২০০১ থেকে ২০০৬ সাল। বাংলাদেশের জন্য এক অন্ধকার সময়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে ভোট কারচুপি করে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভোট কারচুপির হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। নির্বাচনের আগেই বিএনপি জামাতের সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের মদদে প্রায় তিন শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে। মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। সংখ্যালঘু ভোটারসহ নারী ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে না আসে তার জন্য ভয়ভীতি দেখায় বিএনপি জামাত ক্যাডাররা। নির্বাচনের পর পরই শুরু হয় দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সমর্থক আর সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরোচিত হামলা, নির্যাতন। নির্বিশেষে হামলা চালায় অসহায় সহজ সরল মানুষের উপর। হত্যা, ধর্ষন, নির্যাতনে আত্মহারা হয়ে যায় সমগ্র জাতি। শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি বিএনপি-জামাতের হায়েনাদের অত্যাচার, নির্য়াতন থেকে। হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষ বাস্তুভিটা থেকে আশ্রয়হীন অবস্থায় পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী গ্রামে, শহরের মহল্লায়। তারপরও জীবন রক্ষা হয়নি। অনেকে পাঁচ বছর ধরে বাস্তুভিটায় ফিরেও আসতে পারেনি। মানবতার এত বড় অসম্মান এদেশে স্বাধীনতার পর আর কখনও হয়নি। লুণ্ঠিত হয় মানবতা। পাঁচ বছরে ২১ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে বিএনপি জামাতের ক্যাডাররা। ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যা করে অনেক নারী। বিএনপি জামাতের সন্ত্রাসীরা হত্যা করে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এ এস কিবরিয়া, সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাষ্টার সহ অনেককে। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২২ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। অল্পের জন্য রক্ষা পান আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সিলেটে গ্রেনেড হামলা চালানো হয় তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর। ২০০৩ সালের ২৫ আগস্ট খুলনায় হত্যা করা হয় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমামকে। দিনেদুপুরে আদালতে পেশাগত কাজে যাওয়ার পথে ঘাতকের বোমা এবং পিস্তলের গুলিতে এ্যাডভোকেট ইমামকে হত্যা করা হয়। তাঁর সঙ্গে নিহত হন এক নিরপরাধ রিকশাচালকও। ২০০৩ সালের ৭ জুন বিএনপি সন্ত্রাসীদের চাইনিজ কুরালের উপর্যুপরি আঘাতে নিহত হন নাটোরের জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। একই বছর ১ ডিসেম্বর লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, টানা পাঁচ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সামসুল ইসলামকে সন্ত্রাসীরা জবাই করে হত্যা করে । ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনায় হত্যা করা হয় সদালাপী, সৎপ্রাণ, জনপ্রিয় সাংবাদিক মানিক সাহাকে। মানিক সাহা ছিলেন দৈনিক সংবাদ এবং ডেইলি নিউজের খুলনা প্রতিনিধি। বিবিসি'র খুলনা প্রতিনিধিও ছিলেন মানিক সাহা। প্রেসক্লাব থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাথায় বোমা মেরে নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মানিক সাহাকে যাঁরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে চিনতেন তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি কিভাবে এমন সজ্জন, নির্লোভ, পেশাঅন্তপ্রাণ একজন সমাজদরদী ও দেশপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে ঐভাবে নৃশংসতার বলি হতে হলো। মানিকের অপরাধ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী থেকে দেশ ও মানুষের ভালর জন্য কাজ করতেন। তার মানে বিএনপি-জামাত জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, যা তারা এখনও চায়। নইলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে একের পর এক বক্তৃতা-বিবৃতি এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালায় কি করে। ২০০১-০৬ সালের শাসনামলে আরেক বরেণ্য শিক্ষককে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করার কথাও মনে পড়ছে। সেই শিক্ষকের নাম প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় নিজ বাড়ির বাইরে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত-শিবিরের নেতৃস্থানীয় সন্ত্রাসীরা। প্রফেসর ইউনুস ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। অধ্যাপনার বাইরে তিনি বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। এটাই ছিল তৎকালীন শাসকদের কাছে অপছন্দের কারণ। বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরীর । ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর জামাত-শিবির সন্ত্রাসীরা তাঁকে নিজ বাড়িতে মাথায় গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। হত্যার পর দেশে ও বিদেশের ক'টি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল অধ্যক্ষ মুহুরীর নিষ্প্রাণহৃদয় ব্যথিত করা এক অটোগ্রাফ। সাদা জামায় রক্তের বন্যা, মাথার খুলি থেঁতলে গেছে সন্ত্রাসীর গুলিতে এবং সেখান থেকে ঝরছে রক্ত! না, সে বীভৎস দৃশ্যের বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। দুঃশাসনের কালে একজন নিরীহ শিক্ষাবিদেরও জীবনের নিরাপত্তা ছিল না। নিরাপত্তা ছিল না বিচারপতি কিংবা শুভবাদী সাংবাদিকদের। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নেমে আসে দুর্বিষহ বিপর্যয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, ছিনতাই, রাহাজানীতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে পুরো জাতি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত মৌলবাদী জঙ্গীরা সারাদেশে ৬৩ জেলা ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায়। আফগানিস্থানে আল-কায়েদার পক্ষে যুদ্ধ করা জঙ্গীরা সরকারের মদদে গড়ে সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন, জেএমবি। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমীর জমজমাট বইমেলা থেকে সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদ। অতর্কিতে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মদদপুষ্ট জেএমবি ক্যাডার আতাউর রহমান সানীর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী। হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রোশের কারণ মৌলবাদ বিরোধী বই লেখা এবং তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং আক্রমণের পেছনে মূল নেতৃত্বদানকারী কুখ্যাত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এ রকম অসংখ্য নৃশংসতার রক্তমাখা স্মৃতি যখনই মনে পড়ে তখনই শিউরে উঠতে হয়। শিউরে উঠতে হয় এই ভেবে যে, যাদের হাতে রয়েছে রক্তের দাগ, যাদের ভাবনায় রয়েছে বর্বর অত্যচারে দেশ শাসনের খায়েশ। তারা কিভাবে মানুষের সমর্থন পাবে! মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা কোন কিছুই তাদের দখলের তালিকার বাইরে ছিলোনা। ভেঙ্গে পড়েছিলো সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা। সরকারের নির্লজ্জ দলীয়করণ, দুর্নীতি, লুটপাট, অদক্ষতা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি জামাত জোট চক্রের অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, দুর্নীতি, হত্যা, রাহাজানী, ধর্ষন, শিক্ষা ব্যাবস্থার বিপর্যয়, কৃষি বিপর্যয়, বিদ্যুৎ বিপর্যয় ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে তৎকালীন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে আমাদের এই এ্যালবাম "ফিরে দেখা সেই দুঃসময়"। এই ছবিগুলোর চেয়েও বীভৎস ও ভয়াবহ ছিলো সেই সময়ের অত্যাচার, নির্যাতন। বাংলাদেশের মানুষ আজো ভুলেনি সেই অত্যাচার নির্যাতনের কালো দিনগুলোর কথা। কৃতজ্ঞতা: পীযুষ বন্দোপধ্যায় (বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব), জাগ্রত সৈনিক (অনলাইন এ্যাক্টিভিষ্ট)। তথ্যসুত্র: www.albd.org
By: নৌকায় ভোট দিন
Photos: 401
__._,_.___