অনেক দিন আগের কথা, তখন ফেসবুক ছিল না, এত এত টেলিভিশন ছিল না, একজন দাপুটে রাজনীতিবিদকে চিনতাম, যিনি সবসময় আলোচনায় থাকতে পছন্দ করতেন, পত্রিকার হেডলাইন হতে চাইতেন। ইতিবাচক বা নেতিবাচক―যে কোনোভাবে। তার সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো খবর না থাকলে তিনি একটা অঘটন ঘটিয়ে বসতেন। পরদিন তাকে নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হতো। তাতে তিনি হয়ে উঠতেন টক অব দ্য টাউন। কখনো কখনো টক অব দ্য কান্ট্রি।
ফরহাদ মজহারও তেমন একজন ব্যক্তি, যিনি সবসময় আলোচনায় থাকতে ভালোবাসেন। আলোচনায় না থাকলে তার উসখুস লাগে, একঘেঁয়েমি লাগে। কারণ তার রক্তের ভেতরে উচ্চাভিলাষ, তার রক্তের ভেতরে 'মহান' হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তার কবিতার বই 'এবাদতনামা' পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব, সারাদেশে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার অন্যতম ইন্ধনদাতা, হাওয়া ভবনের একচ্ছত্র অধিপতি তারেক রহমানের সঙ্গে তার খাতির ছিল। এখনো আছে। তারেক যখন ক্ষমতাধিপতি তখন তারেককে তিনি তার প্রজেক্ট দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এসব জেনেও শুধু 'এবাদতনামা'র মুগ্ধতার জন্য তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। পরে আমার 'গুনীজন কহেন' বইতেও সাক্ষাৎকারটি অন্তর্ভুক্ত করি। কিন্তু ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সৃষ্ট গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে তিনি যখন জঘন্য মিথ্যাচার (সমালোচনা নয়) শুরু করলেন, দৈনিক 'আমার দেশ' সম্পাদক কুখ্যাত মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর পাঁয়তারা করলেন, তখন তাকে ঘৃণা ভরে ফেসবুক থেকে ঘোষণা দিয়ে আনফ্রেন্ড করি।
এই ফরহাদ মজহার বলেছিলেন, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অফিসে বোমা হামলা করা উচিত। জঙ্গি বোমা হামলাকারীদের পক্ষ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'বোমা হামলাকারীরা সন্ত্রাসী হলে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী।' এই ফরহাদ মজহার নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরিরের তাত্ত্বিক গুরু―এটা ওপেন সিক্রেট। এই ফরহাদ মজহার যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামকেই ইসলামের একমাত্র রক্ষক এবং বিশুদ্ধ ইসলামি দল বলে দাবি করেন। শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের পাণ্ডাদের তাণ্ডবের সময় তিনি দিগন্ত টেলিভিশনের অফিসে বসে শহরের বৃক্ষনিধন ও জ্বালাও-পোড়াওর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এসব তিনি কেন করলেন? আমার এক বড়ভাই প্রায়ই আমাকে বলেন, ফরহাদ মজহারের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ রয়েছে। যে কোনো প্রকারে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যেতে চান। সেই ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হোক, বিএনপির হোক, জামায়াতের হোক, হেফাজতের হোক, হিযবুত তাহরির বা জেএমবির হোক। তার ক্ষমতা চাই। ক্ষমতা ছাড়া তিনি স্বস্তি পাবেন না।
বস্তুত ২০১৩ সালের পর থেকে তিনি একজন পতিত বুদ্ধিজীবী। কোনোভাবেই তিনি আর আলোচনায় আসতে পারেন না। কেউ তাকে পাত্তা-টাত্তা দেয় না। টক শো-গুলোতে তাকে ডাকে না। কিন্তু তার চাই প্রচার। যে-কোনোভাবেই তিনি আলোচনায় থাকতে চান। সেজন্য আজ তিনি একটি ব্যার্থ 'অপহরণ নাটক' সাজালেন। কীভাবে নাটক? ভোর চারটায় তিনি বাসা থেকে বেরোলেন। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যাচ্ছে তিনি একাই বাসা থেকে বেরোচ্ছেন। এত ভোরে বাসা থেকে বেরোবার কারণ কী? তার হাতে তখন কম দামি একটি মোবাইল। যে স্মার্টফোনটি তিনি ব্যবহার করেন তা নিলেন না। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পাঁচবার তিনি তার জীবনসঙ্গিনী ফরিদা আখতারকে (কথিত আছে, ফরিদা আখতার তার বিবাহিত স্ত্রী নন। বিবাহিত হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। এটা তার ইচ্ছার ব্যাপার) পাঁচবার ফোন দেন। প্রথমে বলেন ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের কথা, নইলে অপহরণকারীরা তাকে মেরে ফেলবে। পরে কমতে কমতে ১৫ লাখে এসে ঠেকল। 'অপহরণকারীরা' এতই বেকুব যে, 'অপহৃত'র মোবাইলটি বন্ধ করার কথা তাদের খেয়ালে ছিল না। খেয়ালে ছিল না মোবাইল যে পুলিশ ট্র্যাক করতে পারে। এত বড় আহাম্মক 'অপহরণকারীরা!'
