পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ভুট্টোর চরম বিরোধিতা - চক্রান্ত -ষড়যন্ত্র এবং ব্লেক মেলিং এর চেষ্টা:
- অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও অন্যান্য যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসন অচলাবস্থা
- পাকিস্তানে আটকা পড় বাঙালী নির্যাতন ও জিম্মি
যুদ্ধের সময় যে ৪ লক্ষ বাঙালী পাকিস্তানে আটকা পড়ে, পাকিস্তান সরকার তাদেরকে জিম্মি করে বাংলাদেশের বিচার বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করে। প্রায় ১৬ হাজার বাঙালী সরকারী কর্মকর্তা যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকা পড়ে এবং পরবর্তীতে চাকুরিচ্যুত হয়, তাদের পাকিস্তান ত্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অনেক কর্মকর্তাকে ক্যাম্পে আটক রাখার কারনে, বাংলাদেশ সরকার তখন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানায়।
এসময় পাকিস্তান সরকার পলায়নপর বাঙালীদের ধরিয়ে দেবার জন্য মাথাপিছু এক হাজার রুপি পুরষ্কার ঘোষনা করে।
ভুট্টো যে শুধু হুমকিই দিচ্ছেন না, তা প্রমাণের জন্য পাকিস্তান ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর 'বদলি জিম্মি' হিসেবে ২০৩ জন শীর্ষ বাঙালী কর্মকর্তাকে বিচারের জন্য গ্রেফতার করে।
নিরাপরাধ বাঙালির বিচার, ভুট্টোর প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও বাঙালীদের বিচারের হুমকির প্রতিবাদ:
বাংলাদেশ যদি অভিযুক্ত পাকিস্তানীদের বিচার করে, তাহলে ভুট্টো পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশি নাগরিকদের একই রকম ট্রাইবুনালে বিচার করবেন বলে হুমকি দেয়। ১৯৭৩ সালের ২৭শে মে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বলেন--
"(বাঙালীদের) এখানে বিচার করার দাবী জনগন করবে। আমরা জানি বাঙালীরা যুদ্ধের সময় তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনিদির্ষ্ট অভিযোগ আনা হবে। কতজনের বিচার করা হবে, তা আমি বলতে পারছি না"।
ভুট্টো দাবী করেন যে, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানীর সৈন্যদের বিচার করে, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্যু'র মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সরকারের পতন ঘটাবে এবং দুই দেশের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রনের বাইরে নিয়ে যাবে। ভুট্টো দাবী করেন, এই চক্রান্তের জন্য ইতমধ্যেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
ভুট্টোর এ দাবী প্রত্যাখ্যান করে ১৯৭৩ সালের ৭ই জুন এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেন--
"মনবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভোলা সম্ভব নয়, এই হত্যা, ধর্ষণ, লুটের কথা জানতে হবে। যুদ্ধ শেষের মাত্র তিন দিন আগে তারা আমার বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করেছে। তারা প্রায় ২ লক্ষ নারীকে নির্যাতন করেছে-এমনকি ১৩ বছরের মেয়েকেও। আমি এই বিচার প্রতিশোধের জন্য করছি না, আমি এটা করছি মানবতার জন্য"।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বাঙালীদের বিচারের হুমকির প্রতিবাদে বলেন, "এটা অবিশ্বাস্য ও অমানবিক, এই মানুষগুলো ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সরকারী ও সামরিক কর্মকর্তা যারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চায়, এরা কী অপরাধ করেছে? এটা ভুট্টোর কী ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা?"
