মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে দেওয়া রায়ের খসড়া ফাঁস হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই কর্মচারীর নাম নয়ন আলী (২২)। তিনি ট্রাইব্যুনালের দৈনিক হাজিরাভিত্তিক (মাস্টার রোল) পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার নয়নসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সাকার আইনজীবী ফখরুল ইসলামের সহকারী মেহেদী হাসান ও মো. ফারুক নামে আইসিটির আরেক কর্মচারী মামলার আসামি।
ডিবি জানায়, অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ও প্ররোচনার ফাঁদে ফেলে নয়নের মাধ্যমে রায়ের খসড়াটি ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে নিয়েছেন মেহেদী হাসান। মেহেদী আর নয়নের মধ্যস্থতাকারী হচ্ছেন ফারুক। তবে কত টাকা লেনদেন হয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে, গতকাল বেলা দুইটার দিকে কাকরাইলের পাইওনিয়ার রোডে সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলামের কার্যালয়ে অভিযান চালায় ডিবি। সেখান থেকে তাঁরা দুটি সিপিইউ, একটি প্রিন্টার এবং অন্তত ৫০টি সিডি জব্দ করে।
গত মঙ্গলবার বিএনপির নেতা সাকা চৌধুরীর মামলার রায়ের দিন তিনি ও তাঁর পরিবার অভিযোগ তোলেন, ওই রায়ের কপি আগের দিনই একটি ওয়েবসাইটে পেয়েছেন তাঁরা। এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার নাসির উদ্দিন মাহমুদ বুধবার শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে রায়ের খসড়া ফাঁস হয়ে থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, রায়ের খসড়া ফাঁসের ঘটনায় নয়নসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় নয়নকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি দুজন পলাতক। ওই দুজনের নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
তবে ডিবির সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানায়, বাকি দুজন হচ্ছেন মেহেদী হাসান ও মো. ফারুক।
মনিরুল বলেন, গ্রেপ্তার নয়ন আইসিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এক আইনজীবীর সহকারীর অর্থের প্রলোভন ও প্ররোচনায় তিনি রায় লেখার কম্পিউটার থেকে খসড়াটি পেনড্রাইভের সাহায্যে নিয়ে ওই আইন-জীবীকে দেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নয়ন বলেছেন, ওই আইনজীবীর সহকারী তাঁকে বলেছিলেন, আদালতে পিটিশনের জন্য কয়েকটি তারিখ প্রয়োজন। তাই রায় লেখার কম্পিউটার থেকে কিছু তথ্য তাঁকে এনে দিতে হবে। নয়ন দেখেন, ওই কম্পিউটারে একটি রায় লেখা হচ্ছে। তারপর তিনি বিভিন্ন সময়ে রায়ের খসড়া পেনড্রাইভে নিয়ে নেন এবং ওই আইনজীবীর সহকারীকে দেন।
মনিরুল বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, পেনড্রাইভে থাকা খসড়া রায়ের কপি দেওয়ার সময় এটি মামলার রায় বলে নয়ন একটু বেঁকেও বসেছিলেন। কিন্তু ওই আইনজীবীর সহকারী তাঁকে বলেন, 'তুমি ফেঁসে গেছ। চুপচাপ থাকো। তুমি টাকা পাবে।'
মনিরুল বলেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই আইনজীবীর সহকারী রায়ের খসড়াটি পাওয়ার পর তা দেশের বাইরে কোনো একজনের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে পিডিএফ ফাইল করে তা ইন্টারনেটে ফাঁস করা হয়েছে। দেশের বাইরের যে কম্পিউটার থেকে এটি করা হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে সেখানে বাংলা ফন্ট নেই। কারণ, মূল রায়ের বিভিন্ন অংশে বাংলা লেখা আছে। কিন্তু ফাঁস হওয়া খসড়ার বাংলা লেখাগুলো ইংরেজি অক্ষরে এসে ভেঙে গেছে বা দুর্বোধ্য হয়ে গেছে।
মনিরুল বলেন, এ ঘটনার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ইতিমধ্যে শাহবাগ থানায় নয়নসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় নয়নকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বাকি দুজন পলাতক। শনিবার (আজ) তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড চাওয়া হবে। রিমান্ডে এনে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার সঙ্গে বাকি জড়িতদের পরিচয় ও লেনদেনের পরিমাণ সম্পর্কে জানা যাবে।
