ফজলুল বারী : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনের দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রতীক্ষার ফসল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, ভণ্ডুল-বিতর্কিত করার জন্য কী করেননি যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী? এ বিচার শুরুর আগে তার কথাবার্তায় ছিল এক সুর, আর বিচার শুরুর পর ছিল আরেক সুর! এখন আরেক সুর! বিচার শুরুর আগে পার্লামেন্টে বিভিন্ন সময় দাঁড়িয়ে বা মিডিয়া ইন্টারভিউতে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেছেন, সরকার এ বিচার করবে না অথবা করতে পারবে না। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, পাকিস্তানের পক্ষে থাকাই অপরাধের—এ কথাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। ভারতীয় অনুপ চেটিয়াদের এদেশে আশ্রয় সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে থাকতে পারেননি, অন্যদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে গিয়ে এই সুযোগটি নষ্ট করতে চান না!
এরপর যখন বিচার শুরু, ধরাধরি শুরু হয়ে গেল তখন বলার চেষ্টা করেছেন সরকার বুদ্ধিমান হলে তার গায়ে দেবে না! তার গায়ে হাত দিলে চট্টগ্রাম উত্তাল হয়ে যাবে ইত্যাদি! কিন্তু সরকার তার ইলেকশন কমিটমেন্ট রক্ষায় যখন সত্যি সত্যি বিচার শুরু করলো, সাকা চৌধুরীকেও ধরলো তখন দেখা গেল চট্টগ্রাম ঘোড়ার ডিম উত্তাল হয়েছে! মাষ্টার দা আর প্রীতিলতার চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধেও অবিস্মরণীয় ভূমিকা সবার জানা। সেই বীর চট্টলা একটা পাকিস্তানপন্থী নৃশংস যুদ্ধাপরাধীর জন্য উত্তাল হবে তা সাকা চৌধুরীর মতো মস্তিষ্কের লোকজনই ভাবতে পারে।
এরপর বিচার শুরুর পর ট্রাইবুন্যালের বিচারপতিদের যা তা ভাষায় কটাক্ষ থেকে শুরু করে কিনা করেছে এই যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী? বিজ্ঞ বিচারকরা বুদ্ধিমান। তার ওসব ধান্ধাবাজিকে তারা আমলে নেননি। ঠাণ্ডা মাথায় বিচার কাজ চালিয়ে গেছেন। এরপর বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিচারের কম্পিউটার কম্পোজকৃত রায় আগে ভাগে ফাঁস করার অপকৌশল নেয় সাকা পরিবার! সব শয়্তানি পরে অবশ্য ধরা পড়েছে। ট্রাইবুন্যালের লোকজনকে কিনে ফেলারও নানান নকশা নেয়! রাষ্ট্রপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ এক আইনজীবীকে বিতর্কিত করার জন্য নেওয়া হয় বিশেষ কৌশল! তাকে এক খ্যাতনামা জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে গয়নগাটি উপহার দেওয়ার ধান্ধা হয়! ওই আইনজীবী প্রস্তাবটি জানান এক গোয়েন্দা সংস্থাকে। গোয়েন্দা সংস্থা প্রথমে তাকে সেখানে যেতে বলে সাকার লোকজনকে হাতেনাতে ধরার জন্যে! পরে আরেক খবরে সিদ্ধান্ত পাল্টানো হয়! সাকার শয়্তানির পরিকল্পনায় আগেভাগে সেখানে একাধিক টিভির লোকজনকে তৈরি রাখা হয়েছিল! পরিকল্পনা ছিল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সেখানে যাওয়ার পর থেকে লাইভ সম্প্রচার শুরু করবে টাকায় রেডি রাখা ওইসব টিভি চ্যানেল!
এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার পর নেওয়া হয় আরেক ধান্ধা! রাষ্ট্রপক্ষের ওই আইনজীবীর কাছে জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে দুই লাখ টাকা ঋণ চান সাকার এক আইনজীবী! অমুক দিনের মধ্যে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়! ঋণ নেবেন নগদে আর ফেরত দেবেন ব্যাংকে! এরপর সেই ব্যাংক ডকুমেন্ট চালান করবেন মিডিয়ায়! ধান্ধামো বুঝতে অসুবিধা হয়নি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর! এভাবে এই বিচার শুরুর প্রথম দিন থেকে বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে হেন শয়তানি নেই যা করেনি সাকা পক্ষ! আমি তো এখানে শুধু এক-দুটি ঘটনা উল্লেখ করেছি। এমন আরও অনেক ঘটনা জানেন ট্রাইবুন্যাল আর অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের লোকজন!