ভারতের নিরাপত্ত্যা ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও আর্ন্তজাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাবীর মুখে বিচারে অনীহা:
প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানী বন্দীর ভরন-পোষণ এবং নিরাপত্তা বিধান - ভারতের জন্যও একটি সমস্যা হয়ে ওঠে। ইতমধ্যে ভারতের বন্দি শিবিরগুলিতে একাধিকবার বিদ্রহের ঘটনা ঘটে।
এদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচারে চীনের কুটনৈতিক ও সামরিক চাপ ও অনাগ্রহ ভারতের জন্যও সমস্যার কারন হয়ে দাড়ায়। ফলে আর্ন্তজাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাবীর মুখে ভারত দ্রুত পাকিস্তানী বন্দীদের ছেড়ে দেবার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে। এসময় ভারত তার বিচার-বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করে বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয় যে, 'এই বিচার প্রক্রিয়া উপমহাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে'।
ইতমধ্যে চিহ্নিত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বাইরে যেন আর কোন পাকিস্তানী সৈন্যের বিচারে বাংলাদেশ আগ্রহী না হয়, ভারত সেজন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সনের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় বিশেষ কুটনীতিক পি এন হাস্কর যখন ঢাকা সফরে আসেন, তখন ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক 'দি স্টেটসম্যান'-এর এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, "বাংলাদেশকে যে আরো সহনশীলতা ও রাজনৈতিক নমনীয়তা প্রদর্শন করতে হবে, এই কথাটা যেন হাস্কর সাহেব নম্র কিন্তু জোরালো ভাবে বাংলাদেশকে জানিয়ে দেন"
পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক অবস্থান এবং প্রচেষ্টা সবসময়ই ছিল অভিযুক্ত পাকিস্থানী যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিদানের বিপক্ষে, কিন্তু অন্যান্য পাকিস্থানী যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে নয়।
১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশের এই দৃড় অবস্থানের কারণে পাকিস্থান সরকার তার রাজনৈতিক অস্তিত্বের কারণে (সামরিক কুর মাধ্যমে ক্ষমতা চ্যুতি সহ গণ অভ্যুথান ) পাকিস্তান একাধিকবার বাংলাদেশকে এড়িয়ে (যেমন শিমলা বৈঠক) দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা চালায়, যেন ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক ভাবেই বন্দী মুক্তি সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বাধার কারনে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের যুক্তি ছিল যে, ঐসব পাকিস্তানী সৈন্য ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণ করেছে এবং বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া ভারত তাদের মুক্ত করতে পারে না।
জাতিসংঘে চীনের ভেটো
১০ই আগস্ট ১৯৭২ এক সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো বলেন, "বাংলাদেশ ভেবেছে যে আমাদের বন্দীদের মুক্ত করার ব্যপারে তাদের ভেটো ক্ষমতা আছে, কিন্তু ভেটো আমাদের হাতেও একটি আছে"।
পরবর্তীতে ভুট্টো নিশ্চত করেন যে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ভাবেই চীনকে অনুরোধ করেছে যেন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশের আবেদনে চীন ভেটো দেয়। সদ্যস্বাধীন একটি দেশের উন্নয়ন ও বৈদেশিক সহযোগিতা লাভে জাতিসংঘের সদস্যপদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
২৫শে আগস্ট পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশের সদস্যপদের বিপক্ষে চীন নিরাপত্তা পরিষদে তার প্রথম ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে। জাতিসংঘের মতন একটি আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে বঞ্চিত হতে হয় মুলত: একটি বর্বর গনহত্যার বিচার দাবী করার কারনে ।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে অটল থাকে।
পাকিস্তানের বিকল্প প্রস্তাব
এক কিছুর পরেও যখন বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানীর বিচারের বিষয়ে অনড় থাকে, তখন ১৯৭৩-এর এপ্রিলে পাকিস্তান সরকার একটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়। পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স পত্রিকার ১৯৭৩ সালের ১ মে প্রকাশিত এই প্রস্তাবে বলা হয়-