'এক আইনজীবীর সহকারীর কথা বলছেন, আবার সাকা চৌধুরীর আইনজীবীর কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছেন—এ দুয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, 'হ্যাঁ, আছে। তাঁর একজন সহকারীর মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটেছে।'
সাকার আইনজীবীর কার্যালয়ে সহকারী আইনজীবী আছেন চারজন। তাঁদের কেউ কি না, এ প্রশ্ন করলে মনিরুল বলেন, 'হ্যাঁ, এ চারজনের মধ্যে একজন।'
'সাকার পরিবার জড়িত কি না' জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, 'তদন্ত চলছে।' তবে ওই সহকারীর পরিচয় এবং মামলার বাকি দুই আসামি সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
ট্রাইব্যুনাল ও ডিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দেড় বছর আগে ট্রাইব্যুনালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ পান নয়ন। কাজ করলে দৈনিক ১২০ টাকা করে বেতনের ভিত্তিতে এ নিয়োগ দেওয়া হয়। নয়ন ট্রাইব্যুনালের নিচে একটি কক্ষে থাকতেন। তাঁর কম্পিউটারে দক্ষতা থাকায় ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন চিঠিপত্রও লিখতেন তিনি। সেই হিসেবে ট্রাইব্যুনালের যেখানে রায় লেখা হয়, সেখানে তাঁর অবাধ যাতায়াতও ছিল। বিশেষ করে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের কক্ষেও তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল।
অন্যদিকে, মো. ফারুক নামের ট্রাইব্যুনালের একজন সাঁট মুদ্রাক্ষরিক (স্টেনোগ্রাফার) ওই আইনজীবীর সহকারীর সঙ্গে নয়নের পরিচয় করিয়ে দেন। ফারুককেও মামলার আসামি করা হয়েছে। ফারুক মূলত ঢাকা সিএমএম কোর্টের একজন কর্মচারী। প্রায় এক বছর ধরে তিনি ট্রাইব্যুনালে কাজ করছিলেন। ফারুক ও মেহেদী হাসানকে ধরার চেষ্টা চলছে বলে জানায় ডিবি।
এদিকে, আটক থাকা অবস্থায় কথা হয় নয়ন আলীর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মেহেদী হাসানই তাঁকে ওই কম্পিউটার থেকে তথ্য আনতে বলেছিলেন।
ডিবি কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, এ ঘটনার তদন্ত করতে নেমে ডিবি ট্রাইবুনালের যেখানে রায় লেখা হয় সেখানে সরেজমিন অনুসন্ধান, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ, কয়েকজনের উপর নজরদারিসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে ঘটনা ও ঘটনা সম্পর্কে জড়িতদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর নয়নসহ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে নয়ন এ ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন।
গতকাল নিজের কার্যালয়ে অভিযানের পর বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে ফোনে যোগাযোগ করা হয় ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। প্রথমআলোকে তিনি সে সময় বলেন, 'তল্লাশির সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। তবে আমাকে অবহিত না করে এবং কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া এভাবে তল্লাশি চালানো ঠিক হয়নি। এটা যদি রাজনীতি হয়, তো রাজনীতি। এখন দেখব এতে কোনো আইনগত দিক আছে কি না। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
তবে পুলিশের ব্রিফিংয়ের পর ফখরুলের সহকারীর নাম আসা প্রসঙ্গে জানতে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাঁর ফোন বন্ধ ছিল।
তবে মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তল্লাশী পরোয়ানা নিয়েই ফখরুল ইসলামের কার্যালয়ে তল্লাশী চালানো হয়েছে।
মির্জা ফখরুলের নিন্দা: ফখরুলের কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোয় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামের কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশি দুরভিসন্ধিমূলক ও অন্ধ হিংসার বহিঃপ্রকাশ।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/53083/অর্থের_লোভ_দেখিয়ে_রায়ের_খসড়া_চুরি
†hfv‡e duvm nq mvKvi ivq (wfwWI)
Watch the video:
http://www.youtube.com/watch?v=QOIoUehCSp8&feature=youtube_gdata