একের পর এক হত্যা: স্বজনদের ক্ষোভ
বিচার–প্রক্রিয়ায় আস্থা নেই
প্রথম আলো: ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার তো বললেন, অভিজিৎ রায় ও ফয়সল আরেফিন দীপনের খুনিদের দু-একজন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে...
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বিচার-প্রক্রিয়ায় আমার আস্থা নেই। শুধু অনাস্থা আছে। আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য বিচার করা দরকার, সেটা সরকারের কর্তব্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি হিংসা-প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। বিচারে কারও কারও ফাঁসি হলে, কারাদণ্ড হলে আমি কি দীপনকে ফিরে পাব? দীপনের কি তাতে কোনো উপকার হবে? যে রাজনীতির কারণে দীপন-অভিজিৎসহ আরও কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে, আমি সেই রাজনীতির অবসান চাই। এক হাতে তালি বাজে না। আমি চাই সকল মহলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
প্রথম আলো: কিন্তু সন্দেহভাজনদের নজরদারিতে রাখতে তো পুলিশ ব্যর্থ হলো।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এ নিয়ে অনেকে অনেক সমালোচনা করেছেন। আমি আর বলতে চাই না। প্রথম প্রথম পুলিশ খোঁজখবর করত। এখন আর করে না। বেশ কিছুদিন আমার বাড়ির সামনেও পুলিশ বসে থাকত। আমি চলে যেতে বলেছি। আসলে কেবল পুলিশের ওপর নির্ভর করে, পুলিশকে নিন্দা করে সুফল হবে না। সরকার এবং আরও অনেকে এই হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে কথা বলছেন। এটা স্পষ্ট যে, এই হত্যাকাণ্ডগুলো বৃহৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। এগুলোকে সাধারণ অপরাধমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করা ঠিক না। এর পেছনে আদর্শগত, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক কারণ আছে। হঠাৎ করে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। সবদিকেই অনুসন্ধান করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী তাঁর এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, মুক্তবুদ্ধির নামে পর্নো ঠিক নয়। তিনি আরও বলেছেন, মুক্তবুদ্ধির নামে মহানবী (সা.) ও ইসলাম সম্পর্কে নোংরা চিন্তা অনুমোদনযোগ্য নয়। এই কথাটা সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য। আমি নিজে ১৯৮১ সাল থেকে এই কথাটা বলে আসছি। যদিও আমি পর্নোগ্রাফি এবং নোংরা এই শব্দগুলো প্রয়োগ করিনি। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আগাগোড়াই বিতর্ক আছে। সেই বিতর্কের ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে যুক্ত হয়েছে। আমি মনে করি, জঙ্গিবাদ রুখতে এখনই সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম—এ দুটো কথাই বাদ দেওয়া দরকার। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে আন্তর্জাতিক কারণও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: বুঝিয়ে বলবেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় কী হয়েছে? কী হচ্ছে? আফগানিস্তানে রুশদের বিরুদ্ধে তালেবানদের উত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠন তৈরি হয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু দেশে ইসলামের নামে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ। এর ফলে তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস বাংলাদেশ ও ভারতকে তাদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই বাস্তবতার মধ্যে পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে আমাদের সমাধানের পথ ভাবতে হবে।
প্রথম আলো: সমাধানটা কী হতে পারে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: মৌলবাদ তো আমাদের দেশের সঙ্গে যায় না। এই ধারণা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা একই সুরে কথা বললে সমস্যা বাড়বে, কমবে না। সমস্যার সমাধান করতে হবে জনগণকে নিয়ে। গণঐক্য দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মতৈক্য এখন খুব দরকার। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারণাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। আর মাঝে মাঝে বিরাজনৈতিকীকরণের যে চেষ্টা, সেটাও মঙ্গলজনক নয়।
প্রথম আলো: অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনারা কেমন আছেন? জাগৃতির (প্রকাশনা সংস্থা) কী অবস্থা?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: দীপন বন্ধু-অন্তঃপ্রাণ ছিল। কত যে বন্ধু ছিল ওর। জাগৃতিটাও বেশ নাম করেছিল। ওর স্ত্রী রাজিয়া রহমান তো চিকিৎসক। আগে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখত। এখন আর দেখে না। জাগৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমি বলেছি, আমার এই বয়সে পেছন থেকে যতটা সহযোগিতা করা সম্ভব, আমি করব।
প্রথম আলো: ফয়সল আরেফিন দীপন যেদিন খুন হলেন, তার পরদিন তো তাঁর ছেলে রিদাত ফারহানের জেএসসি পরীক্ষা ছিল।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: হ্যাঁ। ও এখন উদয়ন বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। দীপনের মেয়ে রিদমা আদনান সপ্তম শ্রেণিতে। রিদমার বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বাচ্চা দুটো এত বিমর্ষ হয়ে থাকে। পুলিশ দীপনের কিছু জিনিসপত্র নিজেদের কাছে রেখেছিল। আমি চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। ফেরত দিয়ে গেছে। দীপনের মাকে দেখলাম, সেদিন ওই জিনিসগুলো আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। কী বলব! আমি নিজেকে সংযত রেখে শুধু এটুকুই বলতে চাই, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
আবুল কাসেম ফজলুল হক
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন...
একের পর এক হত্যা: স্বজনদের ক্ষোভ
খুনি ধরার ইচ্ছে নেই, সক্ষমতাও নেই
যেভাবে নিহত হলেন লেখক অভিজিৎ রায়
https://www.youtube.com/watch?v=mxiGv5UVX6A
__._,_.___