অঅ-অ+ |
একসময় তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এমপি হয়েছেন ঠাকুরগাঁও-২ আসন থেকে। আর এমপি হয়েই ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখলে নেমেছেন দবিরুল ইসলাম। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রায় ১০০ একর জমি দখলের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। উচ্ছেদ করেছেন অসহায় পরিবারগুলোকে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুলের ভয়ে এখন মুখ খুলতেও নারাজ অনেক ভুক্তভোগী। শুধু জমি অবৈধভাবে দখলই নয়, নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এমপি দবিরুল অন্তত ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদও দখলে নিয়েছেন। যদিও একজন এমপি আইনত সর্বোচ্চ চারটি প্রতিষ্ঠানে সভাপতি থাকতে পারেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। জমি ফেরত চাওয়ায় সম্প্রতি এমপির লোকজনের হামলার শিকার হন কয়েকজন।সরেজমিনে উপজেলার বৈউরঝাড়ি এলাকায় গিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে ওই এলাকায় ১০৭ একর জমি তারানাথ রায় চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি ভোগদখল করে আসছিলেন। তিনি ১৯৬৮ সালে পরিবার নিয়ে ভারতে চলে যান। ফলে এ জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, এরপর স্থানীয় টিপু চেয়ারম্যান ও শতাধিক হিন্দু পরিবার তা ভোগদখল করে আসছিল। টিপু চেয়ারম্যান ঠাকুরগাঁও চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হাবিবুর রহমান বাবলুর কাছে কিছু জমি বায়নানামা করেন। হাবিবুর রহমান বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রশাসনের মাধ্যমে ওই জমি দখল করতে গেলে স্থানীয়দের বাধায় ফেরত আসেন। তিনি এ ঘটনায় কয়েকটি হিন্দু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কয়েক বছর মামলা চলার পরও তিনি জমি দখল করতে পারেননি। মামলা থেকে খালাস পান অভিযুক্তরা। কিন্তু এ জমিতে এমপি দবিরুলের চোখ পড়ে। তার লোকজন ১০৭ একর জমির মধ্যে ৯৬ একর দখল করে হিন্দু পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে। এমপির ভয়ে তারা মামলা করেননি বলে জানান। বৈউরঝাড়ি পালপাড়া এলাকার হৃদয় বলেন, 'তারানাথ চৌধুরী ভারতে যাওয়ার পর আমরা এ জমি আবাদ করে আসছিলাম। হঠাৎ এমপির লোকজন জমি দখলে নেয়। তারপর থেকে আমরা আর জমি আবাদ করতে পারি না।' মলিন চন্দ্র পাল বলেন, 'লিজ নিয়ে এ জমি ভোগ করে আসছিলাম। কিন্তু এমপির লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের উচ্ছেদ করেছে।' জানা যায়, কয়েক বছর আগে পাড়িয়া ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় ভারত সীমান্ত লাগোয়া স্থানে 'রনবাগ ইসলামী টি এস্টেট কোম্পানি' নামে একটি চা-বাগান গড়ে তোলেন দবিরুল ইসলাম। প্রায় ২৬৫ বিঘা আয়তনের বাগানের ভিতর ও আশপাশে কয়েকটি হিন্দু পরিবারের জমি। এর মধ্যে অকুল চন্দ্র সিং পরিবারের ২১ বিঘা, ভাকারাম সিং ও চন্দ্র সিংয়ের ২৭ বিঘা, থোনারাম সিংয়ের ২৪ বিঘা, ক্ষুদনলালের ২৪ বিঘা চা বাগান ও আবাদি জমি। মূলত অকুল চন্দ্র সিংয়ের এক বিঘা জমি নিয়েই বিরোধ, যেটির অবস্থান এমপির জমির সঙ্গেই। স্থানীয়রা জানান, অকুল চন্দ্রের এই জমি করিডোরের মতো ব্যবহার করে অন্য জমিগুলোতে যাওয়া যায়। এটি দখল হয়ে গেলে অন্য জমিগুলো দখল করা সহজ হয়। ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নাগর নদীর তীরবর্তী বিরোধপূর্ণ অংশটির তিন দিকেই ভারতের সীমান্ত। বাগানে ঢোকার মুখে এমপির বাংলোবাড়ি। সম্প্রতি জমি ফেরত চাইলে এমপির লোকজনের নির্যাতনের শিকার হন অকুল চন্দ্র। এমপির ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজন ও তার সহযোগীদের হামলায় আহত হয়ে সেই দফায় ভারতে পালিয়ে গিয়ে তিনি প্রাণে বাঁচেন। বেশ কিছুদিন পর তিনি ফিরে আসেন। অকুল চন্দ্র অভিযোগ করেন, 'এমপি সাহেবের জমির সঙ্গে আমার এক বিঘা জমি রয়েছে। সবমিলিয়ে আমার পাঁচ বিঘা জমি তার দখলে। আমরা জমি চাইলে তার লোকজন হামলা করে। আমার জমিতে গত ১০ জুন চা চারা রোপণ করলে এমপি সাহেবের লোকজন বিকালেই তা নষ্ট করে