"অভিযুক্ত অপরাধ যেহেতু পাকিস্তানের একটি অংশেই ঘটেছে, সেহেতু পাকিস্তান তার যে কোন যুদ্ধবন্দীর বিচার ঢাকায় অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে। কিন্তু পাকিস্তান নিজে "জুডিশিয়াল ট্রাইব্যুনাল" গঠন করে এসকল ব্যক্তির বিচারে আগ্রহী যা আর্ন্তজাতিক আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে।"
এমতাবস্থায়, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের যদি প্রত্যাবাসন করতেই হয়, তবে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় যেন ওই চুক্তিতে নিশ্চিত করা হয়, সেই ব্যাপারে বাংলাদেশ কুটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং প্রস্তুতি নিতে থাকে। এজন্য বাংলাদেশ ওই চুক্তিতে ভারত হতে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরের আগে অন্তত তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা হয়--
১. বাংলাদেশের নিকট যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানের নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা (দু:খ প্রকাশ নয়);
২. ভবিষ্যতে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ খোলা রাখা; এবং
৩. চীন, সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান যে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারনা অব্যাহত রেখেছে, তার অবসান।
১৯৭৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর, দুই দেশের আটক লোকদের প্রত্যাবাসন শুরু
অবশেষে দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশ-ভারতের 'যুগপৎ প্রত্যাবাসন' প্রস্তাব মেনে নিয়ে পাকিস্তান ২৮শে আগস্ট ১৯৭৩ দিল্লিতে ভারতের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের সম্মতিতে স্বাক্ষরিত এ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অবশেষে পাকিস্তান ও ভারতে প্রায় দুই বছর ধরে আটক 'প্রায়' সকল বাঙালী ও পাকিস্তানী বন্দীর মুক্তি তরান্বিত করে। ১৯৭৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর শুরু এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রথম সপ্তাহেই ১৪৬৮ জন বাঙতবে বাংলাদেশের দাবী ও আপত্তির মুখে ১৯৫ জন অভিযুক্ত পাকিস্তানীকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। দিল্লি চুক্তিতে সীদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে ১৯৫ জন অভিযুক্ত পাকিস্তানীর বিষয়টির নিষ্পত্তি করবে। তবে পাকিস্তানও তার ১৯৫ জন পাকিস্তানীকে ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত দুইশতাধিক বাংলাদেশি নাগরিককে পণবন্দী হিসেবে এই প্রত্যাবাসনের বাইরে রেখে দেয়।
পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অস্বীকৃতি ও স্বীকৃতি নাটকের সমাপ্তি
পাকিস্তানের সম্পদ ও দেনার বন্টনসহ বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অমীমাংসীত বিষয়গুলি নিয়ে মুজিব-ভুট্টো বৈঠকে দুই দেশই আগ্রহ প্রকাশ করে।
তেল ও মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নিয়ে ২২-২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ সনে লাহোরে ইসলামিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের ক্ষণ ধার্য হয়। মুসলিম জনগোষ্ঠীপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অংশগ্রহনে আরব দেশগুলির আগ্রহের প্রেক্ষিতে ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে রাজী হন। কিন্তু স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান হিসেবে আমন্ত্রণ না করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পূর্বাঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর সীদ্ধান্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার তা দৃড় ভাবে প্রত্যাখান করে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শর্ত দেন যে, পাকিস্তানের স্বীকৃতি ব্যতীত কোন আলোচনা হবে না।
অন্যদিকে ভুট্টো শর্তদেন যে, আলোচনার পর স্বীকৃতি দেয়া হবে।
