০ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা ও ক্ষোভ, ব্যবস্থা নেয়ার দাবি ব্রিটিশ পার্লামেন্টেরও
০ বিএনপিকে জামায়াত ও হেফাজত ছাড়ার আহ্বান
স্টাফ রিপোর্টার ॥ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। অপরদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত বলেও অভিমত প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায় নির্বাচন বিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট। অনেক স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু নারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়েছে। এসব হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। বৃহস্পতিবার ফ্রান্সে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিশেষ করে নারী-শিশু, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ ছাড়া ঝুঁকিতে থাকা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা বাড়াতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট।
বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের নিয়মিত অধিবেশনে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর নির্ধারিত আলোচনায় কয়েকজন ব্রিটিশ এমপি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়টি তুলে ধরেন। এ সময় এমপি এন মেইন বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে জামায়াত-শিবিরকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে কোন রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হলে তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত। একই সঙ্গে বিরোধীদল দমনের পথ থেকে সরকারকে সরে আসতে বলার পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম থেকে দূরে থাকতে বিএনপিকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষকে সমঝোতার তাগিদও দেয়া হয়েছে।
দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে চার্লস ট্যানক, পাওয়েল রবার্ট কোয়ালের তোলা এই প্রস্তাবের ওপর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনা হয়।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও একই ধরনের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যাতে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
দশম সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ এবং ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী ছাড়ে তাহলে সংলাপে সমঝোতা হলে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টেও প্রায় একই ধরনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
দুই প্রধান দলের রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের স্বার্থে দুই পক্ষকে এক হতে হবে এবং এটা খুবই জরুরী, যাতে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দল সম্মত হলে আগাম নির্বাচনসহ সব বিষয়ই বিবেচনা করা যায়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলার সংস্কৃতি বিনির্মাণেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
সরকারকে বিরোধীদল দমনের পথ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে, বিরোধীদলের নেতাদের মুক্তি দিতে হবে, সাম্প্রতিক সহিংসতায় হতাহতের বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। প্রস্তাবে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশংসা করে বলা হয়, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্যাতিতদের ক্ষত প্রশমনে ট্রাইব্যুনাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ ছাড়া পোশাক খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশটির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা বাড়লেও সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও এর জনগণ একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
৫ জানুয়ারির ভোটে কমসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ও অর্ধেকের বেশি আসন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন থাকার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবে সাতটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিশেষ করে নারী-শিশু, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করতে হবে। সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ করে সঙ্কট উত্তরণের পথ বের করতে বাংলাদেশে সবপক্ষকে কার্যকর আলোচনায় বসার আহ্বান জানাতে হবে। সবপক্ষকে এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছার আহ্বান জানাতে হবে, যাতে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিতের পথ তৈরি হয়, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয় এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকেই সবার আগে স্থান দেয়া যায়। ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার ও কারাবন্দী রাখার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করতে হবে এবং গুরুতর সহিংস ঘটনায় বিরোধী দলের (নবম জাতীয় সংসদের) জড়িত থাকার কঠোর নিন্দা জানাতে হবে। গণগ্রেফতার বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে, যাতে সবাই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন, জমায়েত হওয়া বা মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করতে পারে। ঝুঁকিতে থাকা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা বাড়াতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সুরক্ষা দিতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা তারা নেয়।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে আলোচনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এই আলোচনায় প্রস্তাব পেশের বিষয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসন জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ভীতিমুক্ত অংশগ্রহণমূলক নতুন একটি নির্বাচনের জন্য নতুন সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।