দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের মতোই সংকটপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ। এ পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, একমাত্র জামায়াত-শিবিরকে দায়ী বলে মনে করেন তারা। ইসলামী ব্যাংকসহ দেশের মৌলবাদী অর্থনীতির যোগানদাতাদের অর্থের উত্স বাজেয়াপ্ত করা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান তারা। অন্যদিকে নির্বাচন বানচালে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও এনজিও ষড়যন্ত্র করছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থনীতি সমিতির উদ্যোগে 'সহিংস রাজনীতি, সঙ্কটে দেশ: ভবিষ্যত্ ভাবনা' শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়। সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাতের সঞ্চালনায় অর্থনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষকসহ সুশীল সমাজের ২৮ জন তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সমপ্রতি সুশীল সমাজের অন্য একটি বৈঠকে দশম জাতীয় নির্বাচন বাতিল কিম্বা পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানানো হয়। অর্থনীতি সমিতির এই বৈঠকে তাদের তীব্র সমালোচনা করা হয়।
পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার আগে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা, দুর্নীতি দমন এবং সহিংসতা বন্ধ করা প্রয়োজন। এসব শর্ত মেনে সমঝোতা সংলাপে যারা আসতে চান কেবল তাদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। বর্তমান সহিংসতার কুফল এখন বুঝতে না পারলেও আগামী দু-এক বছরের মধ্যে বোঝা যাবে। বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে দেশে এই সহিংসতা হচ্ছে। এভাবে সহিংসতা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি কোনোভাবেই হতে দেয়া যায় না। তিনি বলেন, দেশে জঙ্গিবাদের অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। এগুলো এখনই দমন করতে না পারলে ভবিষ্যত্ অন্ধকার।
ড.আবুল বারকাত বলেন, গত বছর দেশে মৌলবাদের অর্থনীতি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা নীট মুনাফা করেছে। গত মাসে দেশের অর্থনীতিতে ১ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামির অধীনে দেশে ১২৫টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। তারা একত্রিত হয়ে আবারো 'অপারেশন ৭১' করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের হাতে একে-ফরটি সেভেনের মত ভয়ঙ্কর অস্ত্র রয়েছে। রকেট লঞ্চার রয়েছে। বর্তমান সমস্যা সমাধানে তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়ে বলেন, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের সাথে কোন অবস্থাতেই সংলাপ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এই শক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান তিনি।
বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল বলেন, দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী নির্বাচন বন্ধ করতে বলছেন একমাত্র জামায়াতকে রক্ষা করার জন্য। যতদিন তাদের রাজনীতি বন্ধ না হবে ততদিন দেশের উন্নয়ন হবে না। দেশের একশ্রেণির এনজিও আছে, যারা বিদেশিদের টাকায় চলে, তারা বলছে নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। দেশের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'সেখানে নির্বাচন বন্ধ করতে হবে এই শিরোনামে কলাম লেখা হয়, সেটি আবার অনুবাদ করেও ছাপা হয়'। তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'তারা কেন লেখেন না যে, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে'। গাইবান্ধার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানকার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা জামায়াতকে পরিত্যাগ করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। তাহলে কেন জাতীয়ভাবে এটা করা হচ্ছে না? দেশের তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'তোমরা দেশের জন্য এগিয়ে এসো। কোন রাজনৈতিক দল করতে হবে না, তোমরা করবে বাংলাদেশ'। তিনি আরো বলেন, আমি সেই বুদ্ধিজীবী হতে চাই না, যারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে'।
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা একটি অন্ধকার জগতে বাস করছি। সমস্যা সমাধানে কোন দিশা দেখছি না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে টিআইবি'র অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। বাংলাদেশে টিআইবিই প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ছিলো সবচেয়ে সোচ্চার। তিনি বলেন, অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে আলোচনার সুযোগ না থাকলেও অভিন্ন ঝুঁকিগুলো নিয়ে দুই দলের আলোচনায় বসা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশের বর্তমান অবস্থা ৭১ সালের থেকে ভিন্ন নয়। বাংলাদেশ এখন ১০টি সন্ত্রাস কবলিত দেশের একটি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি রাজনীতির জন্য নয়, একমাত্র জামায়াত ইসলামের কারণে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. হারুনুর রশীদ বলেন, জাতি হিসেবে আমরা এক সন্ধিক্ষণে এসে গেছি। এর মূল কারণ নির্বাচন নয়, এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা। তিনি