এ বিষয়ে ভারত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাজি করানোর জন্য উদ্যোগী হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, "চীনের ভেটো ব্যবহার করে পাকিস্তান বাংলাদেশকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। ফলে স্বীকৃতির বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্ত হয়েছে। প্রথমে স্বীকৃতি, তারপর আলোচনা।"
১০ই জুলাই ১৯৭৩ সনে পাকিস্তানের সংসদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ভুট্টোকে শর্তসাপেক্ষ ক্ষমতা প্রদান করে।
এদিকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক, যিনি বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় ভুমিকা রাখছিলেন, এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন যে, বাংলাদেশ ১৯৫ পাকিস্তানীর একটি 'সন্তোষজনক' সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে যা পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদানকে সহজ করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বীকৃতির আগে এমন কোন আশ্বাস দেবার কথা প্রত্যাখ্যান করেন।
অবশেষে ইসলামিক সম্মেলনের একদিন আগে সম্মেলনের সাধারন সম্পাদক হাসান তোহামিসহ উচ্চপদস্থ একটি প্রতিনিধিদল ১৯৫ পাকিস্তানীর বিষয়ে শেখ মুজিবকে রাজী করানোর জন্য ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী, সম্মেলনের আগের রাতে, প্রতিনিধিদলটি ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা করেন যেখানে কুয়েত, লেবানন ও সোমালিয়ার তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আলজেরিয়া, সেনেগাল ও প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধিবৃন্দ যোগদেন। এদিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রধান দাতা দেশ হিসেবে পরিচিত মিশর, সৌদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়া অবিলম্বে সমস্যা সমাধানের জন্য উভয় দেশের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে। অবশেষে ২২শে ফেব্রুয়ারী সম্মেলনের শুরুতে লাহোরে অবস্থিত টেলিভিশন স্টুডিওতে দেয়া বক্তৃতায় ভুট্টো বলেন-
"আল্লাহর নামে এবং এদেশের জনগনের পক্ষথেকে আমি ঘোষণা করছি যে, আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি।… আমি বলছি না যে এটি আমি পছন্দ করছি, আমি বলছি না যে আমার হৃদয় আনন্দিত। এটি আমার জন্য একটি আনন্দের দিন নয়, কিন্তু বাস্তবতাকে আমরা বদলাতে পারিনা"
তবে ১৯৫ পাকিস্তানীর বিচার ত্যাগ করার বিষয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এমন কোন দাবী করা থেকে তিনি বিরত থাকেন। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়াই পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হন বঙ্গবন্ধু!
অবশেষে ১০ই এপ্রিল ১৯৭৪ সনে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও শর্ত স্বাপেক্ষে ১৯৫ পাকিস্তানীর যুধ অপরাধীদের পাকিস্থানে প্রত্যাবর্তন:
আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান, ২৪শে মার্চ ১৯৭৪, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের দুই দিন আগে, পাকিস্তানে জিম্মি সর্বশেষ ২০৬ জন বাংলাদেশী নাগরিককে মুক্তি দেয়া হয়।
তবে, পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনাসহ একাধিক কারনে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১৯৫ পাকিস্তানীর যুধ অপরাধীদের প্রত্যাবাসন কিছুদিন আটকে রাখে। সমস্যা সমাধানের সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ১৯৭৪ সনের এপ্রিলে দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের ঘোষনা দেয়া হয়।
৫ই এপ্রিল ১৯৭৪ সনে শুরু হওয়া ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে কামাল হোসেন, আজিজ আহমেদ ও সেরওয়ান সিং যথাক্রমে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ঘোষনা করে যে,
- পাকিস্তান যদি তার একত্তরের কৃতকর্মের জন্য জনসম্মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা করে'
- পাকিস্থানে ১৯৫ পাকিস্তানী যুধ অপরাধীদের বিচার করবে এবং
- বিহারি প্রত্যাবাসনসহ পাকিস্তানের সম্পদ বন্টনে রাজি হয়,
তাহলেই শুধু ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর পাকিস্থানে প্রত্যাবর্তনের ও প্রত্যাবাসন সুযোগ দেওয়া হবে।
