিত সেলিব্রেটি ইমেজ ব্যবহার করে জনগণের মতামত প্রভাবিত করে। কিন্তু এগুলো যে নানাভাবে কোম্পানি স্পনসরড তা গোপন করে। কারণ এটা প্রকাশ পেলে তো এগুলোর ভ্যালু বলে কিছু থাকবে না। ফলে জনগণের পক্ষে বোঝা মুশকিল হয়ে যায় কোনটা বিশেষজ্ঞ মতামত আর কোনটা কোম্পানির পয়সা খাওয়া মতামত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এশিয়া এনার্জির পয়সা খাওয়া লোকজন এশিয়া এনার্জির পক্ষে বক্তব্য দিবে। এশিয়াটিক এটার প্রচার চালাবে 'বিশেষজ্ঞ মত' হিসেবে। এটা ভয়ঙ্কর এক আঘাত। এজন্য জনগণকে এখনই সচেতন হতে হবে। কিছু স্বার্থাণ্বেষী মহল জনগণের ভালো খারাপের দিকে না তাকিয়ে ফুলবাড়ীর প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষের ভাবনা বাদ দিয়ে এশিয়া এনার্জির লাভের ব্যবস্থা করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। সরকার এখানে সঠিক ভূমিকা নিচ্ছে না। সরকারের উচিত ছিল জনরায়ের পক্ষে হাঁটা। জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করা। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও দরকার ছিল দেশের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। রক্তের বিনিময়ে ফুলবাড়ীতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা বাস্তবায়ন না হলে দেশ পড়বে গভীর সঙ্কটে। সরকারকে তাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এক্ষুনি। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য আবার যদি জনগণকে রক্ত ঝরাতে হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী ও গভীর পরিতাপের বিষয়। মূলত, সব সমস্যা সমাধানে চাই সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা তথা সততা। |
__._,_.___