বর্তমান সংকট উত্তরণের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা, জামায়াত ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, বিরোধীদের দাবি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হবে। এ দাবি ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি লন্ডনে বসে পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, দেশের সহিংসতার মূল উত্স হল জামায়াত। তারা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র। এই চক্রের মধ্যে রয়েছে মিসরের ব্রাদারহুড, তুরস্কের সরকারি দল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী। তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশে বিশ্বাস করেন, তাদের একত্রিত হয়ে গ্রামে গ্রামে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে সংহতি মঞ্চ তৈরি করুন, এদের রুখে দাঁড়ান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ. আ. ম. স. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সমাধান না করে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা সমীচীন হবে না। তিনি বলেন, যারা আজ দেশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। দেশে সন্ত্রাসের মদদদাতাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মান্নান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি ৭১ সালের মতোই সংকটপূর্ণ। এটা বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার কৌশল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশে জঙ্গিবাদী রাজনীতি চলছে। দেশের ভেতরে তাদের সহায়ক পরিবেশ ছিল বলেই আজ জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান তিনি।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, দেশে এখন একাত্তরের চেতনায় লড়বার সময় এসেছে। দেশের মানুষ যে যেখানে আছেন সেখান থেকে এ আন্দোলন গড়ে তুলুন।
প্রকাশিতব্য জাগরণের সম্পাদক আবেদ খান বলেন, বাংলাদেশ সংকটে নয়, চ্যালেঞ্জে রয়েছে। দেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থান ও তাদের আস্ফাালন। তিনি সমপ্রতি সাতক্ষীরা সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলের রূপক কবর তৈরি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও ভারতের ওপারে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হতো। সেখানকার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির ভাই জামায়াতের আমীর। তার মা হলো জামায়াতের রোকন। তিনি বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হতে পারে যেমন হয়েছেন কাদের সিদ্দিকী, কিন্তু একজন রাজাকার কখনও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর নির্বাচনের বিরোধিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের একমাত্র এজেন্ডা হলো শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো। যদি আরেকটি ৭১ হয় তাহলে আমরা কেউ বাঁচবো না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বেলা'র নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা মৌলবাদের অর্থনীতির কথা বলি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কথা বলি, কিন্তু এগুলো প্রতিরোধের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেই না। রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহমেদুল কবীর তার বক্তব্যে জামায়াতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়ার আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকসহ মৌলবাদের অর্থায়নের উত্সগুলো বন্ধ করে জাতীয়করণের দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, দেশের বুদ্ধিজীবীরা মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকরের চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি দেশে আরেকটি একুশে আগস্ট হয়, যদি শেখ হাসিনার মৃত্যু হয়, তাহলে ১৫ দিনের মধ্যে দেশের অসামপ্রদায়িক শক্তিকে কচুকাটা করা হবে। বাংলাদেশ হবে আরেকটি ইরান।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বর্তমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি মুরগির বাচ্চা ধ্বংস করতে হচ্ছে। ভারত ও ভিয়েতনামে গত বছর তৈরি পোশাক শিল্পে প্রবৃদ্ধি হলেও আমাদের দেশে সহিংস রাজনীতির কারণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মাত্র দুইমাস আগেও দেশের এমন পরিস্থিতি ছিল না।
অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ দেশের ইজারা নিয়েছে। দেশের বর্তমান সংকটের মূল কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিএনপি'র স্বীকার করা উচিত যে, তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল। যে দেশে সুশীল সমাজ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত-সে সমাজে আমলাতন্ত্র নিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, দাতাদের টাকা নিয়ে অনেক এনজিও সরকার বিরোধী জরিপ করে থাকেন। এ জরিপের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার, মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ, সাংবাদিক নঈম নিজাম, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট শাহীন রেজা নূর, সূচিন্তা ফাউন্ডেশনের প্রধান মোহাম্মদ এ আরাফাত বক্তব্য রাখে