পাকিস্তান এই ভাবে সম্মতি জানায় যে, 'সম্পদ বন্টনহলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আর্ন্তজাতিক দেনাও গ্রহন করতে হবে। ভুট্টো অনানুষ্ঠানিক ভাবে একাধিকবার দু:খ প্রকাশ করেছেন, সেহেতু ক্ষমা চাইবার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। তারা পাকিস্তানের প্রচলিত আইনে পাকিস্থানে ১৯৫ পাকিস্তানী যুধ অপরাধীদের বিচার করবে
অবশেষে ১০ই এপ্রিল ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন হয় যার মাধ্যমে ১৯৫ পাকিস্তানী বন্দীর পাকিস্থানে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি মিমাংসা হয়।
পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা:
১১ই এপ্রিল দি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ সংক্রান্ত খবরের শিরনাম ছিল
"বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা" ("Pakistan Offers Apology to Bangladesh")
ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ১৩ ধারায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয় যে-
"পাকিস্তানের ঐসব বন্দী যে মাত্রাতিরিক্ত ও বহুধা অপরাধ করেছে, তা জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনা এবং আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গনহত্যা হিসেবে চিহ্নত; এবং এই ১৯৫ জন পাকিস্তানী বন্দী যে ধরনের অপরাধ করেছে, সেধরনের অপরাধের অপরাধীদের দায়ী করে আইনের মুখোমুখী করার বিষয়ে সার্বজনীন ঐকমত্য রয়েছে"।
পাকিস্তান তার পূর্বের কথা অনুযায়ী অভিযুক্ত আসামীদের নিজ দেশে বিচার করবে এই প্রত্যাশায় বাংলাদেশ 'ক্ষমাসুলভ দৃষ্টকোন' (clemency) থেকে ১৯৫ পাকিস্তানীর বিচার ঢাকাতেই করতে হবে, এমন দাবী থেকে সরে আসে। তবে বাংলাদেশ লিখিত ভাবে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনাও আদায় করে নেয়।
ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ১৪ নং ধারায়ও মন্ত্রীদের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়-
"স্বীকৃতিদানের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে ঘোষনা দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং অতীতের ত্রুটি ভুলে যাবার জন্য আহ্বান করেছেন (appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget)"।
উপসংহার :
ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পর্যালোচনায় এটি নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত যে, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি খুব সহজে হয়নি এবং এবিষয়ে বাংলাদেশের সবোর্চ্চ প্রচেষ্টা ছিল। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন নাজুক ও বিরূপ অর্থানৈত্ক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক পরিস্তিতির মধ্যেও বাংলাদেশে ১৯৭১ এর গনহত্যায়, ধর্ষণ, অগ্নিকান্ড ও লুটপাটে জড়িত স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছিল এবং পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, তখন পাকিস্তানী সরকার অনৈতিক ভাবে --
- পাকিস্থানে আটক নিরীহ বাঙালিদের জিম্মিকরে,
- তাদের দেশী ও বিদেশী দালাল-এজেন্টদের মাধ্যমে বিভিন্ন চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে,
- চীনের ভেটোর মাধ্যমে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত রেখে
- সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও বহুমুখী আর্ন্তজাতিক চাপের মধ্যে বাংলাদেশকে রেখে
৯৫ জন চিহ্নিত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে ভারতীয় বন্দীদশা থেকে তাদের দেশে বিচারের কথা বলে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।
কৌতুহলের বিষয় হলো যে, উনিশশো পচাঁত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনেরেল জিয়ার প্রভাবাধীন সামরিক সরকার ১৯৭৫ এর শেষ দিকে দালাল আইন বাতিল এবং ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে এবং তার পরে অন্যান্য অনেক আইনি এবং সংবিধানিক পরিবর্তন অনলেও - তারা সংবিধানের ৪৭(৩) ধারা অথবা 'আর্ন্তজাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩' বাতিল করেনি— যা 'সহায়ক বাহিনীর সদস্য' অর্থাৎ স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পথ উন্মুক্ত রেখেছে!
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বর্তমান সরকার কিছু সংশোধনী সহ এই আইনের মাধ্যমেই স্থানীয় মানবতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কর্জ চালিয়ে যাচ্ছে!