মাত্র কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা শেষ হতে না হতেই ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে তাঁর লাশ গাড়িসহ জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দেশে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে হলেও একটি সরকার আছে। আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এলিট ফোর্স র্যাবও রয়েছে। এর পরও একটার পর একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে গুম, খুন ও অপহরণের দুর্ঘটনা। চলছে লুটপাট, ডাকাতি, শিশু ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনা। গত সপ্তাহের প্রথম দুই দিনেই ১৪টি খুন, তিনটি অপহরণ, একটি নিখোঁজ, দুই শিশু ধর্ষণ, মুক্তিপণের বিনিময়ে এক ব্যবসায়ীকে গুম, এক নারীকে ধর্ষণ করে তাঁর শিশুপুত্রকে হত্যা করা হয়েছে (রাজকূট)। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে বলতে পারেন? ক্ষমতাসীন সরকার কিন্তু এসবের দায়ভার গ্রহণ করে শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে কৃতসংকল্প মনে হয় না। বরং ব্লেম গেমের মাধ্যমে কোনো রকমে কাল কাটাতে চায়। এরও অবশ্য কারণ রয়েছে। উল্লিখিত অপরাধগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীরা জড়িত, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের বেশ কিছু সরকারের প্রতি গভীর আনুগত্যের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যা করা দরকার সময়মতো সে পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি। কেননা তা করলে ক্ষমতাসীনদের সহযোগীদের গায়ে হাত দিতে হতো। এভাবে সরকার চলে না। এভাবে রাষ্ট্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে না। রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো বেঁচে থাকার অধিকার। এই অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রের পক্ষে যে সরকার কাজ করছে তা ব্যর্থ, অযোগ্য, অপদার্থ। ক্ষমতায় থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই সেই সরকারের।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন সবার আগে প্রয়োজন
এই বক্তব্য পেশ করেছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা (International Human Rights Watch-HRW)। এ বছরের ১৫ মে জাতীয় সংবাদপত্র ইনকিলাবে এর বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। শুধু অধিকার হরণের বিবরণই দেওয়া হয়নি, এই রিপোর্টে এইচআরডাব্লিউ (HRW) বাংলাদেশ সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছে, র্যাবের (Rapid Action Battalion-RAB) বিরুদ্ধে সরকার অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বাংলাদেশের জন্য সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। এইচআরডাব্লিউ বলেছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাহিনীটিকে হয় নিষিদ্ধ, না হয় পুনর্গঠন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নয়নের অংশীদার দেশগুলোকে সহযোগিতা স্থগিত করার আহ্বান জানানো হবে। 'বন্দুকযুদ্ধ : বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন' শিরোনামে ৫৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন সংস্থাটি তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে এই এলিট ফোর্স র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অথচ এসব ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে সরকারি এই সংস্থার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। র্যাবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর গভীরে ঢুকে বিস্তৃত পরিসরে তদন্ত করার জন্য একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করতে প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাগাদা দিয়েছে এবং র্যাবকে চিহ্নিত করেছে 'ডেথ স্কোয়াড' (Death Squad) রূপে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত এইচআরডাব্লিউ কর্তৃক 'বিচারক, অপরাধ নির্ধারক এবং জল্লাদ' (Prosectutor, Judge and Executioner) রূপে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর এলিট ফোর্সের হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বর্তমান প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। তা ছাড়া এই প্রতিবেদনে নির্যাতনের শিকার, প্রত্যক্ষদর্শী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় অধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার নথিপত্র রয়েছে বলেও এইচআরডাব্লিউ উল্লেখ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে যে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চালানো বিভিন্ন অভিযানে ২০০ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ এই আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রথমে বিষয়টি বারবার অস্বীকার করেছেন এবং তাঁদের কেউ কেউ র্যাবের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এইচআরডাব্লিউর এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস (Brad Adams) বলেন : আওয়ামী লীগ সরকার র্যাবের হত্যাচর্চা বন্ধ করার জন্য প্রচুর সময় পেয়েছে, তথাপি বাংলাদেশের পথে-ঘাটে একটা খুনিচক্র (Death Squad) ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেও কিছুই করছেন না। এসব বন্ধ করা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও 'বন্দুকযুদ্ধের' হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো একটিরও শাস্তি বিধান করেননি। র্যাবের বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডকে আইনের চাদরে ঢেকে ফেলারই একটি আনুষ্ঠানিক নাম হলো 'বন্দুকযুদ্ধ'।
