মঙ্গলবার, মে, ১৪, ২০১৩: জ্যৈষ্ঠ ১, ১৪২০ বঙ্গাব্দ: ৩ রজব সানী, ১৪৩৪ হিজরি, ০৭ বছর, সংখ্যা ৩৩১
একটি ভূমিকম্প হলে কী হবে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সুনাম আছে। মানুষ মানুষের পাশে এগিয়ে আসার বড় ধরনের উদাহরণও আছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। সাভারের ভবনধস প্রমাণ করেছে দ্রুততম সময়ে বিপর্যয় সামলানোর মতো আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই নেই। এস এম মুকুল
ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আট মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলে এই বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকা শহরের কী অবস্থা হতে পারে? সাভারের ভবন ধসের চিত্র সে ভয়কে রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত করেছে। আল্লাহ না করুন, আট মাত্রার ভূমিকম্প যদি হয়েই যায় তবে এক ম্যাসাকার পরিস্থিতি তৈরি হবে, এই ভেবে ভয়টা হয়। কে কাকে সাহায্য করবে? কত কত ভবন যে মিশে যাবে মাটির সঙ্গে, তার হিসাব নেই। পুরান ঢাকার অবস্থা কী যে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ ভাবাই যায় না। নতুন ঢাকার আধুনিক ভবনগুলোর অবস্থা নাজুক। জলাশয়ের ওপর নির্মিত হয়েছে বনশ্রী, আফতাবনগর, বসুন্ধরা, উত্তরা ইত্যাদি এলাকা। শক্তিশালী একটা ভূমিকম্প ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে যে কোনো সময়। এ বিষয়ে প্রায়ই সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু কতটুকু সতর্ক হচ্ছে বাংলাদেশ? প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত আমরা?
মানবসভ্যতার উন্নতির পথ ধরে খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও অবকাঠামো তৈরিতে সারা বিশ্বে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এতে যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তেমনি ভূমিকম্প, সুনামি, হারিকেন ক্যাটরিনা, রিটা, উইলমা, সিডর, আইলাসহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বাড়ছে। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর থেকে বাঁচার উপায় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারও ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর নয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার আমেরিকা ক্যাটরিনা ও উইলমারের মোকাবেলা করতে পারেনি। বাংলাদেশ এখনো ভয়াল সিডর ও আইলার পরিণতি মোকাবেলা করছে। প্রযুক্তিনির্ভর জাপান, পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ভারত এমনকি পাকিস্তানও পারেনি শতাব্দীর ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে। এই বাস্তবতা স্মরণ রাখতে হবে।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ ১০ শহরের মধ্যে আছে ঢাকার নাম। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই রাজধানী ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। ঢাকার পরিণতি নিয়ে বহু লেখালেখিও হচ্ছে। কিছু দিন পর পরই ঢাকায় মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়। সিলেটের শ্রীমঙ্গল, আসাম সীমান্তের ডাউকি ফল্ট বা টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টের যে কোনো একটিতে রিকটার স্কেলে ছয় থেকে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ৩০ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কমপ্রিহ্যানসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমসি)-এর এক জরিপে বলা হয়েছে, সাড়ে সাত বা আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় শহরের ৪০ ভাগ ভবন ধসে পড়বে। জরিপে আরো বলা হয়েছে, মধুপুর ফল্টে দিনের বেলায় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় প্রায় ৩১ হাজার মানুষ প্রাণ হারাবে। আহত হবে আরো ৫০ হাজার। একই মাত্রার ভূমিকম্পটি রাত ২টায় হলে প্রাণ হারাবে ১ লাখ ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ। আবার ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার হতাহতের ঝুঁকি আরো বেশি।
আমরা জানি, ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম উপকূলে ভয়াবহ সুনামিতে নিহত হয় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। ২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে সাত দশমিক নয় মাত্রার ভূমিকম্পে স্কুল ও হাসপাতালসহ বহু সরকারি ভবন ধসে পড়ে। তখন শিশুসহ ৮৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। আবার হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সের ভূমিকম্প দেশটির জন্য চরম মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ আর পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে শোকে হতবিহ্বল হয়েছিল পোর্ট অব প্রিন্সের জনগণ। খোলা আকাশের নিচে আশ্রয়। কী করবেন তারা? শোকের কান্নায় কাতর হবেন নাকি মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাবেন? এমন ভয়ানক বিপর্যয়ে কে কাকে সাহায্য করবে? কী করার ছিল হাইতির জনগণের অথবা সরকারের? দেশের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আশ্রয় নিয়েছেন বন্ধুর বাসায়। যেখানে সেখানে গণকবর। স্কুল, হাসপাতাল, সরকারি অফিস, আবাসিক এলাকা, সুপার মার্কেট সবই বিধ্বস্ত। দেশটির পার্লামেন্ট, প্রেসিডেন্ট ভবন এবং অর্থ, যোগাযোগ, সংস্কৃতিবিষয়ক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভেঙে পড়েছে।