দেয়। তার ছেলে সুজন ১৭ জুন আমাদের শাসিয়ে যান। এর দুই দিন পর তার নেতৃত্বে টি এস্টেটের লোকেরা আমাদের ওপর হামলা চালায়।' অকুল চন্দ্র বলেন, 'যেখানে মারধর হয়, সেখানে একটু তো ভয় থাকেই। সেদিন রাতে পরিবার নিয়ে ভারতে পালিয়েছিলাম। পরে ফিরে আসি।' হামলায় আহত থোনারাম সিং বলেন, 'সুজনের হামলায় আমার ছেলেও আহত হয়েছে। ছেলেটার পা ও পিঠে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। আমার দুই বিঘা জমি এখনো তার দখলে। জমি ফেরত চাইলে আমাদের বলে, দুই বছর তারা খাবে তারপর ফেরত দেবে।' নির্যাতনের শিকার ভাকারাম সিং জানান, এমপির সমর্থকেরা তাকে মারধর করলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ঘটনার পর ঠাকুরগাঁও জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা এলাকাটি পরিদর্শন করলেও প্রকাশ্যে কেউ অভিযোগ করেননি। পরিষদের জেলা সভাপতি বলরাম গুহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'জমি দখলের জন্য হামলা হওয়ার ঘটনায় পরিষদের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ভয়ে তারা যাচ্ছে না।'অকুল চন্দ্র সিং আরও বলেন, 'ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আমাদের জমি দখল করেছেন এমপি। তারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মারছে। নির্যাতনের ভয়ে কয়েকটি পরিবার ঘর ছেড়ে চলে গেছে। আমি বেশ কয়েকবার এমপির কাছে গিয়েছিলাম। তিনি দেখা করেননি। এখন আমরা অনেক ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি।' জেলা পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ্ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, 'ঘটনাটি জানার পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একটি প্রতিনিধি দল ওই এলাকা পরিদর্শন করেছে।' পুলিশ সুপার বলেন, 'মূলত চা বাগান নিয়ে দবিরুল সাহেব এবং স্থানীয় কয়েকটি হিন্দু পরিবারের মধ্যে বিরোধ চলছে। কিছু সমস্যা তো আসলে আছেই। তবে আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিক কেউ অভিযোগ জানায়নি। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় স্থানীয়রা বলেছেন, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি কোনো ভয় নেই, তাদের সব ধরনের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।' তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন এমপি দবিরুল ইসলাম। তার দাবি- সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সুনাম নষ্টের চেষ্টা করছে। জানতে চাইলে দবিরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'আমি চার বছর ধরে ওই এলাকায় চা চাষ করছি। যে জমিটি নিয়ে বিরোধ, সেটিতে আমার একটি ঘর তোলা রয়েছে। সেখানে শ্রমিকরা বিশ্রাম নেয়, চা গাছ রাখা হয়। তার মানে এটি চার বছর ধরেই আমার দখলে। অকুল (অকুল চন্দ্র সিং) কিছুদিন আগে বলা নেই, কওয়া নেই সেই জমিতে চা গাছ লাগিয়ে যায়। এটি নিয়ে আমার বাগানের কর্মচারীদের সঙ্গে তার কিছুটা বাকবিতণ্ডা হয়। ঘটনা এটুকুই। কিন্তু স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও আওয়ামী লীগের একটি অংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করে আমার সুনাম নষ্টের চেষ্টা করছে।' এমপি দবিরুল আরও বলেন, 'আমি এক সময় বাম রাজনীতি করেছি। এখন ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এতে ঈর্ষান্বিত হয়েই একটি বিশেষ মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের ভয়, আমার পরে যদি আমার ছেলে এমপি নির্বাচন করে। এ জন্য তারা তাকেও এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছে।' হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই জানিয়ে দবিরুল বলেন, 'আমার ড্রাইভার, গানম্যান দুজনই হিন্দু। আমি হিন্দু বিদ্বেষী নই। আমি ৪৫ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি, এর আগে এরকম কোনো অভিযোগ আমার উপরে আসেনি।' - See more at: http://www.bd-pratidin.com/lead-news/2015/08/24/101812#sthash.OLQ6zs3r.dpuf
Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with ...
__._,_.___