ব্র্যাড অ্যাডামসের মতে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে র্যাবের জড়িত থাকার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করে আসছিল এইচআরডাব্লিউ। র্যাবকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও এখন দেশে খোলাখুলি আলোচনায় চলে এসেছে। এমনকি বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া, যিনি নিজেই এই সংগঠনটি সৃষ্টি করেছিলেন তিনিও এই বাহিনীকে নিষিদ্ধ করার দাবি উত্থাপন করছেন। অ্যাডামস বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি অনুসরণের যে প্রতিশ্রুতি এত দিন সরকার যেভাবে দিয়ে আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের এটাই সঠিক সময়। গণতন্ত্রে 'ডেথ স্কোয়াড' বা ঘাতক বাহিনীর কোনো জায়গা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, র্যাবকে নিষিদ্ধ করা উচিত। এর পরিবর্তে এমন একটি বাহিনী গঠন করা প্রয়োজন, যা হবে সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক এবং যা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং যা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।
এইচআরডাব্লিউ যাই বলুক না কেন, শুধু র্যাবকে গুম, খুন, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা কি ঠিক? রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটের বিবরণ দিতে গিয়ে Richard Rose বলেন, 'নির্বাচিত ব্যবস্থার সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো ভোটদাতাদের পারস্পরিক আস্থা (The first Prerequisite of elective government is the mutual confidence of the electors.)। আর নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে আস্থা নির্মাণের জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতারা। বাংলাদেশে ভোটদাতাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার আগে রাজনৈতিক নেতাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চাল-চলন, মন-মানসিকতা, তাদের পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের দিকে তাকাতে হবে। তাহলেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন ও অপহরণ কেন ঘটে তা সুষ্ঠুভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়েছে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের মূলটা উপড়ে না ফেলতে পারলে দেশ থেকে এসব অপরাধ দূর হবে না। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নই দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে বিকৃত করে ফেলেছে। এর বিষক্রিয়ায়ই দেশের রাজনীতি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে।
রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটলে সমগ্র সমাজে সৃষ্টি হয় হিংসা-প্রতিহিংসার দূরপণেয় কালিমা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং অবিশ্বাস-অনাস্থার হিংস্র পরিবেশ। দেশের অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত সমাজের একাংশ সীমাহীন ক্ষতির মধ্যে পড়ে। রাজনীতি দুর্বৃত্তের নিয়ন্ত্রণে এলে সমগ্র জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সভ্য জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্তমানে দেশের যেসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া বিদ্যমান রয়েছে, তা দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতে বাধ্য করাও সম্ভব নয়। এগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এসব প্রতিষ্ঠান এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে, যে উদ্দেশ্যে রাজনীতির জন্ম হয়েছে তা অর্জিত হবে না যদি না রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হয়। আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় যেসব সমস্যা হঠাৎ মাথা উঁচু করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে বিঘ্নিত করতে উদ্যত হয় তার সমাধানের জন্যই তো রাজনীতি। সমস্যাটাকে উসকে দেওয়া নয়, ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে, অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টি নিয়ে, পরস্পরকে কাছে টেনে নেওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষাই হলো রাজনীতির অঙ্গীকার। তাই সুষ্ঠু রাজনীতিতে কোথাও মিলবে না সংকীর্ণতা, কোথাও পাওয়া যাবে না স্বার্থপরতা, নীচতা, নোংরামি। এসব জঘন্য ব্যত্যয় যেখানে বাসা বাঁধবে সেখানে আর যা-ই থাক, রাজনীতি অবস্থান করে না। অন্যদিকে রাজনীতি উন্নত স্তরে উপনীত হয় শুধু গণতন্ত্রের সংস্পর্শে এসে। গণতন্ত্র শুধু এক সুষম সামাজিক ব্যবস্থা নয়, ইনসাফ-সিক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাও। গণতন্ত্র হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক অর্জনও। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরশমণির স্পর্শে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি, এমনকি দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্ষমতা অথবা ক্ষমতার ক্লেদ তখন সমাজ পরিবর্তনের মহান দায়িত্বে রূপ লাভ করে। সাম্য-স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্যের মতো সমাজে মহামূল্যবান মণিমুক্তা রূপে যুগে যুগে চিহ্নিত মহান শিল্পরূপে আবির্ভূত হয়।
গণতন্ত্র তাই এত কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালনার জন্য এমন এক নেতৃত্ব দরকার, যা আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো গভীর, সর্বংসহা মাটির মতো সহিষ্ণু।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(কালের কণ্ঠ)