এখন সুপ্রিমকোর্ট অবধি রায় দেওয়া শেষ, আর এখন মনে পড়েছে পাকিস্তানি সাক্ষীর কথা? এখন প্রপাগান্ডার মূল সুর, তিনি একাত্তরে এই তল্লাটেই ছিলেন না! মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকবেন কী করে! এরপর কী বলা হবে কুণ্ডেশ্বরীর নতুন চন্দ্র মারাই যাননি, তিনি পাকিস্তানে আছেন! চিটাগাং এর সেই গুডহিলসের জল্লাদখানা বাড়িতে সাংবাদিক নিজামউদ্দিনসহ অন্যদের টর্চার করা হয়নি! তারা সেখানে হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন! রাউজানের উনসত্তুর পাড়া গ্রামে কোনও বধ্যভূমি নেই! সেগুলো সব মাটির ঢিবি ইত্যাদি!
এখন সাক্ষীকাহিনী একটু বলি। এ বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতেই প্রচার করা হচ্ছিল সাকা একাত্তরে পাকিস্তানে ছিলেন এ মর্মে সাক্ষী দেবেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আর সালমান এফ রহমান! তারা সাক্ষী কেন দেননি জানেন? কারণ, তারাও নিশ্চিত জানেন সাকা পাকিস্তানে গেছেন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে আহত হওয়ার পর। ট্রাইবুন্যালের বিচারে তার অপরাধসমূহ সেই সময়ের আগের। আর এখন বাংলাদেশে আর কোনও সাক্ষী পাওয়া গেলো না, এতবড় দল বিএনপি, খালেদা জিয়ার এক সময়্কার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা, এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির যুদ্ধাপরাধী সদস্য, তার জন্য একজন সাক্ষীও নেই বিএনপিতে? কারণ, বিএনপি যে মুক্তিযোদ্ধাদের দল, তার পাকিস্তানপন্থী নেতার সাক্ষী বিএনপিতে কী করে পাওযা যাবে? মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আবার সাকার রায়ের পর হা-হুতাশ করে বলেছে সাকা সুবিচার পাননি! ভাগ্যিস বলেনি যে সাকাও মুক্তিযোদ্ধা! তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তান সেক্টরে!
অতএব বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী যে এখন পাকিস্তানি সাক্ষী আনার মজমা নিয়েছেন এটা তার ফাঁসি বিলম্বিত করার ধান্ধা ছাড়া আর কিছু নয়। আর তার জান বাঁচানোর শেষ ধান্ধা সাক্ষী বাছাই করা হয়েছে সব পাকিস্তানের! অন্য কোনও নিরপেক্ষ ভেন্যুর নয়। পাকিস্তানি সাকা চৌধুরীর জান বাঁচাতে তার পছন্দের পাকিস্তানি সাক্ষীরা কী সত্য সাক্ষ্য দেবেন? প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের সত্যের নাম একাত্তরের গণহত্যা, তিরিশ লাখ শহীদের প্রাণ, দুই লাখ মা-বোনের আব্রু। এসব সত্য আজ অবধি মেনে নেয়নি পাকিস্তান। সে দেশের লোক কী করে তাদের একাত্তরের সহযোগীর বিচারের সাক্ষী হয়? একটা খবর পড়লাম সাকা ম্যানেজকৃত পাকিস্তানি সাক্ষীদের বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। খবরটি যদি সত্য হয় সরকারের শুভবুদ্ধিকে প্রশংসা করি। বিচার হয়েছে বাংলাদেশের আইনে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। পাকিস্তানিদের সেখানে নাক গলাতে দেওয়ার কোনও দরকার নেই। তারা এমনিতে প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরই নানান মতলবি কাজ কারবার করে। তাদের এখানে কোনও জামিন নেই। কাজেই সুপ্রিমকোর্ট রিভিউ শুনবে কিনা এটি তার এখতিয়ার। বাংলাদেশ আরেকটি ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির অপেক্ষায়। এ নিয়ে যারা গাইগুঁই করবে, পাকিস্তানিদের আসতে দিলে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো জাতীয় বক্তব্য ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাইবে দেশবাসী তাদেরও ফেলবে চাঁদতারা পতাকার সবুজ নিশান—পাকি কর্নারে!
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
*********************************