জাপানি সংস্থা সিডিএমপি দুই বছর গবেষণার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডারে যে কোনো সময় আট দশমিক পাঁচ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হবে। এ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ১৮৯৭ সালে ওই বর্ডারে একবার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই স্থানে যে কোনো সময় আবার ভূমিকম্প হবেই। মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডারের ওই স্থান থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ১৩০ আর কক্সবাজার থেকে ওই স্থানের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। মিয়ানমার-বাংলাদেশ বর্ডারে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামে এর আঘাত হবে সাত দশমিক পাঁচ মাত্রার। এতে চট্টগ্রামের ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। হতাহত হতে পারে লাখো মানুষ।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা নগরীর অর্ধেকেরই বেশি ভবনের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। পুরান ঢাকায় প্রকৌশলীদের পরামর্শ, ডিজাইন বা সাহায্য ছাড়াই তৈরি হয়েছে ৬০ শতাংশ বাড়িঘর। ৬৫ শতাংশ বাড়িই ইট-সুরকির তৈরি। সমীক্ষায় প্রাপ্ত উপাত্ত দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় ৫.৫ রিকটার স্কেল মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং সাত-আট রিকটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দালানকোঠা, ভবন বা ঘরবাড়ি ধসে পড়বে। ঢাকার প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে নরম মাটিতে কিংবা জলাশয় ভরাট করা জায়গায় ৯ থেকে ১৪ তলা ভবন তৈরি। এতে ভূমিকম্পে পুরো বাড়িই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতেই প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস। সুতরাং ৬০ ভাগ ভবন ভেঙে পড়লে কী পরিমাণ লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩ লাখ ২৬ হাজার বসতবাড়ির ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সাত থেকে সাড়ে সাত মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ৭২ হাজার বসতবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। ৮৫ হাজার ভবনের মাঝারি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ভূমিকম্পের কারণে ৯০ হাজার মানুষ হতাহত হবে। ভূমিকম্পটি যদি দিনের বেলায় ঘটে তবে হতাহতে সংঝ্যা দাঁড়াতে পারে ৭০ হাজারের মতো।
ভূমিকম্পের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ জেলা ছাড়াও রংপুর, বগুড়া, ঢাকা এবং কুমিল্লা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছে কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আর এ দুটো অঞ্চলের মাঝামাঝি অবস্থানে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশাপাশি বৃহত্তর দিনাজপুর এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও রংপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার আংশিক এলাকা।
ভূমিকম্প ঝুঁকি থেকে বাঁচতে বাড়িঘর নির্মাণের সময় প্রকৌশলীদের দিয়ে নকশা তৈরি, তত্ত্বাবধান ও জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে_ ১. ভূমিকম্পের পরে ভেঙে পড়া ভবনের নিচে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার ও আগুন নেভানোর জন্য দমকলকে প্রস্তুত রাখতে হবে ২. বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ইত্যাদি সার্ভিসকে নিয়ে সমন্বি্বত ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা ৩. ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় পাড়ায়, মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া। সেখানে জনসাধারণের পাশাপাশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, টেকনিশিয়ান, মিস্ত্রি ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতদের অন্তর্ভুক্ত করা ৪. স্থানীয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, পূর্ত বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গ্যাস, টিঅ্যান্ডটি বোর্ড, অগি্ননির্বাপণ বিভাগ ইত্যাদি সংস্থার উদ্ধারকারী দল, প্রয়োজনীয় লোকবল ও সরঞ্জামাদিসহ সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত এবং সমন্বিত থাকা ৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ও বাসাবাড়ির জনসাধারণকে ভূমিকম্প মোকাবেলায় সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক মহড়া অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা এবং ৬. দক্ষ জনবল তৈরিতে প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ টিমের সাহায্য নেয়া উচিত।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সুনাম আছে। মানুষ মানুষের পাশে এগিয়ে আসার বড় ধরনের উদাহরণও আছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু সুনামি ও ভূমিকম্পের মতো বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। সাভারের ভবনধস প্রমাণ করেছে দ্রুততম সময়ে বিপর্যয় সামলানোর মতো আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই নেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ অঞ্চলের ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় আট দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্পেরও আশঙ্কা আছে। ফলে ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশের উপকূলেও ভয়াবহ সুনামি দেখা দিলে পরিণতি কী হতে পারে ভাবা যায়? মনে রাখা দরকার, কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পে তুরস্কের একটি অঞ্চল ব্যাপক ধ্বংসলীলার শিকার হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কটি দেশ যেমন_ ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ উপকূলে যে ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাস হয় তাতে হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও দেড় লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাস ছিল স্মরণকালের মারাত্মক বিপর্যয়। বাংলাদেশ কী ভাবছে?
এস এম মুকুল: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক
ষবশযড়শসঁশঁষ@মসধরষ.পড়স
__._,_.___