রাত আটটার দিকে তাকে দেখা গেল খুলনার 'নিউ গ্রীল হাউস' রেস্তোরাঁয়। ভাত, ডাল, সবজি খেলেন ঐ রেস্তোরাঁয়। সাড়ে আটটার দিকে খুলনার শিববাড়ী মোড় থেকে হানিফ পরিবহণের একটি বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। পুলিশ-র্যাব তাকে খুঁজতে থাকে। সরকার ও বুদ্ধিজীবী মহল তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত। যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়ায় হঠাৎ বাসটি দাঁড়িয়ে পড়ল। যাত্রীরা হৈচৈ করতে থাকে ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের সঙ্গে। কেন থেমে আছে বিনা কারণে? ড্রাইভার-কন্ডাক্টর মুখ খোলে না। নিশ্চুপ। দাঁড়িয়ে থাকল আধা ঘণ্টা। হঠাৎ র্যাবের গাড়ি এসে হাজির। ঐ বাসের পেছনের সিট থেকে ফরহাদ মজহারকে ধরে নিচে নামানো হলো। নিয়ে যাওয়া হলো অভয়নগর থানায়।
আচ্ছা, ধরে নিলাম তাকে অপহরণ করে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু যখন তিনি খুলনার 'নিউ গ্রীল হাউস' রেস্তোরাঁয় ভাত খাচ্ছিলেন তখন কি তার 'স্ত্রী' ফরিদা আখতারকে একটা ফোন করে বলতে পারতেন না, 'আমি সুস্থ আছি, একটু পর বাসে উঠব, তুমি চিন্তা করো না।' তিনি বাসে উঠলেন। বাসে উঠেও কি ফরিদা আখতারকে একটা কল দিয়ে বলতে পারতেন না, 'আমি ঢাকায় ফিরছি, তুমি চিন্তা করো না, সবাইকে বলো চিন্তা না করতে।' ধরা যাক তার মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না। কিন্তু তিনি কি অন্য কারো মোবাইল থেকে ফরিদা আখতারকে একটা কল করতে পারতেন না? অন্তত যাত্রীদের উদ্দেশে তো চিৎকার করে বলতে পারতেন, 'আমি কবি ফরহাদ মজহার। আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল।' তা না করে কেন তিনি চোরের মতো ঘাপটি মেরে বাসের পেছনের সিটে বসে থাকলেন?
তিনি যে আলোচনায় আসার জন্য আজ একটা নাটকের মহড়া দিলেন তা বোঝার জন্য গোয়েন্দা হওয়া লাগে না, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ঠ। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি অসংখ্য তরুণকে বিভ্রান্ত করেছেন, এখনো করে চলেছেন। অত্যন্ত অসহিষ্ণু একজন মানুষ। পরমত সহ্যই করতে পারেন না। শেষ বয়সে এসে পুরো জাতিকে তিনি বিভ্রান্ত করলেন। বিগত জীবনে তিনি যেসব ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন, তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার মনে হয় একটু জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত কেন তিনি এই নাটক করলেন? কোন উদ্দেশ্যে? প্রকৃত সত্য উদঘাটন হওয়া জরুরি। নইলে এই ভদ্রলোক ভবিষ্যতে আলোচনায় আসার জন্য বড় কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তার আবার অমরত্বেরও লোভ আছে। অমরত্ব পেতে যে কোনো কিছু করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।